মরুভূমির উত্তপ্ত বালিতে দগ্ধ হচ্ছে অসংখ্য মানুষের জীবন। ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখে, ঝুঁকি নিয়ে মরুভূমিতে পাড়ি জমানো মানুষগুলোর অধিকাংশের ভাগ্যই হচ্ছে বেদনাদায়ক। কেউ ফিরছেন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে, কেউবা মরুভূমির বুকেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন।
২০১৬-২০২২ সাল পর্যন্ত ৭১৪ নারী শ্রমিকের মরদেহ দেশে ফেরত এসেছে। একই সময়ে নির্যাতিত হয়েছেন প্রায় ১০ হাজার নারী। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা রিক্রুটিং এজেন্সি আর দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা।
নিষ্প্রাণ বোবা চাহনি, মুখচ্ছবিতে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ফুটে উঠছে ভিন্ন ভিন্ন আবেগের বহি:প্রকাশ। হঠাৎ দেখলে মনে হবে মাথার ভেতর থাকা কোনো এক জটিল ধাঁধার সমাধানে ব্যস্ত হবিগঞ্জের খালেদা বেগম। বাস্তবতা হলো, ভাগ্য বদলের স্বপ্ন নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে ওমান পাড়ি দেয়া এই নারী এখন মানসিক ভারসাম্যহীন।
বিদেশি নিয়োগকর্তা ও তার পরিবারের সদস্যদের অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি এখন জীবন-মৃত। শরীরজুড়ে নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে বোধ বুদ্ধি হারিয়ে খালেদার ঠাঁই এখন রাজধানীর আশকোনায় ব্র্যাকের সেফ হোমের ৩২২ নম্বর কক্ষে। বাড়ির ঠিকানা, পরিবার, দিন-রাতের ব্যবধান বেমালুম ভুলে যাওয়া এই তরুণীর মস্তিষ্ক দখল করে আছে শুধু কয়েকটি নাম, আর বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতি। তিনি বলেন, পুড়ে মারতে চাইছে। দু-তিনবার চেষ্টা করেছে মারার জন্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেরুল বাড্ডার রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স অ্যারাবিয়ান গালফ অ্যাসোসিয়েটস কোম্পানি লিমিটেড গৃহকর্মী হিসেবে খালেদাকে ওমান পাঠায়। তার নিয়োগকর্তার নাম ওমানি ব্যক্তি মোহাম্মদ আলী মোহাম্মদ খাবির।
খালেদার বিষয়ে জানতে ওই রিক্রুটিং এজেন্সি অফিসে যায় সময় সংবাদ। অফিসে ঢুকতেই এজেন্সির হিসাব রক্ষক কর্মকর্তা পরিচয়ে একজন জানান খালেদা ইস্যুতে কথা বলবে কর্তৃপক্ষ। হন্তদন্ত হয়ে এসে শুরুতেই খালেদাকে অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠান ওমানে পাঠিয়েছে বলে দাবি করেন এজেন্সির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হাফিজা খাতুন। তবে ভুক্তভোগী খালেদার কাছে তার প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়ার কথা জানাতেই সুর পাল্টে ফেলেন হাফিজা।
তিনি বলেন, ‘এমন বয়স্ক নারীকে বাসার কাজেই কেউ রাখবে না। বিদেশ পাঠানো তো দূরের কথা।’ তার দাবি, তিনি এরাবিয়ান গালফের আমি কিছুই না। অথচ প্রতিষ্ঠানটির কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট লেখা ডিএমডি হাফিজ খাতুনের নাম।
শুধু এক খালেদা নয়, নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক নারী এখন দেশে ফেরত আসছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এজেন্সিগুলো দালালদের মাধ্যমে বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের ব্রেইন ওয়াশ করে তাদের সর্বস্বান্ত করছেন। মরুভূমির বালুতেই পুড়ছে তাদের জীবন। মানুষের দুঃসহ যন্ত্রণা আর মৃত্যুকে পুঁজি করে হচ্ছেন বিত্তশালী।
আরেক ভুক্তভোগী শাহনুর ইসলাম বলেন, ‘আমাকে বলেছে ১৫ দিন থেকে আপনার কাজ শুরু। সৌদির আদালতে দেখাশোনার কাজ। যাওয়ার পর দেখি কীসের সৌদি আদালত। যেখানে আমাদের রাখা হয়েছে মরুভূমির ভেতর। সেখানে মানুষ না খেয়ে রয়েছে।’
অভিবাসন কর্মীরা বলছেন, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা রিক্রুটিং এজেন্সি, মনিটরিংয়ের অভাব, কর্মীগ্রহণকারী দেশগুলোতে থাকা দূতাবাসের নিষ্ক্রিয়তা আর সেখানকার নিয়োগ কর্তাদের জবাবদিহিতা না থাকায় মধ্যপ্রাচ্যে মৃত্যু আর নির্যাতনের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
এ বিষয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থাপক আল আমিন নয়ন বলেন, ‘যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আওয়তায় আনা গেলে হয়তো এমন দুর্ভোগ কমে আসবে।’
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post