কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে পুলিশ সদস্য গিয়াস উদ্দিন হত্যা মামলায় ১৭ বছর তিন মাস আট দিন বয়সী এক কিশোরকে রিমোন্ডে পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে।
শনিবার এ মামলায় ডেমরা থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মাসুদ রানাসহ সাত জনকে ৭ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেয় আদালত। ওই সাতজনের মধ্যে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজের বয়স এখনো ১৮ হয়নি বলে তার আইনজীবীর ভাষ্য।
ফাইয়াজের আইনজীবী মো. মুজাহিদুল ইসলাম শনিবার আদালতে রিমান্ডের বিরোধিতা করে জামিন চেয়েছিলেন। ফাইয়াজকে ‘শিশু’ দাবি করে রিমান্ডে না পাঠানোর আর্জি জানিয়েছিলেন।
শুনানি শেষে মহানগর হাকিম শান্তা আক্তার জামিন নাকচ করে ফাইয়াজকেও রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দেন।
আইনজীবী মুজাহিদুল বলেন, “কোনো মামলাতেই শিশুকে পুলিশ রিমান্ডে নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাকে আসামিও বলা যায় না। বলতে হয়, আইনের সঙ্গে সংঘাতে আসা শিশু।”
এই প্রেক্ষাপটে শিশু আইনের ২১ ধারা অনুযায়ী হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজকে শিশু ঘোষণা করে তাকে শিশু আইনের যাবতীয় আইনগত সুযোগ সুবিধা দেওয়ার জন্য রোববার যাত্রাবাড়ী থানা এলাকার এখতিয়ারাধীন ঢাকার ৩ নম্বর শিশু আদালতে আবেদন করেন আইনজীবী মুজাহিদুল।
শুনানিতে ফাইয়াজের জন্মনিবন্ধন সনদ এবং ২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের অনলাইন কপি দাখিল করে এ আইনজীবী বলেন, তার জন্ম ২০০৭ সালের ১৯ এপ্রিল। সে অনুযায়ী তার বয়স ১৭ বছর ৩ মাস ৮ দিন।
শিশু আদালতে দাখিল করা লিখিত আবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালের শিশু আইনের ২০ ধারায় বলা হয়েছে, “আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইন, আদালতের রায় বা আদেশে ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দেশ্যপূরণকল্পে, অপরাধ সংঘটনের তারিখই হইবে শিশুর বয়স নির্ধারণের জন্য প্রাসঙ্গিক তারিখ।”
শিশু আইনের ৫২ (১) ধারায় বলা হয়েছে, “ফৌজদারি কার্যবিধিসহ বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইন বা এই আইনের অন্য কোনো বিধানে ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোন শিশুকে গ্রেপ্তার করিবার পর এই আইনের অধীন মুক্তি প্রদান বা বিকল্প পন্থায় প্রেরণ করা অথবা তাৎক্ষণিকভাবে আদালতে হাজির করা সম্ভবপর না হইলে শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা শিশুটিকে, ক্ষেত্রমত, তাহার মাতা-পিতা এবং তাহাদের উভয়ের অবর্তমানে তত্ত্বাবধানকারী অভিভাবক বা কর্তৃপক্ষ অথবা আইনানুগ বা বৈধ অভিভাবক বা, ক্ষেত্রমত, বর্ধিত পরিবারের সদস্য বা প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে শর্ত ও জামানত সাপেক্ষে, অথবা, শর্ত ও জামানত ব্যতীত জামিনে মুক্তি প্রদান করিতে পারিবেন।”
৫২(২) ধারায় বলা হয়েছে, “ উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো শিশুকে জামিনে মুক্তি প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অপরাধ জামিনযোগ্য বা জামিন অযোগ্য কি না তাহা শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা বিবেচনায় লইবেন না।”
৫২ (৫) ধারায় বলা হয়েছে, “থানা হইতে জামিনপ্রাপ্ত হয় নাই এমন কোনো শিশুকে শিশু-আদালতে উপস্থাপন করা হইলে শিশু-আদালত তাহাকে জামিন প্রদান করিবে বা নিরাপদ স্থানে বা শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আটক রাখিবার আদেশ প্রদান করিবে।”
আবেদনটি শুনানির পর ঢাকার শিশু আদালত ৩ এর বিচারক মোসা. রোকসানা বেগম আদেশ দিয়েছেন, রিমান্ড শেষে ফাইয়াজকে হাকিম আদালতের হাজতখানায় নিয়ে আসা হলে তাকে যেন শিশু আদালতে হাজির করা হয়। ওই আদালতের পুলিশ কর্মকর্তা প্রসিকিউশন বিভাগের সহকারী কমিশনার হারুন-উর-রশিদকে এই নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিচারক শুনানিতে বলেন, শিশু আদালতে হাজির করা হলে ফাইয়াজকে পর্যবেক্ষণ করে তিনি প্রয়োজনীয় আদেশ দেবেন। সে যদি শিশু হয়, তাহলে শিশু আইন অনুযায়ী সকল সুযোগ-সুবিধা সে পাবে।
এ মামলায় রিমান্ডে পাঠানো অন্যরা হলেন ডেমরা থানার ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা, দনিয়া ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ইরফান ওরফে রোকন, ছাত্রদলের সদস্য মো. আবু বক্কর, রবিউল ইসলাম, মো. সৌরভ মিয়া, মো. তারেক হোসেন।
হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজের বয়স এজাহারে দেখানো হরেছে ১৯ বছর, কিন্তু রিমান্ড আবেদনে দেখানো হয়েছে ১৮।
এজাহার, এফআইআর এবং রিমান্ড আবেদনে ফাইয়াজের কোন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার উল্লেখ নেই।
রিমান্ড আবেদনে মাসুদ রানার বয়স দেখানো হয়েছে ৩২ বছর, ইরফান ওরফে রোকনের ২৮ বছর, আবু বক্করের ২৩, রবিউল ইসলামের ১৮, সৌরভ মিয়ার ১৮, তারেক হোসেনের ১৮ বছর। ফাইয়াজ ছাড়া অন্য কাউকে শিশু দাবি করে তাদের আইনজীবী শুনানি করেননি।
শনিবার তাদের ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করেন ডেমরা জোনাল টিমের গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পরিদর্শক মু. মোরাদুল ইসলাম। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তাদের প্রত্যেকের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম শান্তা আক্তার ৭ দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, পুলিশ সদস্য নায়েক গিয়াস উদ্দিন (৫৮) গণভবনে ডিউটি দিতে যাওয়ার জন্য ১৯ জুলাই রাত ৯টার দিকে বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন। সে সময় কোটা সংস্কার আন্দোলন চলছিল। মোটরসাইকেলে করে যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ ফুটব্রিজের উত্তর পাশে পৌঁছানো মাত্র তার ওপর হামলা হয়।
“বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নেতারা তার পুলিশ পরিচয় নিশ্চিত হয়ে দেশের নাশকতা সৃষ্টির অংশ হিসেবে গিয়াস উদ্দিনকে আটক করে ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় গুরুতর কাটা রক্তাক্ত জখম করে। ভিকটিম পুলিশ সদস্য নায়েক গিয়াস উদ্দিন মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে রাস্তায় পড়ে গেলে এজাহারনামীয় আসামিগণসহ অজ্ঞাতনামা আসামিরা লোহার বহু লাঠি দিয়ে গিয়াস উদ্দিন এর নাক-কান মুখমণ্ডল, গলা ও হাত, বুক, পেট, পিঠ, ডান পায়ের হাঁটুর নিচে গোড়ালির নিচেসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি আঘাত করে ঘটনাস্থলে নির্মমভাবে হত্যা করে রশি দিয়ে ফুটব্রিজের সাথে ঝুলিয়ে রাখে।
“ভিকটিম পুলিশ সদস্য নায়েক গিয়াস উদ্দিনের মৃত্যুর পর মৃতদেহ নিয়ে উল্লেখিত আসামিরা ও অজ্ঞাতনামা আসামিরা পৈশাচিক আনন্দে মেতে ওঠে এবং গিয়াস উদ্দিনের মৃতদেহ গুম করার লক্ষ্যে উলঙ্গ করে মৃতদেহে আগুন লাগিয়ে পোড়ানোর চেষ্টা করে। পরে আসামিরা গিয়াস উদ্দিনের মৃতদেহ রাস্তার পাশে ফেলে রেখে তার মোটর সাইকেল নিয়ে চলে যায়।”
ওই ঘটনায় ২৪ জুলাই গিয়াস উদ্দিনের ভগ্নিপতি মো. ফজল প্রধান যাত্রাবাড়ী থানায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতানামা অনেককে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এরপর ২৪ জুলাই রাতে সাধারণ পোশাকের একদল লোক ফাইয়াজকে তাদের মাতুয়াইলের বাসা থেকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে নিয়ে যায় বলে তার পরিবারের ভাষ্য।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post