হিজাব আমাদের জাতীয় বা ঐতিহ্যগত পোশাক নয়। তাই কাউকে জোর করে হিজাব পরাতে চাইলে যে চায় তার শাস্তি হওয়া উচিৎ। একটা মেয়ে হিজাব পরবে কি না তাও তার ব্যাপার। নরসিংদীর স্টেশনে মেয়েটার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই আমি।
আমাদের দেশে আমি কি পোশাক পরব তা আমার চয়েস। কিন্তু, এটাও আমাদের ভাববার বিষয় যে, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর অন্তত এতোটুকু বোধশক্তি থাকা উচিৎ যে, কোন পরিবেশে কি ধরনের পোশাক পরা যায়। আমি হাটু থেকে চার ইঞ্চি উঁচু হাফ প্যান্ট পরে সবজায়গায় ঘুরতে পছন্দ করি। ঢাকাতে আমি সেই হাফপ্যান্টই পরি সবসময়। কিন্তু, ঢাকার বাইরে আমার গ্রামের বাড়িতে গেলেও সেটা ভয়ানক রকমের বেয়াদবি হিসেবে ধরে নেন এলাকাবাসীরা। মারধর খাওয়ার সম্ভাবনাও আছে।
আমি তখন বাড়ির ভেতর ছাড়া বাইরে কখনো সেই হাফপ্যান্ট পরি না। ছাত্রাবস্থায়ও এরকমই করেছি।
অনেকেই বলবেন আমি মেয়েটার পোশাক ধরে টানাটানি করা মহিলার পক্ষ নিচ্ছি। মহিলা যে নোংরামি করেছে তার জন্য তার শাস্তি পাওয়া উচিৎ। কিন্তু, ভাবুনতো একবার আমাদের অবস্থা।
দিন দিন আমাদের সহ্য ক্ষমতা যেভাবে লোপ পাচ্ছে সাথে সাথে লোপ পাচ্ছে আমাদের বুদ্ধিজ্ঞানও। একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী কি পরবে সেটা তার ব্যাপার হলেও তার অন্তত এতোটুকু বোঝা উচিৎ কোন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে হলে কি ধরনের পোশাক তাকে পরতে হবে। নরসিংদীর মতো জায়গায় তার ওই পোশাকে যাওয়াটা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক নয়কি?
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, ট্যুরিস্ট প্লেসের বৌদ্ধ ও হিন্দু মন্দিরগুলো এই সমস্যায় জর্জরিত। সেখানে ঘুরতে যাওয়া ট্যুরিস্টদের এই বোধশক্তিটুকু নেই যে, কোন ড্রেসে আদিনাথ, চন্দ্রনাথ মন্দির বা বনো বিহার, স্বর্ণমন্দির বা অন্যান্য মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। কিভাবে অপরের ধর্ম বিশ্বাসে সম্মান জানাতে হয়।
গতকাল দেখলাম, আমার ব্যাচমেট সহকর্মীর ৬/৭ বছরের বাচ্চা উত্তরায় শিক্ষা সপ্তাহের অনুষ্ঠানে কোন একটা তামিল মুভির গানে সেই নায়ককে অনুকরণ করে নাচছে। আমার কৃষি ক্যাডারের সেই সহকর্মী এবং তার শিক্ষা অফিসার স্ত্রী আবার সগর্বে সেটা ফেসবুকে পোস্ট করে সবাইকে দেখাচ্ছেন। বাচ্চাটার কোন দোষ নেই। কিন্তু, আমাদের সময় শিক্ষা সপ্তাহ বলতে আমরা জানতাম বাচ্চা ছেলেমেয়েরা রঙ-বেরঙের বাহারি দেশী পোশাক পড়ে কেউ দেশাত্মবোধক, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারি-সারি গাইবে, কেউবা এসব গানের সাথে বাচবে, ছবি আঁকবে, কেউ আবার কবিতা আবৃত্তি করবে।
কিন্তু, তার বাবা-মা তাকে তামিল মুভি দেখিয়ে সেটারই শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। উত্তরা থানা শিক্ষা অফিসারের হয়তো উচিৎ ছিলো তখন তার বাবা-মাকে ডেকে সতর্ক করা, দেশী সাংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট করা। অবশ্য বয়সের কথা চিন্তা করে হয়তো শিক্ষক বা শিক্ষা অফিসার কেউই তাকে নিরুৎসাহিত করেননি। কিন্তু, বাবা-মা কেন জানবেন না এই বয়সের বাচ্চাকে কি শিক্ষা দেয়া যায়।
কদিন আগে আমাদের সাংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তুলতে স্বাধীনতা দিবসের উৎসব এবং পহেলা বৈশাখের উৎসবে বাংলাদেশী কজন শিল্পী এসেছিলো ইরানে। তারা দেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী কোন দেশকে রিপ্রেজেন্ট করে চলে গেলেন। লজ্জা পাবো, দুঃখ পাবো না হাসবো! কোথায় পৌছেছি আমরা যে, আমাদের নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের ভেতরও এই জ্ঞান নেই যে, দেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে কোন গানে কিভাবে নাচা যায়, কি নাচ নাচা যায় বা কি ধরনের গানই-বা গাওয়া যায়।
আজ দেখলাম এক মহিলা ভাষণ দিচ্ছেন আর সগর্বে বলছেন যে, বুদ্ধিহীন শূন্য মাথার মহিলারা হিজাব পড়েন। ভদ্র মহিলার এতোটুকু শিক্ষা নেই যে কোন পরিবেশে মাইক সামনে নিয়ে কি বলা যায়। তিনিও পোশাকের স্বাধীনতায় আঘাতকারী বুদ্ধিহীন মস্তকের মানুষ।
দিন দিন কি সংস্কৃতি, সামাজিকতা, পারিবারিক মূল্যবোধ হারিয়ে আমরা আমাদেরকে স্মার্ট প্রমাণ করার চেষ্টা করছি, নিজেকে আধুনিক প্রমাণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু, এটা ভুলে যাচ্ছি পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোটা সবচেয়ে বড় স্মার্টনেস, নিজের সাংস্কৃতিকে প্রমোট করাটা সবচেয়ে বড় স্মার্টনেস, কোথায় কি করা যায় সেটা জানাটাও স্মার্টনেস, কোথায় কি বলা যায় তা বলতে পারাটাও স্মার্টনেস। আমার বাচ্চাকে সঠিক জিনিস শিক্ষা দিতে পারাটাও আমার স্মার্টনেস।
লেখক: ওয়ালিদ ইসলাম,
হেড অব চেন্সরি, বাংলাদেশ দূতাবাস ইরান
আরো পড়ুন:
সবাই আমার স্ত্রীকে চোরের বউ বলে আমাকে জামিন দেন
পাসপোর্ট অফিসে কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য, অনুসন্ধানে দুদক
প্রবাসী বন্ডে কমছে মুনাফার হার
করোনা মোকাবিলায় ওমানের চেয়েও এগিয়ে বাংলাদেশ
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post