ইরানের সমর্থনে লোহিত সাগরে ইসরায়েলের জাহাজে হামলা চালানো অব্যাহত রেখেছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের হুমকি দিয়েছে। তবে এতে বন্ধ হয়নি হামলা।
আর এবার লোহিত সাগরে হুথিদের হামলার লাগাম টেনে ধরতে ইরানকে চাপ দিয়েছে চীন। আর সেটি না হলে বেইজিংয়ের সঙ্গে তেহরানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলেও জানানো হয়েছে। এর আগে হুথিদের হামলা বন্ধে ইরানকে রাজি করাতে চীনের দ্বারস্থ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লোহিত সাগরে হুথি বিদ্রোহীদের জাহাজে হামলার লাগাম টেনে ধরতে বা বেইজিংয়ের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্কের সম্ভাব্য ক্ষতির ঝুঁকি নিতে ইরানি কর্মকর্তাদের জানিয়ে দিয়েছেন চীনা কর্মকর্তারা। চারটি ইরানি সূত্র এবং বিষয়টি সম্পর্কে অবগত একজন কূটনীতিক একথা জানিয়েছেন।
রয়টার্স বলছে, লোহিত সাগরে একের পর এক জাহাজে হামলা এবং চীন ও ইরানের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে বেইজিং ও তেহরানে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে ইরানি সূত্রগুলো জানিয়েছে। তবে এসব বৈঠক কখন অনুষ্ঠিত হয়েছিল বা কারা তাতে অংশ নিয়েছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে অস্বীকার করেছে তারা।
বৈঠক ও সেখানে হওয়া আলোচনার বিষয়ে জানেন এমন এক ইরানি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে বলেছেন, ‘মূলত, চীন বলেছে: ‘আমাদের স্বার্থ যদি কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তা তেহরানের সঙ্গে আমাদের ব্যবসায় প্রভাব ফেলবে। তাই হুথিদের বলুন সংযত থাকতে।’
চীনের কর্মকর্তারা অবশ্য হুথি হামলায় বেইজিংয়ের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইরানের সাথে বেইজিংয়ের বাণিজ্যিক সম্পর্ক কীভাবে প্রভাবিত হতে পারে সে বিষয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট মন্তব্য বা হুমকি দেননি বলে চারটি ইরানি সূত্র জানিয়েছে।
গত এক দশক ধরে চীন ইরানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হলেও তাদের সেই বাণিজ্য সম্পর্ক একমুখী। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চীনা তেল শোধনাকারীরা গত বছর ইরানের অপরিশোধিত তেলের মোট রপ্তানির ৯০ শতাংশেরও বেশি কিনেছিল বলে ট্রেড অ্যানালিটিক্স ফার্ম কেপলারের ট্যাঙ্কার ট্র্যাকিং ডেটায় দেখা গেছে।
মূলত ব্যাপক মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্বজুড়ে অন্যান্য অনেক গ্রাহক ইরানের তেল কেনা থেকে দূরে ছিল এবং এতে করে চীনা সংস্থাগুলো বেশ বড় ডিসকাউন্টে ইরানি তেল কিনে লাভবান হয়। যদিও ইরানের তেল চীনের অপরিশোধিত আমদানির মাত্র ১০ শতাংশ পূরণ করতে পারে। এছাড়া বেইজিংয়ের সরবরাহকারীদের নেটওয়ার্ক বিশ্বের অন্য কোথাও থেকে ঘাটতি পূরণ করতে পারে।
ইরানি সূত্রগুলো জানিয়েছে, বেইজিং স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে- চীনের সঙ্গে যুক্ত কোনও জাহাজে হামলা করা হলে বা দেশের (চীনের) স্বার্থ কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তেহরানের প্রতি খুবই হতাশ হবে বেইজিং।
ইরানের একজন অভ্যন্তরীণ ব্যক্তি বলেছেন, চীন ইরানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হলেও তেহরান ইয়েমেনের হুথিদের পাশাপাশি গাজা, লেবানন, সিরিয়া এবং ইরাকেও প্রক্সি রেখে দিয়েছে এবং এর আঞ্চলিক জোট ও অগ্রাধিকারগুলো ইরানের সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে।
লোহিত সাগরে হামলা নিয়ে আলোচনার জন্য ইরানের সাথে বৈঠকের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে: ‘চীন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আন্তরিক বন্ধু এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং অভিন্ন উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি কামনা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
চীনা এই মন্ত্রণালয় রয়টার্সকে আরও জানিয়েছে, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে তাদের কৌশলগত স্বাধীনতা জোরদার করতে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা সমস্যা সমাধানে একত্রিত হতে ও একে অপরকে সহযোগিতা করাকে সমর্থন করি।’ তবে লোহিত সাগরে হুথিদের হামলা এবং তাদের লাগাম টেনে ধরতে চীনের চাপ সম্পর্কে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিকভাবে কোনও মন্তব্য করেনি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
প্রসঙ্গত, ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর থেকে গত প্রায় তিন মাস ধরে লোহিত সাগরে ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট ও ইসরায়েলগামী জাহাজে অব্যাহতভাবে হামলা চালিয়ে আসছে হুথি বিদ্রোহীরা। ইরান সমর্থিত সশস্ত্র এই গোষ্ঠী জানিয়েছে, যতদিন গাজায় ইসরায়েলের বর্বরতা চলবে ততদিন তারা হামলা চালিয়ে যাবে।
এর মাঝেই হুথিদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা জোটের হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনায় ব্যাপক উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। হুথিরা মূলত ইয়েমেনের শিয়া মুসলিম সংখ্যালঘু জাইদি নামের উপ-সম্প্রদায়ের সশস্ত্র গোষ্ঠী। বেশিরভাগ ইয়েমেনি হুথিদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় বসবাস করে। পাশাপাশি সানা এবং ইয়েমেনের উত্তরে হুথিরা লোহিত সাগরের উপকূলরেখাও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
এদিকে দফায় দফায় মার্কিন হামলা হুথিদের আক্রমণ বন্ধ করতে পারেনি বলে সম্প্রতি স্বীকার করে নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আর এরপরই হুথিদের হামলা বন্ধে ইরানকে রাজি করাতে যুক্তরাষ্ট্র চীনের দ্বারস্থ হয়েছে বলে খবর সামনে আসে।
মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে গত বুধবার ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস জানায়, লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলাকারী ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের লাগাম টেনে ধরতে তেহরানের প্রতি আহ্বান জানাতে চীনকে অনুরোধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত তিন মাসে চীনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে বারবার হুথিদের হামলা ও এ বিষয়ে ইরানকে আহ্বান জানানোর বিষয়টি উত্থাপন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এছাড়া হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান এবং তার ডেপুটি জন ফিনার চলতি মাসে ওয়াশিংটনে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিভাগের প্রধান লিউ জিয়ানচাওয়ের সাথে বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে পত্রিকাটি বলেছে। এমনকি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনও চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেছেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এদিকে বাণিজ্যিক জাহাজ লক্ষ্য করে হুথিদের এসব হামলার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে এর অনেক প্রভাব পড়েছে। লোহিত সাগর থেকে মিসরের সুয়েজ খাল হয়ে যেসব জাহাজ ইউরোপে যেত; সেসব জাহাজকে এখন আফ্রিকা ঘুরে যেতে হচ্ছে।
রয়টার্স বলছে, হুথিদের হামলা বিশ্বব্যাপী জাহাজ চলাচল ব্যাহত করেছে এবং বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা জাগিয়েছে। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের ফলে মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল হতে পারে বলেও উদ্বেগ রয়েছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন news@probashtime.com মেইলে।
Discussion about this post