আবারো বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি থেকে স্থানান্তরের খবর পাওয়া গেছে। দিল্লি সংবাদদাতা রঞ্জন বসু এক প্রতিবেদনে বলেছেন, হাসিনাকে রাজধানী দিল্লি থেকে উত্তর প্রদেশ মিরাটের সেনানিবাস বা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি গোপন ঠিকানায় ‘মুভ’ করানো হয়েছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দিল্লির কেন্দ্রস্থল থেকে মিরাটের দূরত্ব মোটামুটিভাবে ৮৩ কিলোমিটার, অর্থাৎ ৫০ মাইলের অল্প বেশি। এ ধরনের খবর জনকণ্ঠের অনলাইনেও প্রকাশ পেয়েছে। তবে কোনো ভারতীয় মিডিয়া এমন খবর দেয়নি।
রঞ্জন বসুর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, মিরাট সেনানিবাস এলাকায় একটি আধাসামরিক বাহিনীর (খুব সম্ভবত ‘র্যাফ’ বা র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স) একটি গেস্ট হাউজ বা অতিথি নিবাসে হাসিনাকে রাখা হয়েছে বলেও বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
দিল্লিতে শীর্ষ নিরাপত্তা সংস্থার নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, ভিভিআইপি অতিথি’র সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনায় দিল্লি থেকে তাকে আপাতত সরিয়ে নেয়া হয়েছে। অক্টোবরের প্রথম দিকেই, মোটামুটি দিন পনের আগেই এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছেন, যদিও এই ‘মুভ’ নিয়ে বিস্তারিত খুব বেশি কিছু জানা যাচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনা ভারতে এসে নামার পর থেকে কোথায় আছেন বা কিভাবে আছেন তা নিয়ে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত একটিবারের জন্যও কিছু জানায়নি। তার এ দেশে অবস্থানের পুরো বিষয়টিই কঠোর গোপনীয়তায় মুড়ে রাখা হয়েছে।
শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানাও তার সাথেই মিরাটে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, যদিও এই বিষয়টি কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।
গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি সামরিক এয়ারক্র্যাফটে করে দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করেন শেখ হাসিনা। তাকে সেখানে স্বাগত জানান ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। প্রথমে ভারতের ধারণা ছিল দিল্লিতে খুব অল্প সময় থেকেই শেখ হাসিনা লন্ডনের উদ্দেশে পাড়ি দেবেন, তাই প্রথমে তাকে ওই বিমানঘাঁটির টার্মিনাল ভবনেই রাখা হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনাকে আসতে দিতে ব্রিটেন তখন রাজি না-হওয়ায় ভারতকে সেই পরিকল্পনা বদলাতে হয়।
হাতেগোনা কিছু কমার্শিয়াল ফ্লাইট মাঝেসাজে ওঠানামা করলেও গাজিয়াবাদের ‘হিন্ডন’ মূলত ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি ঘাঁটি, সেখানে ভিভিআইপি অতিথিদের লম্বা সময়ের জন্য থাকার খুব একটা সুব্যবস্থা নেই।
যখন এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে খুব চট করে শেখ হাসিনার তৃতীয় কোনো দেশে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না, তখন দু-চার দিনের ভেতরেই তাকে সরিয়ে আনা হয় দিল্লিতে (বা দিল্লির একেবারে লাগোয়া) একটি ‘সেফ হাউজে’। এরপর বেশ কিছু দিন তিনি সেই ঠিকানাতেই ছিলেন।
মাঝে দিল্লিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে কর্মরত মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের বাসভবনে মেয়ের সাথেই শেখ হাসিনাকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জল্পনা ছিল কিন্তু সেটাও শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি কখনোই। তবে দিল্লিতে তিনি যেখানেই থাকুন সংবাদমাধ্যমের নজর এড়িয়ে, নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা বজায় রেখে এই ভিভিআইপি অতিথিকে দেশের রাজধানীতে রাখাটা যে খুব কঠিন, সেটা ভারত সরকার উপলব্ধি করে দিন কয়েকের মধ্যেই।
তা ছাড়া খুব চট করে যে ভারত থেকে তার বাইরের কোনো তৃতীয় দেশে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না, সেটাও ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হতে থাকে। তখন থেকেই ভাবনাচিন্তা শুরু হয়, দিল্লির বাইরে কোথায় তাকে উপযুক্ত ব্যবস্থায় রাখা যেতে পারে। এরপর নানা ‘অপশন’ চুলচেরা বিচার-বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত মিরাটের ঠিকানাটি চূড়ান্ত করা হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি মিরাট ক্যান্টনমেন্ট ২০০ বছরেরও বেশি পুরনো, এটি নির্মিত হয়েছিল ১৮০৬ সালে। এমনকি ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহেও এই সেনানিবাসের বড় ভূমিকা ছিল।
রাজধানী দিল্লির খুব কাছে অবস্থিত মিরাটের সেনানিবাস আধুনিক ভারতের স্ট্র্যাটেজিক নিরাপত্তার দিক থেকেও খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে সামরিক পর্যবেক্ষকরা বলে থাকেন।
আসলে উত্তর প্রদেশের মিরাট শহরটি দেশের সবচেয়ে উর্বর প্রান্ত, গঙ্গা ও যমুনা নদীর অববাহিকার মধ্যবর্তী এলাকা বা ‘দোয়াবা’তে অবস্থিত। ঐতিহাসিকভাবে মুঘল আমল বা তারও অনেক আগে থেকে এই অঞ্চলটিতে প্রচুর খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়, ফলে রাজস্বও আদায় হয় বিপুল। ব্রিটিশরাও ঠিক এই কারণেই মিরাটে ক্যান্টনমেন্ট স্থাপন করেছিল।
আজকের মিরাট ক্যান্টনমেন্ট এলাকা অবশ্য অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে, তার ভেতরে বেসামরিক স্থাপনাও অনেক তৈরি হয়েছে। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টে এমন অনেকটা অংশ আছে, যেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। সেনাবাহিনী ছাড়াও বিভিন্ন এলিট ফোর্স বা আধা-সেনা সংস্থারও কার্যালয় আছে সেখানে।
শেখ হাসিনাকে সেনানিবাসের এরকমই একটা নিরাপত্তায় মোড়া ‘সেক্লুডেড’ বা জনবিচ্ছিন্ন এলাকাতেই রাখা হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post