আড়াই বছরের ছোট্ট শিশু হাবিবা। জ্বর, সর্দি ও কাশিতে ভুগছে কয়েকদিন ধরে। ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাইয়েছেন বাবা-মা; কিন্তু উপকার মেলেনি। হাবিবার শরীরিক অবস্থার অবনতি হলে গত ৩ জুলাই বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে নিয়ে যান ইসরাফিল-সাথী দম্পতি। মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের বাসিন্দা তারা। হাবিবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ব্যবস্থাপত্র দেন হাসপাতালের বহির্বিভাগে দায়িত্বরত এক চিকিৎসক। সেখানে জ্বর ও কোষ্ঠকাঠিন্যের ওষুধের পাশাপাশি ‘স্মার্ট আইকিউ’ নামের একটি ওষুধের নাম লেখেন। সিরাপটি ১৫ দিন দিনে দুবেলা করে খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘স্মার্ট আইকিউ’ নামের ওষুধটি মূলত ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট। এটি থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা। প্যাকেটের তথ্য অনুযায়ী, ওষুধটিতে টুনা মাছের তেল ও মাল্টিভিটামিন উপাদান আছে। ওষুধটির দাম ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা। অন্যদিকে দেশি কোম্পানি উৎপাদিত একই ধরনের ওষুধের দাম বাজারে মাত্র ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এ ধরনের সিরাপ ১৫ দিন দুবেলা করে খাওয়াতে কমপক্ষে তিনটি ফাইল প্রয়োজন, যার দাম পড়বে সাড়ে ৪ হাজার টাকা। অথচ দেশি কোম্পানির ওষুধ কিনতে খরচ পড়বে মাত্র ৩শ টাকা।
১ জুলাই থেকে ৩ জুলাই শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে অবস্থান করে দেখা যায়, শিশুরা যে ধরনের অসুস্থতা নিয়েই আসুক না কেন, সবার ব্যবস্থাপত্রেই এ ধরনের একটি বিদেশি দামি ওষুধের নাম ঢালাওভাবে লিখে দিচ্ছেন চিকিৎসক।
সাভারের নবীনগর এলাকার মাহফুজ-নাদিয়া দম্পতির এক বছরের মেয়ে মার্জিয়া। প্রদাহজনিত কারণে তাকে শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। মার্জিয়ার ব্যবস্থাপত্রে অন্য ওষুধের সঙ্গে ‘গ্রোথ বেবি’ নামে একটি বিদেশি ওষুধের নাম লিখেছেন চিকিৎসক। দিনে দুই চামচ করে চলবে বলে লেখা আছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এই ওষুধটিও ভিটামিন ডি জাতীয় বিদেশি ওষুধ। দাম বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ হাজার ৪০০ টাকা।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিশু বিশেষজ্ঞ গণমাধ্যমকে জানান, কিছু অসাধু চিকিৎসক বিদেশ থেকে বৈধ-অবৈধ পথে আনা ভিটামিন ও ফুড সাপ্লিমেন্ট কোম্পানির প্রলোভনে পড়ে সব শিশুর ব্যবস্থাপত্রে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে এ ধরনের ওষুধ লিখছেন। এটা লিখলে কোম্পানি থেকে তিনি ৫০০ টাকার মতো কমিশন পান। অর্থাৎ দিনে ৫০টি ব্যবস্থাপত্রে এসব ওষুধের নাম লিখলে এক চিকিৎসক দৈনিক গড়ে আয় করেন ২৫ হাজার টাকা।
তারা আরও বলেন, স্মার্ট আইকিউ, গ্রোথ বেবি ও হেলথ জয়সহ আরও বেশকিছু বিদেশি ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে এখন বেশি লেখা হচ্ছে। নীতিহীন চিকিৎসক এবং অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের লোভের কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অসংখ্য শিশুর পরিবার। আইনি জটিলতা না থাকলেও একই মানের কম মূল্যের দেশি ওষুধ থাকার পরেও উচ্চমূল্যের এসব ওষুধ লেখাকে অনৈতিক বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বিষয়টিকে দেখছেন স্বাভাবিকভাবেই। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, বৈধ যে কোনো ওষুধই লিখতে পারবেন চিকিৎসকরা। এখানে তাকে আটকানো বা বাধা দেওয়ার আইন নেই। তবে চিকিৎসা মানবিক পেশা বলে চিকিৎসকদের অনুরোধ করব তারা যাতে একই মানের দেশি ওষুধ থাকার পরেও বিদেশি উচ্চমূল্যের ওষুধ না লেখার। এখানের চিকিৎসকরা এগুলো লেখেন বলে জানা নেই। তবে, রোগীর স্বজনরা প্রমাণ সাপেক্ষে অভিযোগ করলে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসুস্থ শিশুর চিকিৎসায় এ হাসপাতালে ছুটে আসেন অভিভাবকরা। সেই প্রতিষ্ঠানই চিকিৎসার নামে গলা কাটছেন কিছু চিকিৎসক। তাদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী বিদেশি ওষুধ কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন রোগীর স্বজন।
মোহাম্মদপুরের ইসরাফিল গণমাধ্যমকে বলেন, সন্তানের চিকিৎসায় চিকিৎসকের পরামর্শ মতোই ওষুধ কিনি। কম দামে এসব বিদেশি ওষুধের মানসম্পন্ন বিকল্প থাকার কথা জানালে বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি। পরে আক্ষেপ করে বলেন, শিশুদের চিকিৎসায়ও দানবীয় লোভ! যাওয়ার আর জায়গা থাকল না। বাজারে ১০০ টাকায় থাকার পরে একই ওষুধ ১৫০০ টাকার বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এটা তো গলা কাটার শামিল।
বিদেশি ওষুধ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী পরিচয়ে কথা হয় শিশু হাসপাতালে উপস্থিত এ ধরনের ওষুধ বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সঙ্গে। তারা বলেন, যত ভালো ওষুধই আমদানি করেন চিকিৎসক না লিখলে বিক্রি হবে না। প্রথমে তাদের ম্যানেজ করতে হবে, খুশি করতে হবে তাহলেই আপনার ওষুধ লিখবে।
এসব বিষয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপের সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এম আজিজ বলেন, যেসব ওষুধ দেশেই উৎপাদিত হয় এবং দাম কম সেক্ষেত্রে বেশি দামের বিদেশি ওষুধ লেখা নীতিবহির্ভূত। তাছাড়া সেগুলো ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর অনুমোদিত কি না, সেটাও দেখা দরকার। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য প্রশাসনের নজরদারি জরুরি। একই সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post