হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টম হাউসের লকার রুমের ভল্ট থেকে ৫৫ কেজি স্বর্ণ চুরির ঘটনায় এক রাঘববোয়াল উঠে এসেছে। তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (কাস্টমস) প্রভাবশালী সদস্য। তার নাম মাসুদ সাদিক। তার ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকে বিমানবন্দরের কাস্টম হাউসে বিভিন্ন অপকর্ম করে আসছিলেন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম শাহেদ। এনবিআর কর্মকর্তা মাসুদ সাদিকের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বিমানবন্দর কাস্টম হাউসে একের পর এক অপকর্ম করে আসছিলেন তিনি। কাস্টমসের ৫৫ কেজি স্বর্ণ চুরির পর এমন অভিযোগ উঠে আসে। স্বর্ণ চুরির মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও কাস্টমস সূত্রে এসব তথ্য উঠে আসছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বর্ণ চুরির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর মাসুদ সাদিকের পরামর্শে দেড় কেজি স্বর্ণ ভল্টে রাখেন শাহেদ ও তার সহযোগীরা। ডিবির হেফাজতে থাকা চারজন রাজস্ব কর্মকর্তা ও চারজন সিপাহিকে জিজ্ঞাসাবাদে মাসুদ সাদিকসহ আরও অনেক রাঘববোয়ালের নাম বেরিয়ে আসছে। বৃহস্পতিবার নিজ কার্যালয়ে ডিবির প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, স্বর্ণ চুরির ঘটনায় যত বড় কর্মকর্তাই জড়িত থাকুক না কেন তাকে আইনের আওতায় এনে গ্রেফতার করা হবে।
এদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টম হাউসের লকার রুমের ভল্ট থেকে ৫৫ কেজি স্বর্ণ চুরির পর নিরাপত্তায় আমূল পরিবর্তন আনা হয় ঢাকা কাস্টম হাউসে। প্রথম শ্রেণির কেপিআইভুক্ত স্পর্শকাতর নিরাপত্তা থাকলেও সেই ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। বুধবার ঢাকা কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার মিনহাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে এখন থেকে পরিচালিত হবে কাস্টমসের লকার (গুদাম)। চার শিফটে কাস্টমসের দুই ডিসি ও দুই এসি এ নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবেন। তারা শুল্ক গুদামে পণ্য রক্ষণাবেক্ষণ ও গুদাম ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করবেন।
এক দাফতরিক আদেশে বলা হয়, যাদের শিফট পরিবর্তন হবে তাদের দেহ তল্লাশি করে বিমানবন্দরের কাস্টম হাউস ত্যাগ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নিজেদের আটক করা স্বর্ণ বা স্বর্ণালঙ্কার লকারে রাখার পর পরবর্তী শিফটের কর্মকর্তাকে বুঝিয়ে দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একই সঙ্গে যাদের শিফট শুরু হবে তারা লকার চেক করে দায়িত্ব বুঝে নেবেন। চোরাই স্বর্ণ আটক করার পর এবং বাজেয়াপ্ত স্বর্ণ ৭ কর্মদিবসের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হবে।
অপরদিকে স্বর্ণ চুরির ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও এক সিপাহিকে হেফাজতে নেওয়ার পাঁচ দিনেও তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়নি। তাদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও মামলার নতুন তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
তবে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আজ শুক্রবার বা আগামীকাল শনিবারের মধ্যেই তাদের গ্রেফতার দেখানো হতে পারে। চাঞ্চল্যকর এ স্বর্ণ চুরির মূল হোতা সম্পর্কে তথ্য পেতে কাজ করছে গোয়েন্দারা। জড়িতদের চিহ্নিত করতে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ পর্যালোচনা ছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তি এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে কোনো সিসি ক্যামেরার ফুটেজ গায়েব করা হয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক আটজন এখনও ডিবি হেফাজতে রয়েছে। এদের মধ্যে চারজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও বাকি চারজন সিপাহি। আগে যারা কাস্টমসের গুদামে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানা গেছে। তবে এখনও অভিযুক্ত কেউ চুরির দায় স্বীকার করেনি।
ডিবি সূত্র বলছে, স্বর্ণ চুরির ঘটনায় সন্দেহের তালিকায় যে চক্রটি রয়েছে ইতিমধ্যে তাদের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে ডিবি। চুরির আগে পরে একাধিকবার তারা বিমানবন্দর এলাকা ও এর বাইরে মিলিত হয়েছে। তাদের মোবাইল ফোনের অবস্থান থেকে এই তথ্য নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দারা। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, কাস্টম হাউসের গুদামের নিরাপত্তা বলয় খুবই শক্তিশালী। সেখান থেকে চুরি করা এত সহজ নয়। এ চুরির সঙ্গে কাস্টম হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তভার পাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে কথা বলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, অপরাধ তো অপরাধই। চুরির ঘটনায় যত বড় কর্মকর্তাই জড়িত থাকুক না কেন তাকে আইনের আওতায় এনে গ্রেফতার করা হবে। আগেও ডিবি কাউকে ছাড় দেয়নি, ভবিষ্যতেও দেবে না। হারুন অর রশীদ বলেন, মামলার দায়িত্ব পাওয়ার পর বিমানবন্দরের ঢাকা কাস্টম হাউসের গুদামে দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেছি, অর্থাৎ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আটজনকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এর মধ্যে চারজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চারজন সিপাহি।
ডিবিপ্রধান আরও বলেন, বিমানবন্দরের মতো একটা জায়গা যেখানে কঠোর নিরাপত্তা সেখানে এত বড় একটা চুরির ঘটনা, এটা আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। পাশাপাশি গত চার-পাঁচ মাস গুদামে কারা গেছে সেটিও তদন্তে আনা হবে। সিসি ক্যামেরার পর্যবেক্ষণ, দায়িত্ব পালন ও জিজ্ঞাসাবাদের পরে বলা যাবে আসলে ঘটনাটি কীভাবে হয়েছে এবং কারা ঘটিয়েছে। এক কর্তৃপক্ষ সোনাগুলো আরেক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করল; কিন্তু তারা কীভাবে বুঝিয়ে দিল আর যারা বুঝে নিল তারাই বা কীভাবে বুঝে নিয়েছে সব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত চলছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমরা তদন্ত শেষ করব।
এর আগে পুলিশ জানিয়েছিল, বিমানবন্দরে ঢাকা কাস্টমসের সুরক্ষিত গুদাম থেকে ৫৫ কেজি ৫১ গ্রাম স্বর্ণ বিমানবন্দরের কাস্টম হাউস থেকে সরিয়ে ছিলেন বিমানবন্দরের কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম শাহেদ ও শহিদুল ইসলাম এবং সিপাহি মো. নিয়ামত হাওলাদার। পরে সেগুলো বায়তুল মোকাররমের স্বর্ণ মার্কেটে বিক্রি করা হয়। সেই মার্কেটের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ রক্ষা করতেন চুরিতে জড়িত কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বায়তুল মোকাররম ও নয়াপল্টনে পলওয়েল মার্কেটে কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠকও করেছেন তারা। তবে অভিযুক্ত কেউই পুলিশের কাছে চুরির দায় স্বীকার করেননি।
গত ১ সেপ্টেম্বর কাস্টম গুদাম থেকে স্বর্ণ চুরির বিষয়টি নজরে আসে কর্তৃপক্ষের। পরদিন রাতে কাস্টম হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। মামলার বিবরণীতে ৫৫ দশমিক ৫১ কেজি স্বর্ণ হারানোর কথা উল্লেখ করা হয়। মামলাটি ডিবির কাছে হস্তান্তরের পর তদন্ত করছে সংস্থাটি। গুদাম থেকে চুরি হওয়া স্বর্ণের আনুমানিক মূল্য প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। মূলত এসব স্বর্ণ যাত্রীদের কাছ থেকে জব্দ করার পর কাস্টম হাউসের গুদামে রাখা হয়েছিল।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post