বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের রাষ্ট্র হিসেবে প্রতি বছর বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশি পর্যটক, ব্যবসায়ী, অসুস্থ রোগীরা ভারতে ভ্রমণ করে থাকেন। ভারতের ব্যুরো অভ ইমিগ্রেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারতে পর্যটকদের ২০ শতাংশ ছিল বাংলাদেশ থেকে, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এছাড়াও ২০২২ সালে ৬১.২ লাখের ওপর বিদেশি পর্যটক ভারত ভ্রমণ করেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ১২ লাখ ৫৫ হাজার পর্যটক গেছে ভারতে।
এসব কারণ বিবেচনা করে এবার ভারতের সাথে ভ্রমণ চুক্তিতে উল্লেখযোগ্য সংশোধনী আনার প্রস্তাব করছে বাংলাদেশ। চুক্তিতে দুই দেশের নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করা হবে।
সুবিধাগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভ্রমণের ক্ষেত্রে যেকোনো চেকপোস্ট দিয়ে যাওয়া-আসার সুবিধাসহ ভিসা ইস্যুর প্রস্তাব করবে বাংলাদেশ। একইসাথে মেডিকেল ভিসার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা গ্রহণের সুবিধার্থে বহুভ্রমণ সুবিধা ও প্রয়োজনে হাসপাতাল পরিবর্তনের সুযোগ রাখার বিষয়টিও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হবে।
এর আগে বাংলাদেশ-ভারতের নাগরিকদের দুই দেশে যাতায়াতের জন্য ১৯৭২ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে একটি ভ্রমণ চুক্তি (ট্রাভেল এগ্রিমেন্ট) রয়েছে। এই চুক্তির আওতায় এক দেশ অপর দেশের নাগরিকদের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভিসা দিয়ে থাকে। ভিসার ধরন অনুযায়ী নাগরিকরা ভ্রমণ ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করেন। সর্বশেষ ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে এই চুক্তি করা হয়েছিল, যার মেয়াদ শেষ হয়েছে ১৫ জানুয়ারি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, আগামী এক মাসের মধ্যে নতুন ভ্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেজন্য বাংলাদেশের পক্ষে সুরক্ষা সেবা বিভাগ একটি প্রস্তাবনা তৈরি করেছে।
এ নিয়ে গত সোমবার ১৫ জানুয়ারি সুরক্ষা সেবা বিভাগ এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডেকেছিল। সেখানে এসব প্রস্তাবের ওপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের মতামত ও সুপারিশ নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, এরপর প্রস্তাব চূড়ান্ত করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতীয় পক্ষের মতামতের জন্য পাঠানো হবে। ভারতীয় পক্ষও তাদের প্রস্তাব থাকলে বাংলাদেশের মতামত নেবে। উভয় পক্ষের মতামতের পরে চুক্তিটি নবায়ন করা হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশি বা ভারতীয়রা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণের সময় ভিসায় উল্লেখ থাকে যে ভ্রমণকারী কোন চেকপোস্ট দিয়ে অন্য দেশে প্রবেশ করবেন বা ফিরে আসবেন। এতে অনেক সময় ভ্রমণকারীদের অসুবিধায় পড়তে হয়। এজন্য এবারের চুক্তিতে ভিসায় ‘ডেজিগনেটেড চেকপোস্ট’ তুলে দিয়ে ‘থ্রু এনি চেকপোস্ট’ কথাটি বসানোর প্রস্তাব করা হবে।
এ চুক্তির ফলে ভিসা পাওয়ার পর ভ্রমণকারী তার সুবিধা অনুযায়ী যেকোনো চেকপোস্ট বা রুট দিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে প্রবেশ করতে ও ফিরে আসতে পারবেন। এতে নির্দিষ্ট কয়েকটি চেকপোস্টে বাড়তি ভিড় কমবে। সেই বিবেচনায় এই প্রস্তাব করা হচ্ছে।
একইসাথে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার সময় মেডিকেল ভিসার ক্ষেত্রে এক ভিসায় বারবার যাওয়া-আসার সুবিধা এবং হাসপাতাল পরিবর্তন করার সুবিধা রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে।
এছাড়াও কূটনৈতিক ও অফিশিয়াল পাসপোর্টের ক্ষেত্রে বিনা ভিসায় অবস্থানের মেয়াদ ৯০ দিন করার প্রস্তাব করবে বাংলাদেশ যা আগে ছিলো ৪৫ দিন। পরবরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে এই প্রস্তাব করেছে। এছাড়াও স্বল্পমেয়াদি ডাবল এন্ট্রি ভিসার মেয়াদ ৩ মাস থেকে বাড়িয়ে ৬ মাস করার প্রস্তাবও করবে বাংলাদেশ।
এছাড়া রুট হিসেবে এবার নদীপথ যুক্ত করার প্রস্তাব করা হবে। এতদিন দুই দেশে ভ্রমণে রুট হিসেবে স্থল, আকাশ ও সমুদ্র (ল্যান্ড, এয়ার ও সি) উল্লেখ করা হয়েছে। এখন থেকে নদীও (রিভার) উল্লেখ থাকবে। সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে রিভার ক্রুজ চালু হওয়ার পর নদী রুট উল্লেখ করার এই ব্যবস্থা নেওয়া হলো।
ছয় মাসের বেশি অবস্থানের ক্ষেত্রে বর্তমানে ফরেনার রেজিস্ট্রেশন অফিস বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমতি নিতে হয়। নতুন চুক্তিতে এভাবে অনুমতি নেওয়ার পদ্ধতি বাদ দিয়ে এখন থেকে আগমনের ১৪ দিন আগে রেসিডেনশিয়াল পারমিটের জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করার প্রস্তাব করবে বাংলাদেশ। তবে লং-টার্ম মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা ও লং-টার্ম এমপ্লয়মেন্ট ভিসার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ভারতকে কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল ভিসা, স্বল্পমেয়াদি ডাবল এন্ট্রি ভিসা, দীর্ঘমেয়াদি মাল্টিপল এন্ট্রি ট্যুরিস্ট ভিসা, মেডিকেল ভিসা, লং-টার্ম এমপ্লয়মেন্ট ভিসা, বিনিয়োগকারী বা ব্যবসায়ীদের ভিসা, সাংবাদিকদের ভিসা, শিক্ষাগত বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত গবেষণা পণ্ডিত বা ফেলোদের জন্য ভিসা, শিক্ষার্থীদের জন্য ভিসা, ট্রানজিট ভিসা এবং ডাবল এন্ট্রি ভিসাসহ বিভিন্ন ভিসা দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ও ভারত ভ্রমণের জন্য কোনো ভিসা ফি নেই। এগুলোর বাইরে জরুরি প্রয়োজনে দুই দেশের নাগরিকদের জন্য সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে তাৎক্ষণিক ভিসার ব্যবস্থা রয়েছে। যদিও এ ধরনের ভিসা সাধারণত দুই দেশের কোনো পক্ষ বিশেষ ইস্যু করে না।
বাংলাদেশের প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো উভয় দেশের নাগরিকদের ভ্রমণ প্রক্রিয়াকে সহজতর এবং উন্নত করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post