রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাড়িতে প্রবাসী চিকিৎসক ডা. একেএম আব্দুর রশিদ (৮৫) হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় চার জন। এরমধ্যে তিন জন বাড়ির বারান্দা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে তাকে হত্যা করে। আরেকজন বাইরে রিকশা নিয়ে পাহারা দেয়। কিলিং মিশনে তারা সময় নেয় চার মিনিট।
গত বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) দিনগত রাত আড়াইটার দিকে ধানমন্ডি-১৫ নম্বরে ২৯৪/১ নম্বর নিজ বাড়িতে স্ত্রীর সামনে হত্যা করা হয় চিকিৎসক আব্দুর রশিদকে। পাঁচতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় স্বামী-স্ত্রী থাকতেন। তাদের দুই ছেলে-মেয়ে থাকেন লন্ডনে। তারাও লন্ডন প্রবাসী। মূলত শীতের সময়টায় তারা দেশে থাকতেন আর বাকি সময় ছেলে-মেয়ের সঙ্গে থাকতেন লন্ডনে। গত সেপ্টেম্বর মাসে তারা ঢাকায় আসেন। আগামী বছরের জানুয়ারিতে আবার লন্ডন চলে যাওয়া কথা ছিল।
প্রবাসী চিকিৎসক ডা. একেএম আব্দুর রশিদ হত্যার ঘটনায় শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) তার চাচাতো ভাই মো. রেজাউল করিম বাদী হয়ে হাজারীবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি থানা পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, গোয়েন্দা তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ছায়া তদন্ত করছে।
জানা যায়, তিন ব্যক্তি বারান্দা দিয়ে আব্দুর রশিদের ঘরে প্রবেশ করে। এরমধ্যে একজন তার স্ত্রী সুফিয়া রশিদের মুখ চেপে ধরে রাখে। আর দুই জন আব্দুর রশিদকে ধরে নিচে শুইয়ে বুকে ও গলায় ছুরি চালিয়ে তাকে হত্যা করে। হামলাকারীদের বয়স ২২ থেকে ২৮ বছর। হত্যা করার সময় ভুক্তভোগীর বাড়ি থেকে কোনও কিছু নেয়নি হত্যাকারীরা। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন তাহলে কেন প্রবাসী চিকিৎসক আব্দুর রশিদকে হত্যা করা হয়েছে, কারা এই হত্যাকারী?
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা কয়েকটি মোটিভ সামনে রেখে ছায়া তদন্ত করছেন। সম্পত্তির লোভ, আত্মীয়-স্বজন ও ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকারে হত্যা করা হতে পারে আব্দুর রশিদকে। সিসিটিভি ফুটেজ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিকিৎসক আব্দুর রশিদ ও তার স্ত্রী সুফিয়া রশিদ কিছুটা রাগী প্রকৃতির ছিলেন। বেশ কয়েক বছর ধরে তাদের ধানমন্ডির পাঁচতলা ভবনে ব্যাচেলরদের ভাড়া দিয়েছেন। প্রায় সময় তারা ব্যাচেলরদের বকাঝকা করতেন। সিসিটিভি ক্যামেরায় যে তিন জনকে দেখা গেছে, এরমধ্যে দুই জনকে চিনতে পেরেছেন ওই বাড়ির বর্তমান ও সাবেক দুই জন ভাড়াটিয়া (ব্যাচেলর)। তারা বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজ খুব একটা স্পষ্ট না। তবে তারা আগে এই বাড়িতে ভাড়া ছিলেন।’ তারা কেন হত্যা করবে, এমন প্রশ্নে ওই দুই ব্যাচেলর বলেন, ‘হয়তো তাদের সঙ্গে বাড়ির মালিক দুর্ব্যবহার করেছিলেন।’
শনিবার (১৬ নভেম্বর) দুপুরে ধানমন্ডির-১৫, ২৯৪/১ নম্বর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পাঁচতলা বাড়ির দোতলায় রাস্তার পাশের একটি ইউনিটে থাকতেন নিহত প্রবাসী চিকিৎসক আব্দুর রশিদ ও তার স্ত্রী সুফিয়া রশিদ। বাড়ির বারান্দার অংশ খোলামেলা। বারান্দার দরজা খোলা থাকলে যে কেউ চাইলেই দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করতে পারবেন। বাড়ির অন্যগুলো ইউনিট ব্যাচেলরদের ভাড়া দেওয়া। দোতলার একটি ইউনিটে কথা হয় কয়েকজন ব্যাচেলরের সঙ্গে। তারা প্রত্যেকেই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী। এরমধ্যে তানভীন হোসেন বলেন, ‘সেদিন রাত আড়াইটার দিকে শোরগোল শুনতে পাই। মাঝে মধ্যে বাড়িওয়ালি চিৎকার করতেন। তাই আমরা খুব একটা গুরুত্ব দেইনি। পরে তিনতলা থেকে বাঁধন নামে এক শিক্ষার্থী এসে বলছেন, বাড়িওয়ালাকে কারা যেন মেরেছ। পরে দ্রুত আমরা বেরিয়ে গিয়ে দেখি আঙ্কেল (আব্দুর রশিদ) রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। আন্টি তার মাথায় পানি ঢালছেন। পরে আমরা দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন তাকে।
পাশের বাড়ির জহিরুল নামে এক সিকিউরিটি গার্ড বলেন, ‘ওই বাড়ির বাড়িওয়ালা ও বাড়িওয়ালি প্রায় সময় অনেক রাগ দেখাতেন। কিছুদিন আগে আমাদের বাড়ির একটি সিসিটিভি ক্যামেরা ও লাইট ভেঙ্গে ফেলেছেন তারা। কেননা সেটা তাদের বাড়ির একাংশ কাভার করতো। যদি ওই ক্যামেরা থাকতো কারা বাড়িওয়ালাকে হত্যা করেছে, সেটা আরও স্পষ্ট দেখা যেতো।’
ডা. আব্দুর রশিদ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও হাজারীবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে- প্রবাসী চিকিৎসক আব্দুর রশিদকে ছুরি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে আমরা কাজ করছি। আশা করছি খুব দ্রুত তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হবো।’
হত্যার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা এখনই বলার সুযোগ নেই। হত্যাকারীদের গ্রেফতার করতে পারলে সব বেরিয়ে আসবে।’
জানা যায়, আব্দুর রশিদের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ঝালকুড়ি পশ্চিমপাড়া গ্রামে। তার বাবা মৃত সামসুদ্দিন মিয়া। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তার বড় ভাই মারা গেছেন। ডা. আব্দুর রশিদ চাকরি জীবনের সিংহভাগ সময়ই কাটিয়েছেন লন্ডন ও দুবাইয়ে। তার দুই সন্তান লন্ডন প্রবাসী। সেখানেই চাকরি করছেন। তার স্ত্রী সুফিয়া রশিদও একজন চিকিৎসক। তিনিও চাকরি করেছেন দেশের বাইরে।
চিকিৎসক আব্দুর রশিদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আশপাশের একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) দিনগত রাত আড়াইটার দিকে ধানমন্ডির-১৫ নম্বরে প্রধান সড়ক (সাত মসজিদ রোড) থেকে চার ব্যক্তি ডায়মন্ড হোটেলের গলি দিয়ে প্রবেশ করে। এরমধ্যে একজন রিকশা চালক, যার পরনে ছিল লুঙ্গি ও কালো শার্ট। বাকি তিন জন হেঁটে যান। এরমধ্যে একজনের শরীরে ছিল কালো রংয়ের শার্ট, আরেকজনের শরীরে নীল রংয়ের জার্সি ও অন্যজনের শরীরে ছাই রংয়ের শার্ট ও চাদর। তাদের তিন জনের বয়সই ২০ থেকে ২৮ বছর। রাত ২টা ৩২ মিনিটে ২৯৪/১ নম্বর বাড়ির বারান্দা দিয়ে আব্দুর রশিদের ঘরে প্রবেশ করে তিন জন। মাত্র চার মিনিটে ছুরি আব্দুর রশিদকে হত্যা করে ২টা ৩৬ মিনিতে বেরিয়ে যায় তারা। পরে স্টাফ কোয়ার্টার দিয়ে চলে যায়।
হাজারীবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘নিজস্ব বাড়িতে প্রবাসী চিকিৎসক আব্দুর রশিদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি আমরা গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। হত্যাকারীদের গ্রেফতারে আমাদের একাধিক টিম কাজ করছে। আশা করি দ্রুত ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটন করা যাবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post