মালয়েশিয়ায় দুর্বিষহ দিন পার করছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। এই তথ্য দেশটির সরকারের কাছে থাকা সত্ত্বেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে গড়িমসি করায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। গত বুধবার (২৫ অক্টোবর) কর্মীদের দুরবস্থা এবং কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করার বিষয়টি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন এশিয়ায় অভিবাসী শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্রিটিশ অ্যাক্টিভিস্ট অ্যান্ডি হল। সোমবার (৩০ অক্টোবর) সকালে গণমাধ্যমকে তিনি নিজেই এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
অ্যান্ডি হল সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের (ইউএনএইচআরসি) আওতাধীন সংস্থা ওএইচসিএইচআরকে চিঠি লিখেছেন, সেখানে তিনি কর্মীদের পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ বলে উল্লেখ করেছেন। চিঠিতে তিনি সংকীর্ণ থাকার জায়গা, দুর্বল স্যানিটেশন, সীমিত খাদ্য এবং গত ১৮ মাস বা তারও বেশি সময় ধরে অতিরিক্ত নিয়োগ ব্যয়ের কারণে কীভাবে তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন।
তিনি শ্রমদাসত্ব, মানবপাচার, অভিবাসী, দারিদ্র্য এবং ব্যবসা ও মানবাধিকার সম্পর্কিত ওয়ার্কিং গ্রুপ এবং এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অভিবাসন ও মানবাধিকার বিষয়ক সিনিয়র উপদেষ্টা পিয়া ওবেরয়ের কাছেও অভিযোগগুলো পাঠিয়েছেন বলে জানান। অভিযোগের সঙ্গে তিনি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের দুরবস্থার সচিত্র প্রমাণ, মালয়েশিয়া সরকারের কর্মী নিয়ে সংকটের স্বীকারোক্তিগুলোও পাঠিয়েছেন। তিনি মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার এবং তার কার্যালয়কে অনুরোধ করেছেন বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কর্মীদের কেস স্টাডি এবং মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের রেফারেন্সসহ ইউএনএইচআরসিকে মালয়েশিয়ার পরিস্থিতি সমাধানের জন্য ওএইচসিএইচআর-এর বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগ করার জন্য অবিলম্বে অনুরোধ জানিয়েছি।’
এর আগে অ্যান্ডি হল মালয়েশিয়ায় অভিবাসী কর্মীদের সংকট নিয়ে একাধিকবার লেখালেখি করেন। তার লেখার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিক পরিস্থিতি তুলে ধরে মালয়েশিয়া সরকারের মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়। তার প্রতিবেদনের জবাবে মালয়েশিয়া মন্ত্রণালয় জানায়, সংকট নিরসনে তারা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা স্বীকার করেন যে কর্মীদের পারমিট শিথিলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই তার অপব্যবহার করেছে।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুশন বলেছেন, অভিবাসী কর্মী নিয়োগের নিয়ম শিথিল করা এবং পুনর্বিন্যাস অনুশীলনের ফলে উৎপাদন ও পরিষেবা খাতে নির্ধারিত কোটার বিপরীতে অতিরিক্ত আড়াই লাখেরও বেশি বিদেশি কর্মী রয়ে গেছে।
মালয়েশিয়া সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে আড়াই লাখ অতিরিক্ত কর্মী অবস্থান করছে। মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, যে পরিমাণ কর্মী নির্দিষ্ট পাঁচটি খাতে প্রয়োজন ছিল, তার তুলনায় এই সংখ্যা বেশ বড়। বিশেষ করে সেবা খাতে অতিরিক্ত কর্মী এসে পড়েছেন। ধারণা করা হয়েছিল সেবা খাতে ২০ হাজার বিদেশি কর্মী আসবে, কিন্তু কর্মী এসেছে ১ লাখ ৪২ হাজারেরও বেশি। এছাড়া ফ্যাক্টরির কাজে ৫০ হাজার কর্মী আসার কথা ছিল, কিন্তু সেখানে দেখা গেছে প্রায় ২ লাখ কর্মী মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করেছে। অথচ অন্যান্য খাতে যেখানে ৫০ হাজার কর্মী আসার কথা ছিল, সেখানে এসেছে প্রায় অর্ধেক।
মাগুরার মোহাম্মদ জনি (ছদ্মনাম) গত আগস্টে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে কাজের উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়ায় যান। দালাল আফজাল তাকে বলেছিল—মালয়েশিয়ায় অনেক সুযোগ সুবিধা, ফ্যাক্টরিতে কাজ দেবে। কিন্তু বাস্তবে এমন কিছুই হয়নি। জনিসহ আরও ৪৫ জন দেশটিতে গেছেন। কয়েক মাস ধরে কাজ ছাড়া দুর্বিষহ জীবন পার করছেন। সেন্ট্রাল কুয়ালালামপুরের চউকিত এলাকার একটি হোস্টেলে তাদের মতো আরও ৪০০ কর্মী আছেন, যাদের কাজ নেই। তাদের কারও কাছে পাসপোর্টও নেই, সেগুলো নিয়ে গেছে এজেন্টরা।
জনি জানান, ‘এখানে যদি কাজের কথা জানতে চাই, তাহলে এজেন্সির সঙ্গে কথা বলতে বলে। এজেন্সির সঙ্গে কথা বললে বলে পাসপোর্ট দিয়ে দিবে। পাসপোর্ট চাইলে বলে সাড়ে ৬ হাজার রিঙ্গিত লাগবে। এ কথা এজেন্সিকে জানালে তারা বলে–এত টাকা লাগবে না। এরপর আর এজেন্সি কোনও যোগাযোগ করে না।’
জনির মতো আরও ১৪ জনের একটি গ্রুপ সেখানে ছিলেন। তবে সংবাদ প্রকাশের পর তাদের ১৪ জনকে অন্য একটি এলাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। সেই গ্রুপের চার জন একটি কন্সট্রাকশন কোম্পানিতে কাজে যোগ দিয়েছেন। তবে সেই কোম্পানিতে কাজের প্রয়োজনে সুরক্ষা সামগ্রীর জন্য ৫০ রিঙ্গিত করে পরিশোধ করতে হয়েছে কর্মীদের।
হোস্টেলে থাকা বাংলাদেশিরা জানান, তাদের অবস্থা খুব শোচনীয়। খাবারের কষ্ট, অর্থকষ্ট সব মিলিয়ে পেরে উঠছেন না কেউ। দেশ থেকে টাকা এনে চলতে গিয়ে অতিরিক্ত ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন অনেকেই।
অ্যান্ডি হল বলেন, একটি রুমে প্রায় ১৪ জন শ্রমিক অবস্থান করছেন। আমি ভিডিও পেয়েছি। যে এজেন্টরা তাদের এখানে নিয়ে এসেছিল তারা প্রত্যেককে ২০০ রিঙ্গিত দিয়েছিল, যা তারা খাবার কেনার জন্য ব্যবহার করছে। কিন্তু এটি তাদের বেশি দিন স্থায়ী হবে না। কর্মীদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে শ্রমিকদের তাদের পুরো মজুরি পাওয়া উচিত এবং তাদের অন্যান্য সহায়তা দেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, যথাযথ কাগজপত্র না থাকায় শ্রমিকরা আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছেন, যার ফলে প্রয়োজনীয় সেবা গ্রহণের জন্য বাইরে বের হওয়া তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। দালাল, নিয়োগকর্তা এবং মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের এই অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া অগ্রহণযোগ্য।
এ নিয়ে যোগাযোগ করেও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ‘আমাদের কাছে বেশ কিছু অভিযোগ এসেছে।’
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post