যত খাতে যত ধরনের আর্থিক অনিয়ম করা সম্ভব, এর কোনোটিই বাদ রাখেনি মিশরের কায়রোয় অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাস। কর্মকর্তারা বিদেশে অবস্থিত এই মিশনটিকে পরিণত করেছেন সরকারি অর্থ অপচয় ও আত্মসাতের মচ্ছবে। এসব দুর্নীতির সঙ্গে রাষ্ট্রদূত যেমন জড়িত, তেমনি সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন দূতাবাসের এইচওসি (হেড অব চেন্সারি), প্রশাসনিক কর্মকর্তা (কন্স্যুলার), প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে (হিসাব)। তাদের সহযোগিতা করছেন স্থানীয় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকৃত তিন কর্মচারী।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এসব অনিয়ম সংঘটনকালে কায়রো মিশনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন মনিরুল ইসলাম। তিনি বর্তমানে অবসরোত্তর ছুটিতে আছেন। এ ছাড়া এইচওসি হিসেবে আতাউল হক, দ্বিতীয় সচিব হিসেবে শিশির কুমার সরকার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা (কন্স্যুলার) রেজাউল করিম খান, প্রশাসনিক কর্মকর্তা (হিসাব) ফারুক হোসেন কর্মরত ছিলেন। তাদের এসব আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থেকে ভুয়া ভাউচার ও চেক তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন স্থানীয়ভিত্তিক কর্মচারী সোশ্যাল সেক্রেটারি হিসেবে কর্মরত রাদোয়া তারেক, প্রাক্তন প্রটোকল অ্যাসিস্ট্যান্ট আদম ইউনিস আদম, প্রাক্তন মেসেঞ্জার ফিজুল ইসলাম। এমনকি এসব চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী সম্প্রতি পরিচালিত নিরীক্ষা দলের কাছে মৌখিক ও লিখিত সাক্ষাৎকারে জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকার করেছেন। এমনকি এসব কাজে রাষ্ট্রদূতের সরাসরি নির্দেশ ছিল বলেও স্বীকার করেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১-২২, ২০২২-২৩ দুই অর্থবছরে দূতাবাসের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের খরচের ক্ষেত্রে প্রায় সাড়ে ২৩ কোটি টাকার (প্রায় ২৯ লাখ ডলার) অনিয়ম ধরা পড়েছে। এসব অনিয়মের মধ্য বাড়ি ভাড়া অধিক মূল্য দেখিয়ে ও দূতাবাস কমপ্লেক্স নির্মাণের জমি ক্রয় করে অর্থ আত্মসাৎ, বাসা ভাড়া অগ্রিম হিসেবে ক্যাশ-চেক প্রদান, জাতীয় দিবস পালন ও জাতীয় অনুষ্ঠানের নামে অর্থ তছরুপ, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ভাতা পরিশোধ ও ভুয়া বিল দেখিয়ে গুরুতর অনিয়ম করেছেন কর্মকর্তারা। এ ছাড়া মিশরের অপ্রচলিত ও অগ্রহণযোগ্য হাতে লেখা ভাউচার, চিকিৎসার নামে ভুয়া ভাউচার ও বিল ছাড়া অর্থ উত্তোলন, বই ক্রয় দেখিয়ে অর্থ নয়ছয়, আপ্যায়ন বিল দেওয়া সত্ত্বেও এন্টারটেইন অ্যালাউন্সের নামে অর্থ আত্মসাৎ, অস্তিত্ববিহীন স্থানীয় কর্মচারীর নামে বেতন উত্তোলন, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ এবং আসবাব ক্রয় ও মেরামতের নামে খরচ দেখানো, অনিয়মিতভাবে বিপুল পরিমাণ পেটি ক্যাশ উত্তোলন, সরকারি খরচে বাংলাদেশ থেকে গৃহভৃত্য মিশরে এনে মিশনের স্থানীয় কর্মী হিসেবে দেখিয়ে বেতন-ভাতা প্রদান করার মাধ্যমে অনিয়ম ঘটিয়েছেন দূতাবাসের কর্মকর্তারা।
বিমানবন্দরে প্রটোকল সহায়তার নামে অনিয়মিত ব্যয়, কপ-২৭-এ ভিভিআইপিদের জন্য অভিজাত হোটেল শার্ম আল শেখে হোটেল কক্ষ ভাড়া, ব্যক্তিগত কারণে গাড়ি পার্কিংয়ে ব্যয়, রাষ্ট্রদূত ও এইচওসির সন্তানদের পড়াশোনার খরচ ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। এমনকি দ্বিতীয় ও তৃতীয় সচিবের থাকার ব্যবস্থার অভাব দেখিয়ে দৈনিক ভাতা হিসেবে অর্থ প্রদান ও দূতাবাসের নামে চাদর কিনেও অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মনিরুল ইসলাম বলেন, আমার চাকরিজীবনে অন্তত ৩০টি নিরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছি, কোথাও কোনো অনিয়ম নেই। আমি যেহেতু চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি এবং মিশর থেকে ইতালিতে পদায়িত হয়েছিলাম, এজন্য অফিসের কর্মকর্তারা সব দায় আমার ওপর চাপিয়েছেন। এমনকি তাদের অনিয়মের দায়ও আমার ওপর চাপিয়েছে। আমি সবগুলোর জবাব দিয়েছি নিরীক্ষা সংশ্লিষ্টদের, আশা করি সব নিষ্পত্তি হবে।
এ সময় কিছু নির্দিষ্ট অনিয়মের বিষয়ে মনিরুল বলেন, জমি কেনার টাকা পড়ে ছিল অ্যাকাউন্টে, সেটা জামানত হিসেবে ব্যাংকে রাখা হয়েছিল এবং তা থেকে কিছু মুনাফা অর্জিত হয়। সে টাকা মূল অ্যাকাউন্টে জমা দিতে বলেছিলাম। আমি কোনো টাকা নিইনি, ওরাই টাকা তুলে নিয়েছে। নগদে অর্থ পরিশোধের বিষয়ে তিনি বলেন, সেখানে ডলারে পেমেন্টের কোনো উপায় নেই। কারণ ডলারে পেমেন্টের জন্য অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা নেই। ফলে ইজিপিতেই পরিশোধ করতে হতো। অফিস বদলের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়েই যৌক্তিক কারণে করা হয়েছে। এমনকি লেবার উইংয়ে যে অগ্রগতি কম, তার মূল কারণ শ্রমিক কম থাকা। কিন্তু যে পদ সৃষ্টি করা হয়েছে, তা তো বাতিল হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাষ্ট্রদূত মনিরুল ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মিশনে যোগদান করার পরপরই তৎকালীন কার্যালয়কে বসবাসের অনুপযোগী ঘোষণা করে নতুন জায়গায় স্থানান্তর করেন। ১১ মাস পর সেই জায়গাটিও বসবাসের অযোগ্য ঘোষণা করে আগের ঠিকানায় ফেরেন। তবে এবার বাড়ির মালিকের সঙ্গে ১ হাজার ৮০০ ডলার বেশি মূল্যের চুক্তি করেন। এমনকি চুক্তিপত্রে এইচওসির পরিবর্তে নিজেই স্বাক্ষর করেন। এমনকি সমুদয় অর্থ ব্যাংক ট্রান্সফার বা ক্রস চেকের পরিবর্তে কর্মচারীর মাধ্যমে নগদে পরিশোধ করেন। মনিরুল দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর একই বাড়ি মাসিক ৪ হাজার ডলারে ভাড়ায় নতুন চুক্তি করেন বর্তমান রাষ্ট্রদূত। এ বাবদ প্রায় ৪১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। তবে সূত্র বলছে, অর্থের পরিমাণ আরও বেশি। এ ছাড়া নিয়মের বাইরে মনিরুল সন্তানের পড়ালেখা বাবদ প্রায় ১৯ লাখ টাকা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করেছেন। এমনকি বদলিজনিত কারণে বাসা ত্যাগের সময় দামি পেইন্টিংসও নিয়ে গেছেন। এতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৮ লক্ষাধিক টাকা।
মিশনের জন্য স্থায়ী দূতাবাস নির্মাণ প্রকল্পের জমি ক্রয়ের টাকা স্থায়ী আমানত হিসাবে ব্যাংকে রেখে তা থেকে লভ্যাংশ সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি (৯ হাজার ডলার) নিজের পকেটস্থ করেন রাষ্ট্রদূত মনিরুল।
কোথাও ভ্রমণে না গিয়ে সাদা কাগজে ভ্রমণবিল বানিয়ে প্রায় ১৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। রাষ্ট্রদূতের গাড়িচালক শুক্কুর মিয়া লিখিতভাবে অভিযোগ জানিয়েছেন, অপ্রচলিত ও অগ্রহণযোগ্য ভাউচারের মাধ্যমে সাড়ে ৩৩ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এমনকি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের নামে ভুয়া ভ্রমণ বিল বানিয়ে ৭ লক্ষাধিক টাকা নেওয়া হয়েছে। লেবার উইংয়ের কাউন্সিলর ইসমাইল হোসেন বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ দেখিয়ে ৪ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
সূত্র জানায়, লেবার উইংয়ের নামে প্রায় ২ কোটি টাকার বিপরীতে অর্জন শূন্য। কার্যক্রম বলতে ১৭টি ইমেইল করেছেন কর্মকর্তারা। এমনকি এই উইংয়ের জন্য আসাববপত্র ক্রয় দেখিয়েও অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। অ্যাকাউন্ট পে-চেকের মাধ্যমে লেনদেনের নিয়ম থাকলেও দুই অর্থবছরের প্রায় পুরো টাকাই নগদ অর্থ অথবা ক্যাশ চেকের মাধ্যমে করা হয়েছে। নগদ অর্থ উত্তোলনের নির্দিষ্ট সীমা থাকলেও তা ভঙ্গ করা হয়েছে। এ খাতে অনিয়ম হয়েছে সাড়ে ১৪ কোটি টাকার বেশি। কপ-২৭ সামিটে ভিভিআইপিদের জন্য হোটেল শার্ম আল শেখে বিলাসবহুল স্যুট ভাড়া করা হলেও এর বিপরীতে হোটেলের কোনো প্রমাণ জমা দেওয়া হয়নি। এর বিপরীতে ৪৩ লক্ষাধিক টাকা তছরুপ করা হয়েছে।
নেইবারহুড চার্জের নামে কয়েক লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করেন রাষ্ট্রদূত। এতে সহযোগিতা করেন সোশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রাদওয়া তারেক। একই কাজ করতে না চাওয়ায় প্রাক্তন সোশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট নাহলা মোহাম্মদ কামেলকে অপবাদ দিয়ে চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ রয়েছে। অ্যাকাউন্ট পে-চেকের মাধ্যমে বাসা ভাড়া প্রদানের নিয়ম থাকলেও তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ক্যাশ চেকের মাধ্যমে ডলার উত্তোলন করে তা মিশরীয় মুদ্রায় পরিশোধ করা হয়েছে। খোলাবাজারে ডলার বিনিময় হার ব্যাংকের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি হওয়ায় তা বিক্রি করে অবৈধ সুবিধা আদায় করা হয়েছে।
এ ছাড়া এই দুই অর্থবছরে ১৪টি জাতীয় দিবস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিবস পালনের নামে ২৫ লক্ষাধিক টাকা তছরুপ করা হয়েছে। এসব অনুষ্ঠানের বেশিরভাগ ভাউচারই হাতে লেখা। দিবস পালনের জন্য হোটেল হলিডে ইনের নামে আড়াই লাখ টাকার ভুয়া ভাউচার বানানো হয়েছে। আতাউল হক কম টাকার বাসার ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ দেখিয়ে বাকি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ বাবদ প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার ডলার বা সাড়ে ১৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
দূতাবাস সূত্রে জানা যায়, আপ্যায়ন বিলের নামে অর্থ তছরুপ করা হয়েছে। এমনকি মনিরুল এন্টারটেইন এলাউন্স প্রাপ্তির পরও রেস্তোরাঁর বিল দূতাবাস পরিশোধ করেছে। অস্তিত্বহীন স্থানীয় কর্মচারী দেখিয়ে ১১ লক্ষাধিক টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। রাশা রাঘব আবদেল লাতিফ নামে একজন ক্লিনারকে নিয়োগ দেখিয়ে প্রতি মাসে সেই টাকা মনিরুল উত্তোলন করেছেন। এমনকি রাষ্ট্রদূত মনিরুল সরকারি খরচে ফাইজুল ইসলাম ও দেলোয়ার হোসেন নামে দুজন গৃহভৃত্য মিশরে নিয়ে গিয়ে মিশনের স্থানীয় কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেখিয়ে প্রায় সাড়ে ৩২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
অভিযোগের মধ্যে আরও রয়েছে, পিও রফিকুল ইসলামের সন্তান পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে অধ্যয়নরত দেখিয়ে শিক্ষা ভাতা বাবদ প্রায় ১৩ লাখ টাকা ক্লিনারের নামে চেক দিয়ে উত্তোলন করা হয়েছে। রেজাউল ইসলাম খানের সন্তানের নামে ভুয়া স্কুল বিল দেখিয়ে ১০ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করেছেন। রাষ্ট্রদূত চিকিৎসা বাবদ ৩ লক্ষাধিক টাকা গ্রহণ করেছেন, তার বিপরীতে প্রেসক্রিপশন পর্যন্ত জমা দেওয়া হয়নি। একই পদ্ধতিতে ভুয়া প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে রেজাউল করিম, রফিকুল ইসলাম, ফারুক হোসেন এমনকি অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। অনিয়মিত জ্বালানি ক্রয়, বই ক্রয় বাবদ অর্থ উত্তোলন করা হলেও বইয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই। কম্পিউটার মেরামত, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ ক্রয় যেন এই প্রতিষ্ঠানের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। এ খাতে কয়েক লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। কনফারেন্স টেবিল, বিছানার চাদর ক্রয় করেও অর্থ তছরুপ করা হয়েছে।
এ-সংক্রান্ত এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও মিশন নিরীক্ষা দলের সদস্যরা অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন। প্রতিবেদনে নিরীক্ষা আপত্তিগুলো নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও আলোচনা চলমান বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ নাজমুল হক বলেন, কোনো লিখিত অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। আর নিরীক্ষা প্রতিবেদন চাকরিজীবনে স্বাভাবিক বিষয়, সবাইকেই মুখোমুখি হতে হয়। সুস্পষ্ট কোনো অভিযোগ থেকে থাকলে এবং সেগুলো নিষ্পত্তি না হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রয়েছে। এজন্য যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকেই এর নিষ্পত্তি করতে হবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post