রমজান পাপ মোচনের মাস। ক্ষমা লাভের মাস। এ মাসে আল্লাহ ক্ষমার দুয়ার অবারিত করে দেন। রোজার বিনিময়ে বান্দার গুনাহ মাফ করেন। তারাবি আদায়ে মুছে দেন সব আবিলতা। অন্যকে সাহরি-ইফতারে শরিক করালে দেন ক্ষমার সঙ্গে অবারিত নেকি। রমজানের প্রতিটি মুহূর্তই বরকতপূর্ণ ও ক্ষমা লাভের স্বর্ণসময়।
বিশেষত শেষ দশক হলো— এ মাসের সবচেয়ে গুরুত্ববহ সময়। এ সময়ে নবীজি (সা.)-এর ইবাদত-বন্দেগি হতো বছরের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এমনকি রমজানের প্রথম বিশদিন থেকেও আলাদা বোঝা যেতো— শেষ দশদিনের ইবাদত-নিমগ্নতা। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) রমজানের শেষ দশকে এতো ইবাদত করতেন, যা বছরের অন্য সময়ে করতেন না। (মুসলিম, হাদিস : ১১৭৫)
তিনি আরও বলেন, ‘যখন রমজানের শেষ দশক আসতো— নবীজি তখন ইবাদতের জোর প্রস্তুতি নিতেন, নিজে রাত্রি জাগরণ করতেন এবং পরিবার- পরিজনকে জাগিয়ে তুলতেন।’ (বুখারি, হাদিস : ২০২৪)। শেষ দশকের ইবাদতের অন্যতম হলো— শবে কদর তালাশ করা। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কদর রাতের সন্ধান পেতে চায় সে যেনো রমজানের শেষ দশকে খুঁজে নেয়।’ (বুখারি, হাদিস : ১১৫৮)
আয়েশা (রা.) নবীজিকে বললেন, যদি আমি শবে কদর পেয়ে যাই— তাহলে কি দোয়া করবো?। নবীজি শেখালেন এই দোয়া— ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওবুন তুহিব্বুল আফওয়া ফাআফু আন্নি। অর্থাৎ : ‘হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমাকারী, ক্ষমা করতে আপনি পছন্দ করেন। অতএব আমায় ক্ষমা করুন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫১৩)
লাইলাতুল কদরের কল্যাণ যেনো আমাদের ছুঁয়ে যায়। তাই নবীজি (সা.) শেষ দশকে ইতেকাফের আমল দিয়েছেন। গুরুত্বের সঙ্গে অন্যকেও আমল করা শিখিয়েছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবীজি শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন, আর বলতেন- তোমরা এই দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো।’ (বুখারি, হাদিস : ২০২০) তিনি আরও বলেন, নবীজি তার ইন্তেকাল পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন, তারপর তাঁর স্ত্রীগণও ইতিকাফ করেছেন। (বুখারি, হাদিস : ২০২৬)
শেষ দশকের অন্যতম আমল সদকাতুল ফিতর আদায় করা। সামর্থ্যবান প্রতিজন নারী-পুরুষ ছোট-বড় সবার জন্য রাসুল (সা.) এটা ফরজ করেছেন। সেই সঙ্গে নির্দেশ করেছেন— যেন তা ঈদুল ফিতরের নামাজের পূর্বেই আদায় করা হয়। (বুখারি, হাদিস : ১৫০৩) ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নবীজি সদকাতুল ফিতর নির্ধারণ করেছেন— যাতে করে এটা রোজাদারের রোজার বিচ্যুতি তথা অনর্থক কথা-কাজ ও অশালীন আচরণের ক্ষতিপূরণ হয় এবং অসহায় মানুষের খাবারের সুন্দর ব্যবস্থা হয়।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৬০৯)
দান বলতে কেবল ফরজ জাকাত আদায়-ই নয়; বরং নফল সদকাও দানের অন্তর্ভুক্ত। উপরন্তু এই প্রয়োজনীয়তাই বর্তমানে অধিক। কেননা জাকাতের নিসাবের মালিক সবাই হয় না; কিন্তু নফল সদকা সবাই করতে পারে। আল্লাহ তাআলা প্রকাশ্যে ও গোপনে অধিক পরিমাণে দানের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘আমার যে বান্দারা ঈমান এনেছে, তাদের বলে দিন— তারা যেন সালাত আদায় করে এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে; এমন দিন আসার আগে— যখন কোনো ক্রয়-বিক্রয় কিংবা বন্ধুত্ব থাকবে না।’ (সুরা ইবরাহিম, হাদিস : ৩১)
এজন্য আল্লাহর রাসুল (সা.) সতর্ক করে বলেছেন, ‘খেজুরের এক টুকরা দিয়ে হলেও (দান করে) নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও।’ (বুখারি, হাদিস : ৭৫১২) অর্থাৎ কিয়ামতের দিন দুনিয়ার কোনো বন্ধুত্ব বা ক্রয়-বিক্রয় কোনো কাজে আসবেনা। এগুলোর মাধ্যমে নিজেকে মুক্ত করা যাবে না। একমাত্র নেক আমল সেদিন আল্লাহর মেহেরবানি ও রহমতের আহ্বায়ক হবে। আর আল্লাহর রহমত হলেই কেবল বাঁচা যাবে। আর সেই রহমত পাবার অন্যতম মাধ্যম হলো- দান-সদকা করা। যদি বেশি সামর্থ্য না থাকে, তাহলে অল্প হলেও করতে হবে। একটা আস্ত খেজুর দিতে না পারলে, অর্ধেক দান করা হোক— তবুও দান করা জরুরি।
এই হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষভাবে আমাদের শিখিয়েছেন যে, তোমার সামর্থ্য নেই লাখ টাকা বা এক হাজার টাকা দান করবার; কিন্তু দুই টাকা দানের সামর্থ্য আছে তো, সেটা কেন করছো না কেন? কে আটকে রেখেছে? যা আছে তা-ই দান করো। আর জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে বাঁচাও। তিনি আরও শিখিয়েছেন, দান করে নিজের গুনাহ মাফ করিয়ে নাও। তিনি বলেছেন, ‘সদকা গুনাহকে সেভাবে মিটিয়ে দেয়, যেভাবে পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়। (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ২২১৩৩)
তিনি জানিয়েছেন গোপন সদকা মহান রব আল্লাহর ক্রোধ প্রশমিত করে। হাদিস এসেছে, ‘নিশ্চয় গোপন সদকা রবের ক্রোধকে প্রশমিত করে।’ (তাবারানি, হাদিস : ১০১৮; তারগিব, হাদিস : ৮৮৮) এই গুনাহের মহামারির যুগে আমরা সবাই কম বেশি গুনাহে আক্রান্ত। নিজেদের গুনাহগুলোকে ক্ষমা করাতে আল্লাহ তাআলার ক্রমাগত নাফরমানি থেকে বাঁচতে এবং তার ক্রোধ হতে মুক্তি পেতে তাই দান-সদকা করা অত্যন্ত জরুরি।
বিশেষ করে এখন তো চারিপাশে করোনার ব্যাপক প্রকোপ রয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। এই অবস্থায় আল্লাহ না করুন, কেউ যদি আক্রান্ত হয়— তার দুনিয়াবী চিকিৎসার যতটা প্রয়োজন রয়েছে, তার চাইতে বেশি আল্লাহর মেহেরবানির প্রয়োজন রয়েছে। তিনি তাওফিক না দিলে— দুনিয়ার কেউ আক্রান্ত রোগীকে শিফা বা সুস্থতা দিতে সক্ষম নয়। তাই তো আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের রোগীদের সাদাকাহর মাধ্যমে চিকিৎসা করো।’ (সহিহুল জামি, শাইখ নাসিরুদ্দিন আলবানি; হাদিস : ৩৩৫৮)
অর্থাৎ রোগীর রোগমুক্তির নিয়তে বেশি বেশি দান করো। তাহলে আল্লাহর মেহেরবানি হবে। ইনশা আল্লাহ রোগমুক্তি ঘটবে। এছাড়াও একটি দুর্বল সনদের হাদিসে একথাও রয়েছে, ‘দান সত্তর প্রকার বিপদকে প্রতিহত করে।’ (আল জামিউস সগির, ইমাম সুয়ুতি; হাদিস : ৭৯৮৪)
মনে রাখতে হবে এই রমজানে যে নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারলো না— সে নিঃসন্দেহে হতভাগ্য। তাই জিবরিল (আ.) এসে আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে যখন বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ, যে রমজান পেল, কিন্তু ক্ষমা পেল না— আল্লাহ তাকে (স্বী রহমত হতে) দূর করে দেবেন (বলুন আমিন)’। তিনি তখন বললেন, “আমিন”। (ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৪০৯)
অর্থাৎ রমজানে নিজের গুনাহ মাফ করাতে না পারলে, আল্লাহ থেকে দূর হয়ে যেতে হবে। আর এটা আল্লাহর অভিপ্রায় এবং এই দোয়ায় রাসুল (সা.) আমিন বলেছেন। কত কঠিন ও দুশ্চিন্তার কথা। তাই আসুন প্রিয় পাঠক রমজানের এই শেষ দশক আমরা আমলে পূর্ণ করে ফেলি। অধিক ইবাদত ও অবশ্যই অধিক পরিমাণে সদকা করি। যেন এই রমজানেই আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা পেতে পারি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমিন।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post