ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের টানা চারবার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য (এমপি) হন ওমর ফারুক চৌধুরী। তানোর-গোদাগাড়ী সীমান্তবর্তী হওয়ায় এলাকার মাদকের নিয়ন্ত্রণ করতেন ফারুক চৌধুরী। শুধু হেরোইন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই তিনি প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা কামিয়েছেন বলে জানা গেছে। মাদক ব্যবসায়ীদের থেকে বিলাসবহুল দামি গাড়িসহ নানা উপঢৌকন নেওয়া ছিল তার নেশা। গোদাগাড়ীর শীর্ষ হেরোইন ব্যবসায়ীদের নিজেই নার্সিং করতেন সদ্য সাবেক এমপি ওমর ফারুক। তার নিয়ন্ত্রণাধীন মাদক ব্যবসায়ীরা যাতে কোথাও বিপদের সম্মুখীন না হয়, সেজন্য তিনি কৌশলে মারধরও করাতেন। এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন সীমান্তে মাদক ব্যবসার গডফাদার। ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক প্রতিবেদনে এমপি ফারুককে মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও উল্লেখ করেছে।
এমপি থাকাকালীন দেড় যুগে তিনি এলাকায় নিয়োগ-বাণিজ্য করে অন্তত সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অর্থ আর সম্পদের নেশায় ডুবে থাকা এই এমপি মানুষকে মানুষ হিসেবে তোয়াক্কাই করতেন না। উন্মাদের মতো ব্যবহারের কারণে তার সামনে কারও কথা বলারও সাহস ছিল না। শিক্ষক থেকে শুরু করে দলীয় নেতাকর্মী ও এলাকার মানুষদের মারধর, গালমন্দ ছিল তার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমনকি জোরপূর্বক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়ি নিজের নামে লিখে নেওয়ারও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে এলাকায় ‘পাগল’ নামে পরিচিত সাবেক এই এমপির বিরুদ্ধে। এভাবে অত্যাচার-নির্যাতনের মাধ্যমে তানোর-গোদাগাড়ী এলাকার এই অঘোষিত জমিদার বনে যান ওমর ফারুক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নির্বাচনী এলাকায় ফারুকের বিভিন্ন জায়গায় আলাদা আলাদা ‘অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার সিন্ডিকেট’ ছিল। এসব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি বিভিন্নভাবে অবৈধ আয় করতেন। এসব সিন্ডিকেটের সদস্যদের মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ-বাণিজ্য করাতেন। আবার কোথাও নিজেই নিয়োগের ডিল করতেন। এভাবে এমপি ফারুক শিক্ষক নিয়োগ থেকেই হাতিয়ে নিয়েছেন অন্তত ৪০০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া এমপি ফারুক ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে লুট করেছেন কাবিখা ও টিআর প্রকল্পের সরকারি বরাদ্দের অর্থ। একইভাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রকল্পও বাস্তবায়ন না করে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রকল্পের টাকা। সরকারি খাদ্যগুদামে ধান-চাল সরবরাহ সিন্ডিকেটও নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
ফারুক তার মালিকানাধীন থিম ওমর প্লাজায় মাদক ব্যবসায়ীদের দোকান এবং ফ্ল্যাট নিতে বাধ্য করেছেন। এর মাধ্যমেও হাতিয়ে নিয়েছেন অর্ধশত কোটি টাকা। দলীয় কর্মসূচি পালনের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের করেছেন জিম্মি। নিয়েছেন মোটা অঙ্কের চাঁদা। দলীয় পদ বাণিজ্য করে কামিয়েছেন অঢেল টাকা। দখলে রেখেছিলেন এলাকার হাট, ঘাট ও ইজারার মাঠ।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমেই গোদাগাড়ী ও তানোরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজর পড়ে ফারুক চৌধুরীর। শুরু করেন শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য। তাকে টাকা না দিয়ে কেউ নিয়োগ পেতেন না। মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রত্যেক শিক্ষক নিয়োগে তিনি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা নিতেন। আর প্রধান শিক্ষক নিয়োগে নিতেন কমপক্ষে ২০ লাখ। মাদ্রাসার শিক্ষক এবং সুপার নিয়োগের ক্ষেত্রেও টাকা আদায়ের হার ছিল একই রকম। উচ্চ মাধ্যমিক (কলেজ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে নিতেন ১৫ লাখ টাকা। আর অধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০ লাখ।
নিয়োগ বাণিজ্যের টাকা আদায়ের জন্য ওমর ফারুক দলীয় নেতাদের ব্যবহার করতেন। প্রথমদিকে গোদাগাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি বদিউজ্জামান বদি, সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশিদ, তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম রাব্বানী এবং সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন শিক্ষক নিয়োগের টাকা তুলতেন। পরে তাদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ১০ বছর এ দায়িত্বে ছিলেন গোদাগাড়ী এবং তানোরের সদ্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম, লুৎফর হায়দার রশিদ ময়না ও আবুল বাসার সুজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গোদাগাড়ী উপজেলায় মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং মাদ্রাসা মিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ১০২টি। আর তানোরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ১০৩টি। গোদাগাড়ীতে মোট শিক্ষক রয়েছেন ২ হাজার ১৬৪ জন। আর তানোরে মোট শিক্ষকের সংখ্যা ২ হাজার ২০৭ জন। এ দুই উপজেলা মিলে মোট শিক্ষকের সংখ্যা ৪ হাজার ৩৭১ জন।
এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষক এমপি ফারুকের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন। সে হিসাবে ২ হাজার ৯১৪ জন শিক্ষক তার সময়ে নিয়োগ পেয়েছেন। গড়ে প্রতি শিক্ষকের কাছ থেকে ১৪ লাখ টাকা করে নিলেও এ খাত থেকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ফারুক।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী হেরোইনের আন্তর্জাতিক রুট। ভারত সীমান্ত পেরিয়ে বিপুল পরিমাণ হেরোইন ঢোকে এই পথে। এটিকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে মাদক কারবারিরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং বিদেশে হেরোইন পাচার করে। এ এলাকায় রয়েছে অন্তত শতাধিক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে অর্ধশতাধিক মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রতি মাসে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা করে মাসোহারা নিতেন ওমর ফারুক। এভাবে প্রতি মাসে তার মাসোহারার পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ কোটি টাকা। বছরে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা শুধু মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোয়ারা নিতেন। এভাবে চারবার এমপি থাকাকালে তিনি ১৬ বছরে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা নিয়েছেন।
এমপি ফারুক তার মালিকানাধীন থিম ওমর প্লাজায় গোদাগাড়ী ও তানোরের অর্ধশতাধিক মাদক ব্যবসায়ী এবং আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকে দোকান ও ফ্ল্যাট নিতে বাধ্য করেন। এর মধ্যে অনেকে নিয়েছেন একাধিক দোকান ও ফ্ল্যাট। প্রতিটি দোকানের জন্য ওমর ফারুক নিয়েছেন ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা। আর ফ্ল্যাটের জন্য কোটি টাকা। এভাবে তিনি ৮০টি দোকান ও ফ্ল্যাট উচ্চ দামে বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছেন অর্ধশত কোটি টাকা।
থিম ওমর প্লাজার এক কর্মচারী বলেন, থিম ওমর প্লাজায় এমপি ফারুকের রাজনৈতিক কার্যালয় ছিল। রাত ১১টার পর তিনি সেখান থেকে নেতাকর্মীদের সরিয়ে দিতেন। এরপর শুরু হতো মাদক ব্যবসায়ীদের আনাগোনা। সবচেয়ে বেশি যাতায়াত ছিল গোদাগাড়ীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম টিপু, তার বড় ভাই গোদাগাড়ী পৌরসভার কাউন্সিলর মনিরুল ইসলাম মনি, মাদক ও হুন্ডি ব্যবসায়ী আসাদুল, জসিম, বাবু, দারোগা ও পোয়া বাবুর।
এমপি ফারুকের নির্বাচনী এলাকায় বছরে টিআর ও কাবিখা প্রকল্প আসত তিনবার। এ বাবদ বরাদ্দ ছিল ৬ কোটি টাকা। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং মসজিদ-মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে এ টাকা বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে এ বরাদ্দের শতকরা ৮০ ভাগই নিয়েছেন এমপি ফারুক।
এ ছাড়া দুই উপজেলায় প্রতি বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৪ কোটি টাকা আসত। এ বরাদ্দও ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে হাতিয়ে নিতেন ফারুক। বিভিন্ন সড়ক সংস্কার প্রকল্পের টাকাও কাজ না করে আত্মসাৎ করেন। এভাবে ১৬ বছরে বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচির প্রায় ৪০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পাশাপাশি বৈধ-অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও টাকা নিতেন ওমর ফারুক।
অন্যের জমি-বাড়ি দখলেরও অভিযোগ রয়েছে ফারুকের বিরুদ্ধে। গোদাগাড়ী সদরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বদিউজ্জামানের প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি নিজের নামে লিখে নিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া গোদাগাড়ী ও তানোরের অর্ধশতাধিক হাট ও ঘাট নিয়ন্ত্রণ করতেন ফারুকের সহযোগী আবুল বাশার সুজন। অন্যদের সরিয়ে দিয়ে এগুলো স্বল্পমূল্যে নিলাম নিয়ে ফারুক তার শাসনামলে শতকোটি টাকা কামিয়েছেন।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সাবেক এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা আত্মগোপন করেছেন। এরই মধ্যে তিনি এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে হাফ ডজন মামলা দায়ের হয়েছে। ওমর ফারুক ও তার সহযোগীদের সব ফোন নম্বরও বন্ধ। তাই এ বিষয়ে সাবেক এমপি ফারুক এবং তার সহযোগীদের মন্তব্য জানা যায়নি।
গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম এবং তানোর থানার ওসি মিজানুর রহমান জানান, ৫ আগস্টের পর থেকে সদ্য সাবেক এমপি ফারুক এবং তার রাজনৈতিক সহযোগীরা এলাকায় নেই। তারা পলাতক। তাদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post