সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও ফ্লাইটের অভাবে নির্ধারিত সময়ে হাজারো কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। তবে একই সময়ে বিমান বাংলাদেশের কুয়ালালামপুরগামী উড়োজাহাজে আসন ফাঁকা ছিল। ট্রাভেল এজেন্সির সিন্ডিকেটকে বেশি দামে টিকিট বিক্রির সুযোগ করে দিতে বিমানের কর্মকর্তারা সে সময় কারসাজি করেছিলেন। এ ছাড়া তৎকালীন বিমানমন্ত্রী এবং বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের তদবিরে দেওয়া হয় ৯১টি টিকিট।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বিমানের তদন্ত প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। টিকিট সংকট তৈরির জন্য চার কর্মকর্তাকে দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে কমিটি। টিকিটের তীব্র সংকটের সময়েও আটটি বিশেষ ফ্লাইটের পাঁচটিতে ৫৭ আসন ফাঁকা যায় বলে প্রমাণ পেয়েছে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফাতেমা রহিম ভীনার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। গত ৭ আগস্ট প্রতিবেদন দেন তারা।
বিমানের ব্যবস্থাপক মো. শফিকুলের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আরেকটি কমিটি ১৭ সেপ্টেম্বর যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতেও উঠে এসেছে টিকিট বিক্রির ব্যবস্থাপনায় কারসাজির বিষয়টি।
গত মার্চে মালয়েশিয়া সরকার জানায়, দেশটিতে ৩১ মের পর বিদেশি কর্মীদের প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। প্রায় ৭০ দিন সময় পেয়েও আওয়ামী লীগ সরকার ভিসা পাওয়া হাজারো কর্মীর নির্ধারিত সময়ে মালয়েশিয়া যাওয়া নিশ্চিত করতে পারেনি।
গত ৩০ এবং ৩১ মে টিকিট না পাওয়া হাজারো কর্মী ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিড় করেছিলেন, তাদের আহাজারি দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। সরকার নির্ধারিত ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা হলেও, কর্মীদের কাছ থেকে তখন সাড়ে ৪ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয় কর্মী পাঠানোর কাজ পাওয়া রিক্রুটিং এজেন্সির ‘সিন্ডিকেট’। ঋণ করে, জমি বিক্রি করে দেওয়া অর্থ ফেরত না পেয়ে কর্মীরা এখনও ঘুরছেন। অনেকে হয়েছেন সর্বস্বান্ত।
১৫ দিনের মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়ার ঘোষণা থাকলেও কর্মীরা মাত্র ২৫ শতাংশ টাকা ফেরত পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রবাসীকল্যাণ উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সিন্ডিকেটে থাকা এমপি, মন্ত্রী এবং নেতাদের রিক্রুটিং এজেন্সির বেশির ভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। মালিকরা রয়েছেন পালিয়ে।
মালয়েশিয়ার ৫ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৩ চাহিদাপত্রের বিপরীতে গত ৩১ মে পর্যন্ত সরকার ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ জনকে ছাড়পত্র দেয়। তাদের মধ্যে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ জন মালয়েশিয়া যেতে পারেন। ১৬ হাজার ৯৭০ কর্মী যেতে পারেননি। তবে জনশক্তি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বায়রার হিসাবে, ৫ হাজার ৯৫৩ জন শুধু উড়োজাহাজের টিকিট না পেয়ে যেতে পারেননি। অন্যদের যাওয়া হয়নি নানা কারণে। সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ঘোষণা দেন, যেতে না পারা কর্মীদের নেওয়া হবে।
বিমানের ইকোনমিক শ্রেণিতে ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটের টিকিটের মূল্য ২০ হাজার ৪৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হলেও, গত মে মাসের শেষ সপ্তাহের ফ্লাইটগুলোতে ২ লাখ টাকায় পর্যন্ত টিকিট বিক্রি করে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো।
তদন্তে জানা গেছে, এই সুযোগ বিমানের কর্মকর্তারাই করে দেন ওভারবুকিংয়ের মাধ্যমে। ৩১ মের বিশেষ ফ্লাইট ছাড়া বিমানের কুয়ালালামপুরগামী উড়োজাহাজের কোনো টিকিট বিমানের সেলস কাউন্টার থেকে বিক্রি হয়নি।
ওভারবুকিংয়ের ব্যাখ্যায় বিমান সংশ্লিষ্ট একজন উদাহরণ দিয়ে বলেন, ধরা যাক একটি উড়োজাহাজে ২০০ আসন রয়েছে। চুক্তিবদ্ধ এজেন্সিকে বিক্রির জন্য দেওয়া হয়েছে ১০০ টিকিট। অবশিষ্ট ১০০ টিকিটের প্রথম ৪০টির দাম ২০০ ডলার করে। পরবর্তী ৩০টির দাম ৪০০ ডলার করে। পরবর্তী ৩০টির দাম ৬০০ ডলার। এজেন্সি ১০০ টিকিট বিক্রি না করে বুক দেখিয়ে, সংকটের সময়ে টিকিটগুলো ৭০০-৮০০ ডলার করে বিক্রি করল। অতিরিক্ত দামের কারণে কয়েকটি টিকিট অবিক্রীত থাকলেও, যেসব টিকিট বিক্রি হয়েছে, তাতে কয়েক গুণ লাভ হবে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমন অনিয়মের কথা কর্মকর্তারা জেনেও ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিমানের অসাধু কর্মকর্তারা নির্দিষ্ট ফ্লাইটের টিকিট উন্মুক্ত হওয়ার আগেই ওভারবুকিংয়ের মাধ্যমে বিক্রয় চ্যানেল থেকে সরিয়ে কিছু এজেন্সিকে দিয়ে দেয়। এজেন্সিগুলো তা চড়া মূল্যে বিক্রি করে। এতে কিছু টিকিট অবিক্রীত থেকে যায়।’ এতে আরও বলা হয়েছে, তদন্ত চলাকালে কমিটির কাছে একটি ‘স্ন্যাপশট’ আসে। সে অনুযায়ী তৎকালীন বিমানমন্ত্রী কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান এবং বিমানের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজমের রেফারেন্সে
কুয়ালালামপুরগামী ফ্লাইটের ৯১টি টিকিট দেওয়া হয়। ‘স্ন্যাপশট’টি বিমানের সিস্টেম থেকে গৃহীত হয়েছে কিনা, তা যাচাই করতে পারেনি তদন্ত কমিটি। ফারুক খান এখন কারাগারে। বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন শফিউল আজম। চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল।
মন্ত্রণালয়ের কমিটির কাছে ১০ জন সাক্ষী দিয়েছেন। তদন্তে বলা হয়েছে, ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে ওভারবুকিংয়ে বিমানের তিন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তারা হলেন– সহকারী ম্যানেজার ফারহানা আক্তার, অবসরের পর রেভিনিউ ম্যানেজমেন্টে সিস্টেম (আরএমএস) শাখার উপমহাব্যবস্থাপক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকা এফ এম তাবিবুর রহমান এবং তৎকালীন পরিচালক (বিপণন ও বিক্রয়) মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। তাদের সংশ্লিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
ফারহানার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা, তাবিবুরের নিয়োগ চুক্তি বাতিল এবং গত ৩০ জুন অবসরে যাওয়া পরিচালক সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। ফারহানার বিষয়ে বলা হয়েছে, তিনি ৩০ মের বিশেষ ফ্লাইটের ৩৯২টি টিকিট ওভারবুকিং করেন। অথচ ম্যানেজারের নিচের পদের কারও ওভারবুকিং করার এখতিয়ারই নেই।
আরএমএস শাখার ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে টিকিট ওভারবুকিংয়ের সন্দেহাতীত প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তবে তদন্ত চলাকালে তিনি বিদেশে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানতে পারেনি কমিটি। তাই তাঁর বিরুদ্ধে বিমানকে জরুরি তদন্ত চালানোর প্রস্তাব করা হয়।
বিমানের মহাব্যবস্থাপক (মতিঝিল বিক্রয় কেন্দ্র) আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে তদন্তের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিমানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ৪৮০টি ট্র্যাভেল এজেন্সির মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকটি কীভাবে উচ্চ মূল্যে টিকিট বিক্রি করছিল, তা অনুসন্ধানের চেষ্টা করেননি তিনি। সুযোগ থাকলেও এজেন্সির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেননি। তদন্তকালে বিদেশে থাকায় আশরাফুল আলমের বক্তব্য জানতে পারেনি কমিটি।
সাবেক পরিচালক সালাহউদ্দিনের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাখার প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে অধীনদের কেউ ওভারবুকিং করছে, তা নজরদারির দায়িত্ব ছিল তাঁর। অতীতে বিমানের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও নিয়মবহির্ভূত ওভারবুকিংয়ে আরএমএস শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা অভিযুক্ত হলেও, সালাহউদ্দিন তা আমলে নেননি। চুক্তিবদ্ধ ৪৮০টি ট্রাভেল এজেন্সির মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকটির মাধ্যমে কেন সব টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে, তা অনুসন্ধান করেননি। কারসাজির জন্য কোনো এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। অধীনদের অনিয়মকে সমর্থন করে, লিখিত প্রমাণ না রেখে মৌখিক নির্দেশে অধিকাংশ ফ্লাইটে ওভারবুকিং এবং ম্যানুয়ালি টিকিট বরাদ্দ রাখেন।
সালাহউদ্দিন সব অভিযোগ অস্বীকার করলেও তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্যে তাবিবুর রহমান ও ফারহানা আক্তার জানান, পরিচালকের মৌখিক নির্দেশে ওভারবুকিং করেছিলেন। তবে আরএমএস শাখা থেকে যে স্ক্রিনশট তদন্ত কমিটি পায়, এর সত্যতা অস্বীকার করেননি সালাহউদ্দিন। কমিটির অভিমত, নিজের শাখায় অনিয়মের বিষয়ে জানতে না বলে যে বক্তব্য সালাহউদ্দিন দিয়েছেন, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। টিকিটের দাম নির্ধারণের বিপুল ক্ষমতা তাঁর থাকলেও, যৌক্তিক দাম নির্ধারণ এবং এজেন্সিগুলোর চড়া দামে টিকিট বিক্রি ঠেকাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post