মালয়েশিয়া সরকার সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরির হাব হওয়ার জন্য নতুন জাতীয় সেমিকন্ডাক্টর কৌশল গ্রহণ করেছে। এই কৌশলের আওতায় দীর্ঘমেয়াদে মোট ৫.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করবে।
এজন্য মালয়েশিয়া ৬০ হাজার স্থানীয় সেমিকন্ডাক্টর ইঞ্জিনিয়ারদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে, যা সেমিকন্ডাক্টর চিপ শিল্প প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ২৮ মে অনুষ্টিত সম্মেলনে এ সম্পর্কিত কৌশলপত্র ঘোষণা করেন।
দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় এই দেশটি সেমিকন্ডাক্টর শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য কাজ করছে। কারণ ক্রমবর্ধমান মার্কিন-চীন বৈরিতা এবং অন্যান্য ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে মালয়েশিয়া নিজেকে চিপ নির্মাতাদের জন্য একটি নিরপেক্ষ কেন্দ্র হিসেবে অবস্থান করে নিয়েছে। তাছাড়াও বৈশ্বিক কোম্পানিগুলো তাদের সরবরাহ চেইনকে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়ে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে ।
সম্মেলনে ঘোষিত ন্যাশনাল সেমিকন্ডাক্টর স্ট্র্যাটেজির অধীনে, মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম সম্পদ তহবিল যেমন খাজানাহ ন্যাশনাল হতে আগামী পাঁচ থেকে ১০ বছরে অন্তত ২৫ বিলিয়ন রিংগিত (৫.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) অর্থ বরাদ্দ করে প্রকৌশলীদের মেধা ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সক্ষমতাকে বৃদ্ধি করবে।
কুয়ালালামপুরে সেমিকোন সাউথইস্ট এশিয়া ২০২৪ ট্রেড শো অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের লক্ষ্য হলো এমন একটি সিস্টেম তৈরি করা যা ডায়নামিক মালয়েশীয় প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ব মানের মেধাবীদের দ্বারা পরিচালিত হবে। বিশ্ব কোম্পানির সঙ্গে যোগসূত্র করা হবে যেন ইনোভেশন এবং সৃষ্টিশীলতা দিয়ে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হয়।
তিনি বলেন, আমি আমার জাতিকে (মালয়েশিয়াকে) সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন এবং সেমিকন্ডাক্টর সাপ্লাই চেইন এর জন্য সব থেকে নিরপেক্ষ, নিরাপদ এবং প্রাণবন্ত স্থান হিসেবে বিশ্বের নিকট উপস্থাপন করছি।
কৌশলটির লক্ষ্য হলো ৬০ হাজার লোককে চিপমেকিং এর বিভিন্ন দিক, ডিজাইন, প্যাকেজিং, টেস্টিং, সাপ্লাই সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া। প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয় এবং কর্পোরেশন জড়িত থাকবে।
মালয়েশিয়া যদি বিশ্বব্যাপী চিপ নির্মাতাদের কাছ থেকে আরো বেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে চায়, বিশেষ করে সরকার দেশে আরো উন্নত চিপ উৎপাদনের আশা করে, তাহলে আরো দক্ষ স্থানীয় প্রকৌশলী থাকা গুরুত্বপূর্ণ বলে নিক্কেই এশিয়া সংবাদে উল্লেখ করেছে।
কৌশল অনুসারে, সরকারের লক্ষ্য অভ্যন্তরীণ সরাসরি বিনিয়োগ (ডিডিআই) এবং বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) মাধ্যমে ৫০০ বিলিয়ন রিঙ্গিত বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা।
সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে মালয়েশিয়া পাঁচ দশকেরও বেশি আগে প্রবেশ করে। মালয়েশিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অনুসারে দেশটি বিশ্বের প্রায় ১৩% চিপ প্যাকেজিং, সমাবেশ এবং পরীক্ষার পরিষেবা প্রদান করে।
তথ্যানুসারে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ইন্টেল একটি চিপ প্যাকেজিং এবং টেস্টিং প্ল্যান্ট স্থাপন করতে ৭ বিলিয়ন ইউএস ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছে, এই বছর উত্পাদন শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
গত বছর, জার্মানির ইনফিনন টেকনোলজিস বিশ্বের বৃহত্তম ২০০-মিলিমিটার সিলিকন কার্বাইড পাওয়ার ফ্যাব্রিকেশন সুবিধা তৈরি করতে আগামী পাঁচ বছরে ৫ বিলিয়ন ইউরো পর্যন্ত বিনিয়োগের ঘোষণা করেছে।
নিক্কেই এশিয়া আরো উল্লেখ করে, মালয়েশিয়া সম্প্রতি সেমিকন্ডাক্টরসহ হাই-টেক ম্যানুফ্যাকচারিং বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে। অতি সম্প্রতি, সরকার বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম এবং কারিগরি স্টার্টআপগুলোকে প্রলুব্ধ করতে গত মাসে ‘গোল্ডেন পাস’ এবং অন্যান্য প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করেছে।
সরকার রাজধানীর কাছাকাছি সেলাঙ্গর রাজ্যের শিল্প অঞ্চলে বৃহত্তম ইন্টিগ্রেটেড চিপ ডিজাইন হাব প্রতিষ্ঠার ঘোষণাও করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, মালয়েশিয়া সরকারের কৌশল অনুযায়ী সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরির উপযুক্ত মেধাবীদের আকৃষ্ট করবে। সে হিসেবে বিশ্বের ট্যলেন্টদের কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু এই শিল্পে কাজ করার জন্য উচ্চ মান সম্পন্ন মানব সম্পদ তৈরি করতে হবে, যেন এ ক্ষেত্রের শিল্প উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করে।
বাংলাদেশের জনবলের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ পাবে কি না সে বিষয়ে বাংলাদেশের দূতাবাস ও সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং মালয়েশিয়া সরকার ও সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করতে হবে। নইলে অন্য দেশ এই সুযোগ নিবে এবং বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে।
সরকারের দরকষাকষির কারণে মালয়েশিয়া বাংলাদেশেও সেমিকন্ডাক্টর ক্ষেত্রে উপযুক্ত জনবল তৈরির প্রশিক্ষণ বাংলাদেশের মাটিতেও আয়োজন করতে পারে। দক্ষ জনবল প্রেরণের এটি একটি সুবর্ন সুযোগ হবে বলে অনেকে মনে করছেন।
এ দিকে বাংলাদেশ মালয়েশিয়া চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (বিএমসিসিআই) এর ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল চেম্বার সভাপতি সাব্বির এ খানের নেতৃত্বে, তিন দিনব্যাপী সেমিকন সাউথইস্ট এশিয়া ২০২৪ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদান করেন।
সম্মেলনের উদ্বোধনের পর মালয়েশিযার প্রধানমন্ত্রী প্যাভিলিয়ন ও স্টল পরিদর্শন করেন, এ সময় তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
বাংলাদেশ বর্তমানে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প থেকে বার্ষিক প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার আয় করে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট ডিজাইনের মাধ্যমে। বাংলাদেশ সরকার ২০৩১ সালের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানিমুখী সেমিকন্ডাক্টর শিল্প গড়ে তোলার লক্ষ্য ঠিক করেছে।
৬০০ বিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক বাজারটি এই দশকের শেষ নাগাদ ১ ট্রিলিয়ন ডলারের শিল্পে রূপান্তরিত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই বৈশ্বিক বাজারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসমূহের দেশগুলো বিশেষ করে মালয়েশিয়া কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত।
বাংলাদেশের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের নেতৃস্থানীয় কোম্পানির কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত এই প্রতিনিধিদলের লক্ষ্য দুই দেশের শিল্পের মধ্যকার সংযোগ স্থাপন, দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্বের সুযোগ সৃষ্টি এবং বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের মধ্যে অভিজ্ঞতা আদান-প্রদানের মাধ্যমে মালয়েশিয়া এই অঞ্চলে কিভাবে নেতৃস্থানীয় হয়ে উঠলো তা প্রত্যক্ষ করা।
বিএমসিসিআই প্রতিনিধিদল মালয়েশিয়া ডিজিটাল ইকোনমিক কর্পোরেশন (এমডিইসি), মালয়েশিয়া এক্সটার্নাল ট্রেড ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (ম্যাট্রেড), মালয়েশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মাইক্রোইলেক্ট্রনিক সিস্টেমস (MIMOS), এবং মালয়েশিয়ান সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (MIMOS) এর মতো মালয়েশিয়ার সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের নেতৃস্থানীয় সংস্থা ও সেখানকার কর্তাব্যক্তিদের সাথে সংলাপ করেছেন।
মালয়েশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মাইক্রোইলেক্ট্রনিক সিস্টেমস (MIMOS) এর সহায়তায় বিএমসিসিআই প্রতিনিধিদল সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়নে গৃহীত উদ্যোগ ও কার্যক্রমগুলো সরাসরি পরিদর্শন করছেন, যা ছিল এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। মালয়েশিয়ার সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি বাংলাদেশের সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নকল্পে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে আগ্রহ দেখিয়েছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post