বিমানবন্দরে ঢাকা কাস্টম হাউজের গুদাম থেকে প্রায় ৫৫ কোটি টাকার সোনার বার ও অলংকার চুরির পর অবশেষে টনক নড়েছে কর্তৃপক্ষের। এরই মধ্যে গুদামের সামনে ও চারপাশে বসানো হয়েছে ১২টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসি ক্যামেরা)। ওই গুদাম নজরদারির আওতায় আনতে অত্যাধুনিক আরও ২০৮টি সিসি ক্যামেরা বসাচ্ছে কাস্টম কর্তৃপক্ষ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে এগুলোর জন্য বরাদ্দও মিলেছে। সিসি ক্যামেরাগুলো বসলে ঢাকা কাস্টম হাউজের গুদামটি পূর্ণ নজরদারির আওতায় আসবে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা।
কেপিআইভুক্ত এলাকা হওয়ায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা যথেষ্ট কঠোর। সেখানে ঢাকা কাস্টম হাউজের সংরক্ষিত গুদামটি আরও সংবেদনশীল এলাকা। সেখান থেকেই ৫৫ কেজি ৫১০ গ্রাম সোনা উধাওয়ের ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই আলোড়ন ফেলে। এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে গিয়েই ধরা পড়ে, সোনাসহ মূল্যবান সব জিনিসপত্র সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হলেও এই গুদাম নজরদারির জন্য নেই পর্যাপ্ত পরিমাণে সিসি ক্যামেরা। যেগুলো আছে, সেগুলোও প্রায় অকেজো।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের সেবা দিতে দিন-রাত চারটি শিফটে তাদের জনবল কাজ করে থাকে। বিমানবন্দরে যাত্রীদের ব্যাগেজ সুবিধাসহ রাজস্ব আদায়েও কাজ করে সংস্থাটি। এরকম একটি এলাকায় থাকা কাস্টমসের গুদাম থেকে কীভাবে ৫৫ কেজির বেশি সোনা গায়েব হয়ে গেল, তা খুঁজতে গিয়েই ধরা পড়ে নজরদারির নাজুক অবস্থা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০০৫ সালে প্রথম শাহজালাল বিমানবন্দরের কাস্টম জোনে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়। এরপর ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল দরপত্রের মাধ্যমে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাস্টম গ্রিন চ্যানেল ঘিরে ৭৩টি সিসি ক্যামেরা যুক্ত করা হয়। সেই সময়ে দেড় কোটি টাকা খরচ করে তখনকার সবচেয়ে অত্যাধুনিক ক্যামেরাই বসানো হয়েছিল এই স্থাপনার জন্য। তবে এরপর আর শাহজালাল বিমানবন্দরের ভেতরে কাস্টমস গ্রিন চ্যানেলে নতুন কোনো সিসি ক্যামেরা বসানো হয়নি। সিসি ক্যামেরা কোনোটি নষ্ট হলে কেবল মেরামত করা হয়েছে। বর্তমানে এই কাস্টম জোনে রয়েছে ৩০টির মতো সিসি ক্যামেরা। তবে এর একটির ছবিও স্পষ্ট নয়। ফলে এই সিসি ক্যামেরাগুলোও কোনো কাজে আসে না। বলা যায়, এই সিসি ক্যামেরাগুলো থাকা আর না থাকা সমান কথা।
এদিকে ২০২২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিমানবন্দরের কাস্টমসের গ্রিন চ্যানেলে পরিদর্শন করেন। তখন বিমানবন্দরে কাস্টমসের সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও কাস্টমস হল অবকাঠামো উন্নয়নে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। বলা হয় ভিডিও রেকর্ডিং সুবিধা নিশ্চিত করতে। এরপর তখন কাস্টমস হল ও গ্রিন চ্যানেলের কোথায় কোথায় সিসি ক্যামেরা বসানো হবে, তা নির্ধারণ করা হয়। এর জন্য খরচও প্রাক্কলন করা হয়।
ওই সময় হিসাব করে ঢাকা কাস্টম হাউজ কর্তৃপক্ষ জানায়, বিমানবন্দরে কাস্টমের পুরো গ্রিন চ্যানেল ঘিরে অত্যাধুনিক ৯৬টি সিসি ক্যামেরা প্রয়োজন। এ ছাড়া কাস্টম হাউজের কুরিয়ার ইউনিটে ৮০টি এবং রফতানি কার্গো এলাকায় আরও ৩২টি সিসি ক্যামেরা প্রয়োজন। সব মিলিয়ে এনবিআরের কাছে ২০৮টি সিসি ক্যামেরা বসানোর চাহিদার কথা জানায় কাস্টম কর্তৃপক্ষ। অর্থ বরাদ্দ চেয়ে চিঠিও দেওয়া হয়। এনবিআর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ঢাকা কাস্টম হাউজের জন্য বরাদ্দ মঞ্জুর করা হয়।
ঢাকা কাস্টম হাউজের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বরাদ্দ মঞ্জুর হলেও সিসি ক্যামেরা তখন বসানো যায়নি। কারণ ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় এক আদেশে বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতির কথা জানায়। ওই নীতির কারণেই বরাদ্দ মঞ্জুর হলেও অর্থ ছাড় না হওয়ায় বিমানবন্দরে কাস্টমসের ওই গুদামে সিসি ক্যামেরা বসানো সম্ভব হয়নি।
কাস্টম হাউজ সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই আদেশ সত্ত্বেও গত ২২ জানুয়ারি সিসি ক্যামেরার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে ফের এনবিআর চেয়াম্যান ও সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিঠি দেয় কাস্টম হাউজ কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে সিসি ক্যামেরার জন্য আগে বরাদ্দ অর্থের পাশাপাশি আরও প্রয়োজনীয় অর্থ চেয়ে পুনঃবরাদ্দের আবেদন জানানো হয়। বলা হয়, শাহজালাল বিমানবন্দরের কাস্টম জোনে সিসি ক্যামেরার মান খুবই খারাপ হয়ে যাওয়ায় ভিডিও রেকর্ডিংয়ের পাশাপাশি অডিও রেকর্ডিং সুবিধা নিশ্চিতের জন্য বরাদ্দ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কাস্টমস ও এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কাস্টমসের সিসি ক্যামেরার জন্য চাওয়া বরাদ্দ চলতি বাজেটে অর্ন্তভুক্ত করে এনবিআর। এরপর ঢাকা কাস্টম হাউজ কর্তৃপক্ষ কাস্টমসের সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও ক্রয় সংক্রান্ত কমিটি গঠন করে। সেই কমিটিকে আরএফপি (রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল) প্রণয়ন করতে বলা হয়। এসব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই ৫৫ কোটি টাকার সোনা খোয়া গেল ওই গুদাম থেকে। এর পরপরই অবশ্য গুদামের সামনে ও চারপাশে নতুন করে ১২টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। আর ২০৮টি সিসি ক্যামেরা বসানোর সেই উদ্যোগও গতি পেয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা কাস্টম হাউজের কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা আজাদ বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরে কাস্টম কর্তৃপক্ষ নিরবচ্ছিন্নভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি সোনা নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, তা দুঃখজনক। তবে আমরা নিরাপত্তা ও নজরদারি বাড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। যেখানে যতটুকু ঘাটতি ছিল, সব পূরণ করা হবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post