বিশ্বের ১৭০টি দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন প্রায় এক কোটি বিশ লাখ রেমিট্যান্স যোদ্ধা। আমাদের এবারের আয়োজন এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের নিয়ে বিশেষ পর্ব “প্রবাসীর ঈদ করোনার বিষে নীল” বিশ্বের ১৭০টি দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন প্রায় এক কোটি বিশ লাখ বাংলাদেশি। উন্নত জীবনের স্বপ্ন বুকে নিয়ে কত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তারা ভিনদেশে পাড়ি জমিয়েছেন শুধুমাত্র প্রিয়জনদের নিয়ে একটু ভালো থাকার জন্য।
তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, সংসার-ব্যয়ের ছুটে চলা ঘোড়ার লাগাম ধরার জন্য। একাকী নিঃসঙ্গ প্রবাস জীবনে কত সব জটিলতা পেরিয়ে চলতে হয় এই প্রবাসীদের। অথচ সেসব আড়াল করে রাখেন প্রিয়জনদের কাছে, যাদের সুখের জন্য তাদেরই ছেড়ে পড়ে আছেন একাকী প্রবাস জীবনে। আর তাই তো প্রতিটি প্রবাসী সত্যকে আড়াল করে প্রতিনিয়তই মিথ্যা বলে যান পরিবারের কাছে।
নিজে না খেয়েও বলেন খেয়েছি। ঈদে পুরনো জামা পড়ে ঈদের নামাজ পড়ে শুয়ে চোখের জ্বল মুছেন আর প্রিয়জনকে শুনান নতুন জামার গল্প। প্রবাসীর পাঠানো টাকায় পরিবারে নানা রকম রান্নার আয়োজন হলেও এই প্রবাসী বিদেশে কি খান তা একমাত্র রেমিট্যান্স যোদ্ধারাই জানেন। অনেকেই ডাল আর আলু ভর্তা খেয়েও পরিবারে বলেন অনেক কিছু খেয়েছি।
এভাবেই মিথ্যা বলে বলে হয়ে উঠেন একজন প্রবাসী সেরা অভিনেতা। নিজেদের হাজারো কষ্ট আড়াল করে তারা ভালো থাকার অভিনয় করেন পরিবারের মাঝে। কষ্টার্জিত টাকা দেশে পাঠালেও কষ্টের গল্পগুলো আড়াল করে রাখেন। কিন্তু এবার বোধহয় আড়ালের গল্পগুলো এতটাই তীব্র আঘাত হেনেছে যে, তা আর চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব না। করোনার বিষাক্ত ছোবলে প্রবাসী কর্মীরা অনেকটাই দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে ঈদ এগিয়ে আসায় চোখে অন্ধকার দেখছেন তারা।
করোনা ভাইরাস মহামারীতে বিশ্বজুড়ে লকডাউন ও অচলাবস্থার কারণে বহুমাত্রিক সংকট দেখা দিয়েছে বৈদেশিক শ্রমবাজারে। প্রবাসে কর্মরত অধিকাংশ বাংলাদেশি বেতন পাচ্ছেন না। অনেকে ছাঁটাই এবং মজুরি হ্রাসের কবলে পড়েছেন। এ এক দুর্বিষহ জীবন যাপন।
প্রবাসে কর্মরত এক কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশির মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশেরই কর্মসংস্থান মধ্যপ্রাচ্যে। করোনা সংকটে চাকরি হারানো প্রবাসী ছাড়াও অবৈধভাবে বসবাসকারী বিপুলসংখ্যক কর্মীর দেশে ফেরার আশঙ্কা করছে সরকার। এরই মধ্যে কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহরাইন মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশি কর্মী ফেরত আসছে। করোনা মহামারীর পরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি ফিরবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রবাস জীবনের কষ্টটা একটু অন্য ধরনের। সব আছে, তবু যেন কিছুই নেই। ঈদ আসে, ঈদ যায়; কিন্তু প্রবাসীদের ঈদ কাটে নিঃসঙ্গতায়। এমনিতেই পরিবার আর আত্মীয়স্বজনদের ছেড়ে প্রবাসের একাকীত্বে কেটে যায় ঈদের দিনটি। তার ওপর এবার করোনা মহামারী প্রবাসীদের কষ্টকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
এর পরও অনেকে সমস্যা আড়াল করেই মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানের ঈদ উদযাপনে টাকা পাঠিয়েছেন। যারা বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন, তাদের নিজেদেরই ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটি থেকে যায় উৎসবহীন। কিন্তু এর পরও জীবন থেমে থাকে না। পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি দেখেই সব ভুলে যান সব দুঃখ বেদনা।
বেশ কয়েকজন ওমান প্রবাসীর সঙ্গে তাদের ঈদ ভাবনা নিয়ে কথা হয়। প্রবাস টাইমের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানিয়েছেন ঈদ অনুভূতির কথা। আর তাতে উঠে এসেছে পরিবারকে কাছে না পাওয়ার কষ্ট আর যন্ত্রণার সুর। বিদেশ যেয়ে চাকরি করে অনেক টাকাপয়সা বাড়িতে পাঠাবে, দুঃখের ছায়ার পরিবর্তে সুখের আলোয় সংসার উজ্জ্বল হবে এ প্রত্যাশা বুকে নিয়ে প্রবাসে আসা মানুষগুলোর স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে করোনা।
কিন্তু তার পরও জীবন থেমে থাকে না। এবারও ঈদের দিন সকালে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় হাসিমুখে তারা বলতে চাইবেন, ভালো আছেন, সুখে আছেন। বুকের ভেতর চেপে কষ্ট-যন্ত্রণা। মনে গুমড়ে উঠবে অব্যক্ত আর্তনাদ; চোখের কোনে জল। সযত্নে প্রিয়জনদের কাছে আড়াল করা গল্পগুলোর কষ্ট বুকে কেটে যাবে ঈদের পুরোটা দিন। কষ্ট বুকে নিয়েই কাজ খুঁজবেন তারা, পরিবারের সুখের আশায়; যে স্বপ্ন নিয়ে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছেন তা পূরণের প্রত্যাশায়।
ঈদ আসলে মন খারাপ হতে শুরু করে প্রবাসীদের। রাত পোহালেই সকাল বেলা ঘুম ভেঙে আশপাশে যখন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না তখন নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসে। মনে পড়ে যায় চিরোচেনা গ্রামে ঈদ উদযাপনের স্মৃতিগুলো। ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার জন্য মায়ের বকুনি, মা-বাবাকে সালাম করে ঈদের নামাজ আদায় করতে যাওয়া, পশু কোরবানি করা, বাড়ি বাড়ি সেমাই, পায়েস, চটপটি খাওয়া, তারপর দিনভর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা এসব স্মৃতি মনে করে চোখের কোনটা ভিজে আসে।
ভিসা জটিলতা, আর্থিক সমস্যা নানা কারণে ইচ্ছে থাকলেও অনেকেই দেশে যেতে পারেন না। এমন লাখো প্রবাসী রয়েছেন পৃথিবীর নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। যারা বছরের পর বছর দেশের স্মৃতি নিয়ে প্রবাসে ঈদ উদযাপন করছেন। প্রতিনিয়ত কষ্টে থেকেও স্বজনদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলে যাচ্ছেন। রমজানের ঈদের পরিবারের সবার জন্য নতুন জামা কাপড় নিলেও পুরাতন জামায় ঈদের জামাতে ও ঈদ পালন করেন বেশির ভাগ প্রবাসী।
ঈদের নামাজ শেষে দেশে ফোন করার পর বুকের ভেতর কষ্টের তীব্রতা যেন আরও বেড়ে যায়। বুকফাটা যন্ত্রণাকে বুকে নিয়ে বিছানায় গিয়ে চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেন অনেকে। এরপর দুপুর গড়িয়ে পুবের সূর্যটা পশ্চিমে হেলতে শুরু করে।
বিছানা ছেড়ে দু-একজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সামান্য আনন্দের প্রত্যাশায় অজানার উদ্দেশে ছুটে যান। এভাবেই কেটে যায় প্রবাসীদের ঈদ নামের নিঃসঙ্গ বেদনার দিনটি। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য রইলো প্রবাস টাইমের পক্ষথেকে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা ও স্যালুট। ভালো থাকুক আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা, সেই প্রত্যাশায় আজকের মত বিদায় নিচ্ছি। সবাইকে ঈদ মুবারক। আল্লাহ হাফেজ……
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post