ব্রিটেনে গত জুলাই মাসে সংসদীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় পান কিয়ার স্টারমার। জয় পাওয়ার মাত্র একদিন পরেই দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। তবে এ ক্ষেত্রে পুরো উল্টো চিত্র দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে। কেননা, গত ৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেন ডনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু তাকে আবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য ৭৬ দিন অপেক্ষা করতে হবে।
কারণটা কী?
অন্যান্য সংসদীয় গণতন্ত্রের মত ব্রিটেনের বিরোধীদল একটি ছায়া সরকার গঠন করে, যার মাধ্যমে তারা নির্বাচনে জয়ের পরই ক্ষমতা গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে সেরকম কোনো ব্যবস্থা নেই।
আমেরিকার হবু-প্রেসিডেন্টকে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হয়। তাকে সরকারের বিশাল প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ করতে হবে। প্রায় সাত লক্ষ কোটি ডলার বাজেটের এই প্রশাসনে ৩৫ লক্ষ বেসামরিক এবং সামরিক লোক কাজ করে, যাদের মধ্যে হাজার হাজার লোককে নতুন প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করবেন।
দেশটিতে এক প্রেসিডেন্ট থেকে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট উত্তরণের সময়কে বলা হয় ট্রানজিশন পিরিয়ড। নভেম্বরে নির্বাচনের দিন থেকে জানুয়ারিতে ইনোগুরেশন বা অভিষেক দিবস পর্যন্ত জটিল ১১টি সপ্তাহ হচ্ছে আমেরিকার গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর। এই সময়টার কাজ হচ্ছে এক প্রশাসন থেকে আরেক প্রশাসনের হাতে নির্ঝঞ্ঝাট এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করা।
যুক্তরাষ্ট্রের কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান ১৪ নর্থ স্ট্রাটেজিস-এর পরিচালক মাইকেল শুরকিন বলছেন, উদ্দেশ্যটা হচ্ছে, তারা দায়িত্ব নেওয়ার পর যাতে প্রথম দিন থেকেই কাজ শুরু করতে পারেন।
প্রেসিডেন্সিয়াল ট্রানজিশন
ইতিহাসবিদ রাসেল রাইলির মতে, আমেরিকার ইতিহাসের অধিকাংশ সময় জুড়ে ট্রানজিশন সময়টাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হতো না। ট্রানজিশন পিরিয়ডটাও একসময়ে আরও লম্বা ছিল – চার মাস।
এই ‘প্রেসিডেন্সিয়াল ট্রানজিশন’ কথাটার প্রথম উল্লেখ ১৯৪৮ করা হয় বলে রাইলি চিহ্নিত করেছেন। তিনি দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় যুক্তি দেখান যে, প্রথম দিন থেকেই বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য নতুন প্রেসিডেন্ট এবং তার টিম প্রস্তুতু না থাকার ঝুঁকির কারণে এই প্রক্রিয়া ১৯৬০-এর দশকে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
বর্তমানে, ট্রানজিশন একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার পেছনে যেমন রয়েছে ঐতিহ্য এবং রীতি, তেমনি আছে আইন এবং নিয়মাবলি।
এই ঐতিহ্য শুরু করার জন্য প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়। ট্রুম্যান ১৯৫২ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর তার তিক্ত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ডয়াইট ডি আইজেনহাওয়ারকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ করেছিলেন।
এই উদাহরণ পরবর্তী সব প্রেসিডেন্ট অনুসরণ করেছেন, শুধু ট্রাম্প ছাড়া। ট্রাম্প ২০২০ সালে পরাজিত হওয়ার পর প্রতিপক্ষ জো বাইডেনকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ করেননি।
ইন্টেলিজেন্স ব্রিফ
একটি ঐতিহ্য অনুযায়ী, যা ১৯৬৮ সালে শুরু হয়, প্রেসিডেন্ট তার দ্য প্রেসিডেন্সিয়াল ব্রিফ এর একটি কপি নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে দেন, যার মধ্যে থাকে গোয়েন্দা সংস্থার দৈনিক ইন্টেলিজেন্স ব্রিফ।
এই দুই রীতির কোনোটাই আইনে লিখিত নেই। কিন্তু ট্রানজিশনের অন্য অনেক কিছুতে আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে। দ্য প্রেসিডেন্সিয়াল ট্রানজিশন অ্যাক্ট, ১৯৬৩, যা নিয়মিত আপডেট করা হয়, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়।
অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আছে
নির্বাচনের ছয় মাস আগে, প্রেসিডেন্ট একটি ট্রানজিশন সমন্বয় কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রতিটি ফেডেরাল সংস্থা বা এজেন্সি একটি করে ট্রানজিশন পরিচালক নিয়োগ করে। সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে এজেন্সি প্রধানদের সকল অস্থায়ী কর্মীদের পরিবর্তন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে।
অক্টোবর মাসের ১ তারিখের মধ্যে, জেনারেল সার্ভিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিএসএ), যারা ফেডেরাল সরকারের সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির তদারকি করে, ট্রানজিশন টিমের সাথে চুক্তি সম্পন্ন করে তাদের অফিস এবং অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করবে।
যদিও এগুলো সাম্প্রতিক সময়ে আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, আমেরিকান ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় জুড়েই এক প্রেসিডেন্ট থেকে আরেক প্রেসিডেন্টের উত্তরণ নিয়মমাফিক ছিল।
তারপর আসলো ২০২০ সালের গন্ডগোল। ট্রাম্প তখন পুনঃনির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, ভোটে কারচুপির অভিযোগ এনে পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকার করলেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত জো বাইডেনকে প্রথম দিকে দৈনিক ইন্টেলিজেন্স ব্রিফিং দেওয়া হয়ে নি, এবং তিনি যে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন সে বিষয়ে ‘নিশ্চিত’ হতে জিএসএ-এর তিন সপ্তাহ লেগে যায়। ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে ট্রাম্প বাইডেনকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানাননি, এবং তিনি নতুন প্রেসিডেন্টের ইনোগুরেশন বা অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হননি।
এ বছরের নির্বাচনে ট্রাম্পকে দ্রুত জয়ী ঘোষণা করায়, পাল্লা আবার প্রতিষ্ঠিত নিয়মের দিকে ভারি হয়েছে।
গত বুধবার (১৩ নভেম্বর) বাইডেন ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ করেন, যেখানে তারা ক্যামেরার জন্য পোজ দেন এবং নির্ঝঞ্ঝাট ট্রান্সিশনের অঙ্গীকার করেন। হোয়াইট হাউস তাদের বৈঠককে খুবই সৌহার্দপূর্ণ, খুবই শোভন এবং কার্যকর বলে বর্ণনা করে। তবে হোয়াইট হাউসে দেখাসাক্ষাৎ নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের মূল কাজ না।
নতুন প্রশাসনে লোক নিয়োগ করা। সেন্টার ফর প্রেসিডেন্সিয়াল ট্রানজিশন অনুযায়ী, নতুন প্রশাসনকে ৪,০০০ এর বেশি পদ পুড়ন করতে হবে, যার মধ্যে নিয়োগপ্রাপ্ত ১,২০০জনকে সেনেটে অনুমোদন পেতে হবে। যাদের রাজনৈতিক ভিত্তিতে নিয়োগ করা হয়েছিল, তারা নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নেয়ার আগে বা ইনোগুরেশনের দিন পদত্যাগ করেন।
এই বিশাল নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য সময় এবং সম্পদ প্রয়োজন হয়। রাজনৈতিক পদের জন্য প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিতে হবে, তাদের যোগ্যতা যাচাই করতে হবে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্স প্রয়োজন হয়।
নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইনোগুরেশন বা অভিষেক দিবসের মধ্যে কয়েক ডজন মূল পদের জন্য নাম ঘোষণা করেন, কিন্তু বেশির ভাগ নিয়োগ দেয়া হয় তারা দায়িত্ব গ্রহণের পর।
গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ
ট্রাম্প ইতোমধ্যে তার প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর জন্য লোক মনোনীত করেছেন হোয়াইট হাউস চিফ অফ স্টাফ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, সিআইএ পরিচালক, ডিরেক্টর অফ ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স, অ্যাটর্নি জেনারেল, পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আগামী দিন এবং সপ্তাহগুলোতে আরও গুরুত্বপূর্ণ পদে মনোনয়ন ঘোষণা করা হবে। কিন্তু এসব নাম ঘোষণা যদি খবরের শিরোনামে থাকলেও, প্রেসিডেন্সিয়াল পালাবদলের আসল কাজ প্রায়ই পর্দার আড়ালে হয়ে থাকে। দুই প্রশাসনের এজেন্সি পর্যায়ের টিমগুলো তথ্য বিনিময় করে এবং এই জটিল ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ পরিচালনা করে।
মাইকেল শুরকিন ভয়েচ অব আমেরিকা’কে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, প্রতিবার এটাই হয়েছে, শুধু ২০২০-২১ সালে রিপাবলিকান দলের ব্যতিক্রম ছাড়া। এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে, বিশেষ করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, যেমন প্রতিরক্ষা বা সিআইএ-তে নতুন লোক এসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস না করে, ‘এইটা কী? তোমার কাজ কী? সব কিছু কীভাবে কাজ করে?”
বাইডেন এবং ট্রাম্প টিমের মধ্যে সমন্বয় কতটুকু হচ্ছে, তা এখনো অনিশ্চিত। বাইডেন তার প্রশাসনকে নির্ঝঞ্ঝাট হস্তান্তর নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু ট্রাম্পের টিম হোয়াইট হাউস এবং জিএসএ-এর সাথে চুক্তি করতে কয়েকটি সময়সীমা মানতে ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে ফেডেরাল এজেন্সিগুলো তাদের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করতে পাড়ছে না।
মুলার বলছেন, ট্রাম্পের টিমের হয়তো গোপনীয়তা নিয়ে সংশয় আছে, কিন্তু এই বিলম্বগুলো সত্যি ঝুঁকিপূর্ণ। আপনি যদি ঐ ফেডেরাল এজেন্সিগুলোর তথ্য না পান, তাহলে ফেডেরাল সরকারের কার্যক্রম হাতে নিয়ে আপনার দেরি হয়ে যাবে।
প্রেসিডেন্সিয়াল ট্রান্সিশনকে মাঝে-মধ্যে লেম ডাক সময় বলা হয়, কারণ বিদায়ী প্রেসিডেন্ট তখন আগামী প্রেসিডেন্টের অভিষেকের জন্য অপেক্ষা করছেন এবং তার প্রভাব খর্ব হয়ে যায়।
ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের যদিও ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত ক্ষমা প্রদর্শনসহ সব ক্ষমতাই থাকে, বড় কোন নীতি বা সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষমতা সীমিত হয়ে যায়। এর ফলে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় ঝুঁকির দাবা খেলার সুযোগ সৃষ্টি হয়। মিত্র এবং প্রতিপক্ষ দেশগুলোকে বর্তমান এবং আগামী প্রশাসনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হয়। বিশেষ করে যে-সব বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী সম্পর্ক আছে, তাদের অত্যন্ত সাবধানে পা ফেলতে হবে।
কূটনৈতিক গুটি চালানো ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। বিদেশি সরকারগুলো যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে সম্পর্ক বজায় রাখছে। তবে মুলার বলছেন, বিদেশী নেতারা ইতোমধ্যেই ট্রাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন এবং তার অবস্থান সম্পর্কে জানছেন। তার প্রশাসনের অধীনে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন।
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুবিয়ান্তো ট্রাম্পকে ফোন করে সামনা-সামনি সাক্ষাৎ করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
মুলার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে কাজ করে, সেখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসছে, এবং সেকারণে বিদেশি সরকারগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার কাজ।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post