ওসিলা তালাশ করার ক্ষেত্রে মুসলিমদের জন্য আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের মর্যাদার দোহাই দেয়া জায়েজ। যেমন—এই কথা বলা যে আল্লাহ! আপনি আপনার নবীর ওসিলায় আমার দোয়া কবুল করুন। এ ধরণের ওসিলায় কোনো সমস্যা নেই।
ওসমান ইবনে হুনাইফ (রা.) বর্ণনা করেন, একদা এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি এসে হুজুর (স.)-এর নিকট আরজ করল- ইয়া রাসুলুল্লাহ! আল্লাহর নিকট আপনি আমার সুস্থতার জন্য দোয়া করুন। উত্তরে হুজুর (স.) বললেন, তুমি চাইলে আমি দোয়া করি, আর যদি তুমি চাও তাহলে ধৈর্য ধারণ করো, আর এটাই তোমার জন্য অধিক উত্তম। সে বলল আপনি দোয়া করুন। তখন হুজুর (স.) তাকে উত্তমরূপে অজু করে এভাবে দোয়া করার আদেশ দিলেন- ‘হে আলাহ! আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করি এবং আপনার রহমতের নবী মুহাম্মদ (স.)-এর ওসিলা সহকারে আপনার অভিমুখী হই। হে রাসুল (স.)! আমি আমার এই প্রয়োজন পূরণে আপনার ওসিলা দিয়ে প্রভুর অভিমুখী হলাম- হে আল্লাহ! আপনি আমার ব্যাপারে তাঁর সুপারিশ কবুল করুন। (সুনানে নাসায়ি: ১০৪১৯; মুসনাদে আহমদ: ১৭২৪০; সহিহ ইবনে খুজাইমা: ১২১৯; ইমাম তিরমিজি হাদিসটিকে ‘হাসান সহিহ’ বলেছেন। (সুনানে তিরমিজি: ৩৫৭৮)
এ হাদিসটি ব্যক্তি সত্তার ওসিলা দিয়ে দোয়া করা প্রমাণিত হওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট। এছাড়াও আল্লাহর হাবিব (স.)-এর সত্তা ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের ওসিলা দিয়ে দোয়া করার রীতি অনেক পুরনো। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, দুর্ভিক্ষকালে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) আব্বাস ইবনে আব্দিল মুত্তালিব (রা.)-এর ওসিলা দিয়ে বৃষ্টির জন্য এভাবে দোয়া করতেন- হে আল্লাহ! আমরা আমাদের নবীজি (স.)-এর ওসিলা দিয়ে দোয়া করতাম, ফলে আপনি বৃষ্টি দান করতেন। এখন আমরা নবীজি (স.)-এর চাচা আব্বাস (রা.) এর ওসিলা দিয়ে বৃষ্টির দোয়া করছি, আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন। বর্ণনাকারী বলেন, দোয়ার সাথে সাথেই বৃষ্টি বর্ষিত হত। (সহিহ বুখারি: ১০১০)
ওমর (রা.) দুর্ভিক্ষকালে সাহাবায়ে কেরামকে আব্বাস (রা.)-এর ওসিলা ধরে দোয়া করার আদেশ দিতেন এভাবে- ‘হে লোকসকল! তোমরা রাসুল (স.)-এর অনুসরণ করো তাঁর চাচা আব্বাস (রা.)-এর ব্যাপারে এবং তাঁকে আল্লাহর নিকট ওসিলা হিসেবে পেশ করো।’ (ফাতহুল বারি: খ: ২ পৃ-৬১৩)
হুজুর (স.)-এর ইন্তেকালের পর উসমান ইবনে হুনাইফ (রা.)-এর পরামর্শে এক তাবেয়ি হুজুর (স.)-এর সত্তার ওসিলা দিয়ে উসমান ইবনে হুনাইফ (রা.)-এর বর্ণিত হাদিসে বাক্যগুলো দ্বারা নিজের প্রয়োজন পূরণে আল্লাহর নিকট দোয়া করেছেন এবং তিনি এতে সফলও হয়েছেন। (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ৩৬৬৮)
হুজুর (স.)- নিজেও পূর্ববর্তী নবীগণের ওসিলা দিয়ে দোয়া করেছেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, আলী (রা.)-এর মাতা ফাতিমা বিনতে আসাদ ইবনে হাশিম মৃত্যুবরণ করলে তার কবর খনন করা শেষ হওয়ার পর রাসুল (স.) কবরের ভিতর ঢুকলেন এবং শুয়ে এই দোয়া করলেন, ‘আয় আল্লাহ! যিনি জীবন ও মৃত্যু দান করেন। যিনি চিরঞ্জীব। আমার মা (সমতুল্য) ফাতেমা বিনতে আসাদকে ক্ষমা করুন এবং তাঁকে কবরের প্রশ্নের উত্তর স্মরণ করিয়ে দিন। তাঁর কবরকে প্রশস্ত করে দিন আপনার নবী এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণের ওসিলায়। আপনি তো সকল দয়ালুর চাইতে বেশি দয়ালু। (আল মুজামুল কাবির: ৮৭১, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ১৫৩৯৯)
ওসিলা গ্রহণের হাকিকত এই যে- হে আল্লাহ! অমুক আমার কাছে আপনার প্রিয়ভাজন। আর আপনার প্রিয়ভাজনদের সাথে মোহাব্বত যারা রাখেন তাদেরকে আপনি মোহাব্বত করেন মর্মে আপনার ওয়াদা রয়েছে। (দ্র: সহিহ বুখারি: ৫৮১৮) আর কোনো মকবুল বান্দার বরকতের সাথে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করাকে জমহুর ওলামাগণ জায়েজ বলেছেন। (বাওয়াদেরুন নাওয়াদের: ৭৬১)
সুতরাং আম্বিয়ায়ে কেরাম, বুজুর্গানে দ্বীনের ওসিলা গ্রহণের মাধ্যমে দোয়া করা নাজায়েজ কিছু নয়। মনে রাখতে হবে, ওসিলা গ্রহণ আর ওসিলার কাছে সরাসরি দোয়া করা ভিন্ন কথা। অনেকে বিষয়টিকে গুলিয়ে ফেলেন। আমরা জানি যে, আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে দোয়া প্রার্থনা করা কিংবা প্রয়োজন পূরণকারী মনে করা শিরক। ওসিলা গ্রহণ ছাড়া দোয়া কবুল হবে না মনে করাও ভ্রষ্টতা। এখানে প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- নবীজির ওসিলায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা। এটি সম্পূর্ণ জায়েজ। মূলত কোনো মুসলমান যখন কারো ওসিলায় দোয়া করে তখন সে আল্লাহ তাআলার কাছেই দোয়া করেন, ওসিলাকৃত ব্যক্তির কাছে নয়। কখনও উদ্দেশ্য এমন হতে পারে না যে, ওসিলা নিজেই দোয়া কবুল করবেন।
এ ব্যাপারে বুখারি শরীফের জগদ্বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ) বলেন, ওমর (রা.)-এর উক্তি- সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (স.)-এর ওসিলা দিয়ে দোয়া করতেন, মোটেই এ কথা বোঝায় না যে তারা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নিকট বৃষ্টির দোয়া করার আবেদন করতেন। বরং এ কথারই প্রমাণ বহন করে যে, উভয় অবস্থাতেই তাঁরা আল্লাহর নিকটই বৃষ্টির জন্য দোয়া করতেন রাসুল (স.)-এর ওসিলা দিয়ে। (ফাতহুল বারি: খ.২ পৃ-৬১০)
অতএব, নবীজির ওসিলা দিয়ে কিংবা আওলিয়া কেরামদের ওসিলায় দোয়া করা জায়েজ। পক্ষান্তরে এমন কোনো হাদিস নেই যেখানে ওসিলা দিয়ে দোয়া করার নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে অথবা এর বিপরীতে সামান্যতম ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সহিহ সুন্নাহর ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post