কখনো সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মদিনার মসজিদে নববীর ইমাম, কখনো দরবেশ বাবা।
এমন পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের নামে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিত প্রতারক চক্রটি। এসব অভিযোগে ১৯ প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সিআইডির প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া।
আলী মিয়া জানান, সিআইডির সাইবার পেট্রোলিং সেল (সিপিসি) দেশের সাইবার স্পেসে সংঘটিত যেকোনো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও আইনের আওতায় আনার জন্য সার্বক্ষণিক মনিটরিং করে থাকে। একই সেল সিপিসির ফেসবুক পেজ, হটলাইন নম্বর ও ই-মেইলের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে সাইবার সংক্রান্ত যেকোনো অভিযোগ গ্রহণ করে থাকে। পরবর্তী সময়ে ওইসব অভিযোগ সিপিসি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সিপিসি একটি প্রতারক চক্রের সন্ধান পায়। সিপিসি অনুসন্ধান করে জানতে পারে যে, প্রতারক চক্রটি একটি বিশেষ এলাকার- যারা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে অবস্থান ও প্রতারণা করে থাকে।
গ্রেপ্তারদের প্রতারণার বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান জানান, এই চক্রের সদস্যরা প্রতারণা করে দুটি ভিন্ন কৌশলে। প্রতারকরা দৈবচয়নের মাধ্যমে বা ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত কিংবা অর্থ-সম্পদশালী ব্যক্তিদের দারোয়ান বা ড্রাইভারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। তাদের কাছ থেকে টার্গেট পরিবারের গোপন তথ্য ও পারিবারিক সমস্যাগুলো কৌশলে জেনে নেয়। একই সঙ্গে বাড়ির মালিক ও তার স্ত্রীর মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে। এরপর শুরু করে প্রতারণা। স্ত্রীর কাছে স্বামীর এবং স্বামীর কাছে স্ত্রীর বদনাম বলে কান ভারী করা হয়। তখন উভয়ের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয় এবং প্রত্যেকে তাদের সমস্যা নিরসনের জন্য পথ খুঁজতে থাকেন। এই সুযোগে প্রতারকরা মসজিদে নববীর ইমামের নাম প্রয়োগ করে প্রতারণা শুরু করে।
দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চমকপ্রদ ও চোখধাঁধানো বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রলুব্ধ করা হয়। লটারি পাইয়ে দেওয়া, ভাগ্যবদল, পাওনা টাকা আদায়, মামলায় জেতানো, পারিবারিক সমস্যা সমাধানের কথা বলা হয় এসব বিজ্ঞাপনে। আধ্যাত্মিক ও তান্ত্রিক ক্ষমতা বলে বিপদগ্রস্ত মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে। এরপর বিজ্ঞাপনে থাকা মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করলে শুরু হয় পকেট কাটা।
এভাবেই চক্রটি পারিবারিক সমস্যা সমাধান করে দেওয়ার কথা বলে এক নারী ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ‘দরবেশ বাবা’ পরিচয়ে কয়েক ধাপে তার কাছ থেকে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়। দরবেশ বাবা পরিচয়দানকারী এই চক্রের ১৯ জন সদস্যকে মাগুরা ও ঢাকার কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে পৃথক অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়। খিলগাঁও থানায় করা একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এই চক্রের সন্ধান পায় সিআইডি।
প্রতারণার শিকার নারী পারিবারিক সমস্যা থাকায় মুক্তির পথ খুঁজছিলেন। এ অবস্থায় ফেসবুকে একটি বিজ্ঞাপন দেখে তার চোখ আটকে যায়। বিজ্ঞাপনে একজন সুদর্শন ব্যক্তি দরবেশ বেশধারী নিজেকে সৌদি আরবের মসজিদে নববীর ইমাম পরিচয় দিয়ে বলেছেন, তিনি কোরআন হাদিসের আলোকে মানুষের সমস্যা সমাধানে কাজ করেন।
বিজ্ঞাপনটি মন কাড়ে ওই নারী চিকিৎসকের। পরে বিজ্ঞাপনে দেওয়া মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করেন তিনি। অপরপ্রান্তে থাকা দরবেশ বাবা বেশধারী ব্যক্তি সুন্দরভাবে কথা বলে তার পারিবারিক সমস্যা শুনতে চান। ভুক্তভোগী চিকিৎসক তার পরিবারের সমস্যার কথা তুলে ধরেন কথিত দরবেশ বাবার কাছে। সমস্যার কথা শুনে দরবেশ তাকে বলেন, ‘মা তোমার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। বাবার ওপর আস্থা রাখো। তোমাকে মা বলে ডাকলাম। আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। তবে কিছু খরচ লাগবে। খরচের কথা কাউকে জানানো যাবে না। জানালে সমস্যার সমাধান তো হবেই না, বরং সমস্যা আরো বাড়বে এবং তোমার ছেলেমেয়ে ও স্বামীর ক্ষতি হবে।’ নারী চিকিৎসক ভণ্ড দরবেশের কথায় তার ভক্ত হয়ে যান।
এরপর থেকে বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন সময়ে অলৌকিক সমস্যার কথা বলে প্রলোভন ও ভয়ভীতির মাধ্যমে মোট ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় এই প্রতারক চক্র। পরবর্তী সময়ে এমএফএস নম্বরের সূত্র ধরে মাগুরা জেলা থেকে আশিকুর রহমান নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এটি একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এই চক্রের বিভিন্ন টেকনিক্যাল সাপোর্ট, বেনামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম এবং ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার কাজ করে সে। গ্রেপ্তার আশিকুরের দেওয়া তথ্য মতে, ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে কথিত দরবেশ পরিচয়দানকারী আরো ১৮ জন প্রতারককে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।
আসামিরা জিজ্ঞাসাবাদে সিআইডিকে জানিয়েছে, ২০২০-২১ সাল থেকে তারা এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। প্রথম দিকে তারা বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিত। পরে তারা পত্রিকা এবং বিভিন্ন চ্যানেলের পাশাপাশি ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতারণার বিজ্ঞাপন দিতে থাকে। ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ তাদের দেওয়া মোবাইল নাম্বারে ফোন দিলে সমস্যা সমাধানের নামে ভয়ভীতি ও নানা প্রলোভন দেখিয়ে এমএফএস নম্বরে টাকা হাতিয়ে নিত চক্রটি। আসামিদের কাছ থেকে প্রতারণার সঙ্গে জড়িত ৪১টি মোবাইল ফোন, বিপুলসংখ্যক সিম কার্ড ও ডিজিটাল আলামত উদ্ধার করেছে সিআইডি।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post