মুদ্রা বিনিময় হার-সোনা সাধারণত মার্কিন ডলারে লেনদেন হয়। অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় মার্কিন ডলারের মূল্য বাড়লে স্বর্ণের দাম কমতে পারে। আর মার্কিন ডলারের মূল্য কমলে স্বর্ণের দাম বাড়বে। যখনই মানুষ ডলারের উপরে আস্থা হারায় তখন স্বর্ণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে স্বর্ণের দাম স্বভাবতই তখন বাড়ে। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার আমাদের অর্থনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব বিরাজ করছে। এই হুন্ডি যে শুধু টাকা পাচার তা কিন্তু নয়। স্বর্ণের বার পাচারের মাধ্যমেও অর্থ পাচার বা হুন্ডির অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করে অসাধু চক্র।
গণমাধ্যমে উঠে এসেছে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত স্বর্ণ ও হুন্ডি চোরাকারবারিদের নিরাপদ স্বর্গ। বেনাপোলের পেট্রাপোল-হরিদাসপুর সীমান্তের ৮ কিলোমিটার এলাকা ‘ফ্রি ক্রাইম জোন’ এলাকা ঘোষণার পরও থেমে নেই চোরাচালান। এ সীমান্ত দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ এবং করিডোর থাকায় চোরাকারবারিরা স্বর্ণ ও হুন্ডি পাচারের জন্য এ পথ ব্যবহার করছে। দীর্ঘদিন ধরেই বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে বৈধ-অবৈধ দু’ভাবেই ভারতে স্বর্ণ পাচার হচ্ছে। বিজিবি ও কাস্টমসের গোয়েন্দা বিভাগ স্বর্ণের একাধিক চালান আটক করলেও অল্প সময়ের মধ্যে জামিনে বেরিয়ে যায় চোরাচালানকারীরা।
তথ্য মতে, চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি থেকে ১৬ মে পর্যন্ত বেনাপোল সীমান্ত থেকে প্রায় ২৮ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে। একই সময়ে হুন্ডির প্রায় পৌনে ৪ কোটি টাকাও জব্দ করা হয়। আটক করা হয়েছে ২০ জনকে। এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বিভিন্ন কারনে দীর্ঘ সময় ও দীর্ঘ সূত্রিতার ফলে বিচার বিলম্বিত হয়। বিশ্লেষকরা বলছে,এ ধরনের মামলাগুলো দ্রুত নিম্পত্তি হলে প্রকৃত অপরাধীরা সাজা পেলে স্বর্ণ পাচার কমে গিয়ে দেশীয় অর্থনীতির চাকা চাঙা থাকবে।
সম্প্রতি ১৬ নভেম্বর, ২০২৩ তারিখ দেশের সীমান্তবর্তী জেলা যশোরে আলোচিত ঘটনায় ৭২ কেজি সোনা চোরাচালানের মামলায় তিনজনের মৃত্যুদণ্ড, ভারতীয় নাগরিকসহ দুজনের যাবজ্জীবন ও চারজনকে ১৪ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ ও রায় দিয়েছেন যশোরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ তৃতীয় আদালতের বিচারক মো. তাজুল ইসলাম। এদিন দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ছয় আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন যশোরের শার্শা উপজেলার শিকারপুর গ্রামের তোফাজ্জেল হোসেন তরফদারের ছেলে মহিউদ্দিন তরফদার, জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে জাহিদুল ইসলাম এবং নারিকেলবাড়িয়া গ্রামের আবদুস সাত্তারের ছেলে মুজিবুর রহমান।
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা হলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা শফিকুল মণ্ডল ওরফে নিধু এবং শার্শা উপজেলার মাসুদ রানা। ১৪ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন শার্শা উপজেলার আবদুল মোমিনের ছেলে ইমরান হোসেন, আবদুল কাদেরের ছেলে রুবেল হোসেন, রামচন্দ্রপুর গ্রামের নওশাদ আলীর ছেলে কবির হোসেন এবং মো. শফি। আলোচিত এ মামলাটিতে রায়ের পর্যবেক্ষণে আলোচনায় এসেছে-‘স্বর্ণ পাচারকারীরা দেশ ও জনগণের শত্রু’। দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট করতে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ প্রতিবছর যশোর বেনাপোল পোর্ট ও শার্শা এলাকার সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে পাচার হয় ফলে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ডলার সংকট এবং বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির অন্যতম কারণ তাই এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ভবিষ্যতে অন্যান্য চোরাকারবারিদের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি হবে’।
আলোচিত এই মামলাটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ হল ২০১৮ সালের ৯ আগস্ট রাতে শার্শার শিকারপুর বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারেন, এক দল চোরাকারবারি স্বর্ণ নিয়ে ভারতে যাবেন। এ তথ্যের ভিত্তিতে বিজিবি নারিকেলবাড়িয়া গ্রামের সীমান্ত পিলারের পাশে অবস্থান নেয়। রাত ১০টার দিকে কয়েকজন।নারিকেলবাড়িয়া মাঠের মধ্য দিয়ে ভারতের দিকে যাওয়ার সময় তাঁদের চ্যালেঞ্জ করে বিজিবি।
এ সময় মহিউদ্দিন নামের একজনকে আটক করা হয়। দুজন ব্যাগ ফেলে পালিয়ে যান। মহিউদ্দিনের কাছে থাকা ব্যাগ থেকে ২২৪টি স্বর্ণের বার ও ফেলে যাওয়া দুটি ব্যাগ থেকে ৪০০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। এসব স্বর্ণের বারের মোট ওজন ৭২ কেজি ৪৫০ গ্রাম। পরদিন শিকারপুর বিওপির বিজিবির হাবিলদার মুকুল হোসেন বাদী হয়ে তিনজনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে চোরাচালান দমন আইনে শার্শা থানায় মামলা করেন।মামলাটি প্রথমে থানা-পুলিশ ও পরে সিআইডি তদন্তের দায়িত্ব পায়। এ মামলার তদন্তকালে আটক আসামির দেয়া তথ্য ও সাক্ষীদের বক্তব্যে ৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। (তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো, ১৬ নভেম্বর, ২০২৩)।
সীমান্তবর্তী জেলা যশোরের দীর্ঘ ইতিহাসে এত বড় স্বর্ণ চোরাচালানের মামলা হয়তো বা আগে হয়নি। এটাই মনে হয় বড় ধরনের স্বর্ণ পাচার বা চোরাচালানের মামলা। এ মামলার রায় পর্যালোচনা এটাই সর্বমহলে প্রতিয়মান হয় যে, স্বর্ণ পাচারকারীরা এ মামলায় রায়ের মধ্যদিয়ে সতর্ক থাকবে ও এ ধরনের অপরাধ প্রবনতা কমতে পারে।
এছাড়াও, এ বছরের জুন মাসে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা মোহাম্মদ হোসাইন নামে এক যাত্রীর কাছ থেকে ৮২টি স্বর্ণের বার তথা এ সব বারের ওজন ৯ কেজি ৫৬৪ গ্রাম উদ্ধারে মামলা হয়। এ মামলায় আসামি মোহাম্মদ হোসাইনকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ১ বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন। এ মামলাটির রায় দেন অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ও স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-৮ এর বিচারক শরীফুল আলম ভূঁঞা।
এছাড়াও, স্বর্ণ চোরাচালান আরেক মামলায় মো. সোহেল (৩৩) নামে এক ব্যক্তির ৮ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বুধবার (১৭ জানুয়ারি, ২০১৮) চট্টগ্রামের সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. শাহে নূর এই রায় ঘোষণা করেন। একই রায়ে আসামিকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও তা অনাদায়ে আরও দুই মাসের দণ্ড দিয়েছেন আদালত।
চলতি বছরের ১৬ জুন কর্ণফুলী উপজেলায় পুলিশ চেকপোস্টে যাত্রীবাহী বাস থেকে সাড়ে ৯ কেজি ওজনের স্বর্ণের চালান জব্দ এবং ২ নারীসহ ৪ জনকে আটক করে পুলিশ। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে আসা স্বর্ণের চালান নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের দিকে যাচ্ছিলেন এই ৪ জন। এর একদিন পর স্বর্ণের মূল্য ও মান নিশ্চিত করে কর্ণফুলী থানায় এই ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। এ স্বর্ণ চোরাচালানের মামলায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চোরাচালান চক্রের ২ সদস্য স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এ স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের সাথে অসাধু কিছু স্বর্ণ ব্যবসায়ীও জড়িত বলে অনেকের মত। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) জানিয়েছে,
‘স্বর্ণ চোরাচালান জুয়েলারি শিল্পে বড় ধরনের সংকট ও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি দুর্নীতিকে উত্সাহিত করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকট বাড়াচ্ছে। বাজুসের ধারণা, প্রবাসী শ্রমিকদের রক্ত-ঘামে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অপব্যবহার করে সারাদেশের জল, স্থল ও আকাশপথে প্রতিদিন কমপক্ষে প্রায় ২০০ কোটি টাকার অবৈধ স্বর্ণালংকার ও স্বর্ণের বার চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসে। যা বার্ষিক হিসাবে দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা।’
দেশীয় অর্থনীতির বিরুপ প্রভাবের আরেকটি কারণ হচ্ছে স্বর্ণ পাচার কিংবা চোরাচালান। দেশীয় অর্থনীতির রিজার্ভের নিম্নগামীতা স্বর্ণ চোরাচালানের প্রভাব অনেকাংশে দায়ী। আমাদের দেশ এখন উন্নয়নে ঊর্ধ্বগামী। ডিজিটাল থেকে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন পূরণে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তাই দেশীয় অর্থনীতির চাকা সচল ও অর্থনীতিতে রিজার্ভের উন্নয়নে স্বর্ণ পাচার ও চোরাচালান বন্ধে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধি করা একান্ত জরুরি।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post