পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে জমি-জিরেত বিক্রি করে, কখনো বা ঋণ করে প্রিয়জন ছেড়ে হাজার মাইল দূরে বিদেশভূমে প্রতিদিন পাড়ি জমান দেশের অসংখ্য মানুষ। বিদেশে থেকে তাদের পাঠানো অর্থে চাঙ্গা হয় দেশের অর্থনীতি। এ কারণে রেমিট্যান্স যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত তারা। এ প্রবাসী যোদ্ধাদেরই অনেকে চাকরি শেষে বা ছুটিতে দেশে ফিরে বিমানবন্দর এলাকা পার হয়েই ভয়ানক প্রতারণার শিকার হন। প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারান তারা। আর প্রিয়জন দেশে ফেরার আনন্দের পরিবর্তে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নেমে আসে দুঃখ-দুর্দশা।
যখন বিমানবন্দরের নিরাপত্তাবলয় পেরিয়ে বাইরের রাস্তায় ওঠেন তখনই তাদের টার্গেট করে অজ্ঞান পার্টি ও মলমপার্টি নামের দুর্বৃত্ত চক্র। কঠোর পরিশ্রমের অর্থে মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানসহ অন্যান্য প্রিয়জনের জন্য বিদেশ থেকে নিয়ে আসা স্বর্ণালংকারসহ তাদের বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী কৌশলে হাতিয়ে নেয় চক্রটি। এ ক্ষেত্রে তারা কখনো সখ্য গড়ে তোলে চেতনানাশক মেশানো খাবার খাইয়ে অজ্ঞান করে তাদের শিকারকে। আবার কখনো অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে কেড়ে নেয় সর্বস্ব। শুধু তাই নয়, অজ্ঞান করে ফেলে দেওয়া হয় ব্রিজের নিচে, ঝোপ-জঙ্গলে অথবা রাস্তায়। এমনকি কখনো কখনো এই চক্রের হাতে মৃত্যু পর্যন্ত হয় কোনো কোনো রেমিট্যান্স যোদ্ধার। ভুক্তভোগীদের স্বজনদের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথাযথ তৎপরতা না থাকায় অহরহই ঘটছে এমন ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, শুধু একটি চক্রই গত ১৫ বছরে ৩০০ প্রবাসীর সর্বস্ব লুটে নিয়েছে। প্রবাসীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ, পুলিশ সদস্যরাও রেহাই পায়নি তাদের হাত থেকে। আর প্রবাসীদের জিনিসপত্র হাতিয়ে নিতে বিমানবন্দর বাসস্ট্যান্ড, বিমানবন্দর রেলস্টেশনকেই টার্গেট করে এ চক্র। এ ছাড়াও মহানগরীর গুলিস্তান, গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশন, লঞ্চ টার্মিনালসহ জনাকীর্ণ এলাকায় পথচারী ও যাত্রীদের অজ্ঞান করে সর্বস্ব হাতিয়ে নিচ্ছে তারা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, কখনো বাস হেল্পারের সহযোগিতায়, আবার কখনো যাত্রীবেশে কাছে বসেই প্রবাসীদের সব কেড়ে নিচ্ছে অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়, ভুক্তভোগীরা অভিযোগ না করায় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ারও তেমন সুযোগ থাকে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতার অভাবেই অজ্ঞানপার্টির খপ্পর থেকে রেহাই পাচ্ছেন না প্রবাসীরা। সরল বিশ্বাসে বাসে অন্যের দেওয়া চেতনানাশক মেশানো খাবার খেয়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন প্রবাসীরা। যারা এত পথ পাড়ি দিয়ে দেশে আসেন, তাদের আরও সচেতন হওয়া জরুরি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ জন মানুষ অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়ে সেখানে চিকিৎসার জন্য যায়। এদের অনেকেই দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগেন।
শুক্রবার বিকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় বাসে অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়েন ওমান প্রবাসী আবদুর রহমান (৪৫)। পুরান ঢাকার ধোলাইপাড় এলাকা থেকে তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা লাইনম্যান বাবুল জানান, ওই ব্যক্তি বিমানবন্দর বাসস্ট্যান্ড থেকে সায়েদাবাদের উদ্দেশে তুরাগ পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন। বাসটি টঙ্গী-যাত্রাবাড়ী রুটে চলে। তিনি মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার বাসিন্দা। তিনি বাসের মধ্যে অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়েন। পরে বাসের হেল্পার-কন্ডাক্টর তাকে একটি ব্যাগসহ ধোলাইপাড় সড়কে মেট্রো ফিলিং স্টেশনের পাশে নামিয়ে রেখে যায়। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার কাছে একটি ব্যাগ ও পাসপোর্ট পাওয়া গেছে।
এর ৩ ঘণ্টা না পেরোতেই রাজধানীর টিকাটুলি এলাকায় অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা খুইয়েছেন এবাদুল মিয়া (৫৫) নামে এক ব্যক্তি। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে টিকাটুলির অভিসার সিনেমা হলের পাশ থেকে তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করেন স্বজনরা। পরে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয় এবাদুলকে। চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি সৌদি আরব থেকে স্ত্রীর জন্য স্বর্ণালংকারের পাশাপাশি মা ও পরিবারের জন্যও উপহার নিয়ে এসেছিলেন প্রবাসী জাহিদুল ইসলাম (২৮)। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ ইউনিয়নের ভদ্রপাড়া গ্রামে যাওয়ার পথে অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারান তিনি। প্রায় ১৪ ঘণ্টা অচেতন থাকার পর তার জ্ঞান ফিরে দেখেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিছানায় শুয়ে আছেন। পাশেই ছিলেন স্বজনরা।
জ্ঞান ফিরলে জানান, বগুড়ায় যাওয়ার জন্য ওই দিন দুপুর ১২টায় ঢাকার উত্তরায় শাহ ফতেহ আলী নামের একটি বাসে ওঠেন। প্রায় আড়াই বছর সৌদি আরবে গাড়িচালক হিসেবে চাকরি করে ছুটি নিয়ে তিনি দেশে ফিরছিলেন। আসার সময় স্ত্রীর জন্য স্বর্ণের অলংকার আর দুটি মোবাইল ফোন সেট এবং মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য নতুন জামাকাপড় কেনেন। নগদ টাকাসহ তিনটি বড় ব্যাগে তার প্রায় ৩ লাখ টাকার জিনিস ছিল। অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়ে তিনি সর্বস্ব খুইয়েছেন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার কমান্ডার আল মঈন গণমাধ্যমকে বলেন, অজ্ঞানপার্টির চক্রের হোতা আমির ও তার সদস্যরা ১৫ বছরে ৩ শতাধিক প্রবাসীর সর্বস্ব লুটে নিয়েছে। চক্রটি বিমানবন্দরে টার্গেট করে আলাপের মাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। তারপর সুযোগ বুঝে খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়ে অজ্ঞান করে। এরপরই ভুক্তভোগীর সব মালামাল লুট করে চম্পট দেয়। গত বছর আমিরসহ চারজনকে গ্রেফতারের পর তারা অজ্ঞানপার্টির অন্য সদস্যদের বিষয়ে তথ্য দেয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে ভয়ংকর তথ্য। আমির একাধিকবার গ্রেফতার হলেও জামিনে বেরিয়ে একই কাজ করে। তার টার্গেট প্রবাসীদের সর্বস্বান্ত করা। কারণ বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের লাগেজে থাকে মূল্যবান জিনিসপত্র। এ জন্যই তাদের মূল টার্গেট প্রবাসীদের।
তিনি আরও জানান, এসএসসি পাস করা আমির হোসেন বিমানবন্দর এলাকার একটি ফাস্টফুডের দোকানে চাকরি করত। ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে এক পর্যায়ে সে বিদেশ ফেরত যাত্রীর ছদ্মবেশ ধরে গত ১৫ বছর ধরে অজ্ঞানপার্টির চক্রটি পরিচালনা করে আসছে। এ সময়ে চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে অন্তত ৩০০ বিদেশ ফেরত প্রবাসীকে অজ্ঞান করে তাদের কাছ থেকে মূল্যবান মালামাল ও সম্পদ লুট করেছে সে। আমির হোসেনের বিরুদ্ধে শুধু অজ্ঞান ও মলম পার্টি-সংক্রান্ত মামলাই রয়েছে ১৫টির বেশি। কমান্ডার আল মঈন বলেন, বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের টার্গেট করে বিমানবন্দরের টার্মিনালে পাসপোর্ট ও লাগেজ নিয়ে প্রবাস ফেরত যাত্রীর ছদ্মবেশ ধারণ করে চক্রের সদস্যরা। এটি মূলত তাদের একটি কৌশল।
এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক গণমাধ্যমকে বলেন, ডিএমপির সব থানায় সার্বক্ষণিক পুলিশের তৎপরতা থাকার পরও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করলে চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। তারা কারাবাসের পর বাইরে এসে ফের সংগঠিত হচ্ছে। তবু আমাদের পক্ষ থেকে সর্বাধিকভাবে সতর্ক করা আছে। অজ্ঞানপার্টি বা মলমপার্টি, ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে জিরো ট্রলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অজ্ঞানপার্টি বেপরোয়াভাবে বেড়েছে। তাদের প্রধান টার্গেট থাকে বিদেশ ফেরত যাত্রীরা। দ্বিতীয় সারিতে থাকে সাধারণ যাত্রী। বিভিন্ন স্থানে ছদ্মবেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে এই চক্রের সদস্যরা। এদের হাত থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই। ঝামেলা এড়াতে ভুক্তভোগীদের অনেকে মামলা করে না। আবার মামলা বা গ্রেফতার হলেও স্বল্প সাজা ও জামিনে বের হয়ে যায়। এসব প্রতারণায় আইন কঠোর হওয়া উচিত। তা হলে এ ধরনের অপরাধ অনেকটা কমে যেত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঝিমিয়ে যাওয়ায় অজ্ঞানপার্টির তৎপরতা বেড়ে গেছে। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সজাগ থাকা দরকার।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post