‘আর যদি আমার কোনো ভাইকে হত্যা করা হয়, আবার যদি গুলি চলে, আর যদি কোনো ভাইয়ের রক্ত ঝরে, তাহলে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া গোটা বাংলাদেশ অচল করে দেওয়া হবে।’
রোববার (২৮ মার্চ) হেফাজতে ইসলামের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল চলাকালে দুপুর পৌনে ১টায় বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে এ কথা বলেন হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগরের সহসভাপতি ও খেলাফত মজলিশের শায়খুল হাদিস মামুনুল হক বলেছেন,
মামুনুল হক বলেন, ‘আজ হেফাজতের হরতাল কর্মসূচি ছিল, আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচি ছিল না। তবু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মাঠে দেখা গেছে আওয়ামী পান্ডাদের। আমার শান্তিপ্রিয় ভাইদের ওপর পুলিশ-বিজিবি নির্বিচারে গুলি ছুড়েছে। মধুপুড়ের বর্ষীয়ান আলেম হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা আবদুল হামিদ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এটা কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করল। মনে রাখবেন, এভাবে গুলি করে হেফাজতকে দমানো যাবে না, বরং আপনি আপনার গদি টেকাতে পারবেন না।’
মামুনুল হক প্রশ্ন রাখেন, ‘হাটহাজারীতে, বি.বাড়িয়ায় আমার ভাইয়ের রক্ত পান করেছেন, পির সাহেবকে রক্তাক্ত করেছেন, নির্বিচারে গুলি ছুড়ছেন- এরপরেও কি আপনাদের রক্ত পিপাসা মেটেনি? এভাবে গোটা বাংলাদেশের জনগণকে খুন করে আপনারা কি রামরাজত্ব চালাতে চান?’
তিনি বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছি। রক্ত ঝরিয়ে রাজপথ থেকে হেফাজত কর্মীদের সরানো যাবে না। আবার যদি আমার কোনো ভাইয়ের রক্ত ঝরে, হত্যা করা হয়, আর একটি গুলিও যদি ছোড়া হয়, তাহলে গোটা দেশকে অচল করে দেওয়া হবে।’
তিনি নেতাকর্মীদের বিশৃঙ্খলা না করা এবং বহিরাগতদের ফাঁদে পা না দিয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানান। বিক্ষোভ কর্মসূচিতে আরও বক্তব্য রাখেন হেফাজত নেতা মুফতি সাখাওয়াত হোসেন রাজি এবং জোনায়েদ আল হাবিব।
এদিকে হরতালের সমর্থনে আজ ঢাকা-চট্টগ্রামের প্রবেশমুখ সাইনবোর্ড এলাকায় পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসময় ৪ গাড়িতে আগুন ও শতাধিক গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে শাকিল (২৫) নামে একজন ফার্নিচার মিস্ত্রি গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
জানা গেছে, ১০ নেতাকর্মী নিহতের প্রতিবাদে ডাকা হরতালের সমর্থনে আজ সকাল থেকে বিদ্যুতের খুঁটি ফেলে ও টায়ার জ্বালিয়ে মহাসড়কটি অবরোধ করে রাখে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী। এতে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বেলা ১১টার দিকে পুলিশ বিজিবির সদস্যরা তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে বিজিবির সদস্যরা। এসময় উভয়পক্ষে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ শুরু হয়।
সংঘর্ষের এক পর্যায়ে শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করে হেফাজত কর্মীরা। এ ঘটনায় একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন জানা গেছে। থেমে থেমে চলে সংঘর্ষ। হেফাজতে ইসলামের সহ¯্রাধিক কর্মী ওই এলাকায় অবস্থান করে। বেশকিছু দূরে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা অবস্থান করে। এদিকে বেলা ১২টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর ব্রিজ এলাকায় ৪ গাড়িতে আগুনের দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে মুহূর্তেই গাড়িগুলো সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়।
ওদিকে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে বেলা পৌনে ২টায় পুলিশ বিজিবির যৌথ অভিযানে সাইনবোর্ডের মূল সড়ক থেকে পিছু হটে হেফাজত কর্মীরা। এসময় মুহুর্মুহু রাবার বুলেট ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে হেফাজত কর্মীদের ধাওয়া করে। হেফাজট নেতাকর্মীরা পিছু হটার পর সাইনবোর্ড থেকে সানারপাড় পর্যন্ত এলাকা পুলিশ-বিজিবি নিয়ন্ত্রণে নেয়। এসময় আরও কয়েজন গুলিবিদ্ধ হয়। দুটি এম্বুলেন্সযোগে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে পুলিশের সঙ্গে হেফাজত কর্মীদের সংঘর্ষে আজ আরো দুই জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে কালন মিয়ার বাড়ি উপজেলার বুধল ইউনিয়নের খাটিহাতা গ্রামে। তার বড় ভাই মাওলানা আবদুর রহিম গণমাধ্যমকে বলেন, পুলিশের গুলিতে তার ভাই নিহত হয়েছেন। নিহত আরেকজন হলেন উপজেলা সদরের কুট্টাপাড়া গ্রামের সুফি আলীর ছেলে আল আমীন । হাসপাতালে নেয়ার পর সে মারা যায়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আজ বেলা ১১টার কিছু পর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে সরাইল বিশ্বরোড মোড়ে খাটিহাতা হাইওয়ে থানার সামনে জলকামানে অগ্নিসংযোগ করেন হরতাল সমর্থকরা। এসময় হাইওয়ে থানায়ও হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশ গুলি চালায়।
সবকিছু মিলিয়ে ঘটনাবহুল একটি হরতাল ছিলো আজ। মিছিল, সড়ক অবরোধ, গাড়িতে আগুন, সংঘর্ষ, গুলি। কোথাও শান্তিপূর্ণ, কোথাও উত্তাপ। রাজধানী ঢাকার ভেতরের পরিস্থিতি ছিল মোটামুটি শান্ত। রাস্তায় যানবাহনের পরিমান ছিল কম। বেশ কয়েকটি এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন হরতাল সমর্থকরা। লালবাগে হেফাজত কর্মীরা সড়ক অবরোধের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। মোহাম্মদপুরের বসিলায় সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করেন হেফাজত কর্মীরা।
এ এলাকায় হরতাল বিরোধী ও সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। পল্টন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে হেফাজতে ইসলাম। এসময় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের কিছুটা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। দুপুরের দিকে এ এলাকায় বড় মিছিল করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
দিনভর সংঘাত আর উত্তেজনা ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, সানারপাড় এলাকায়। রাজধানীর প্রবেশপথে সকালেই অবস্থান নেন হেফাজতের নেতাকর্মীরা। একপর্যায়ে পুলিশ-বিজিবির সদস্যরা তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। শুরু হয় সংঘর্ষ। সংঘর্ষে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে দাবি করেছেন হেফাজত নেতাকর্মীরা। আহত হয়েছেন আরো কয়েকজন। সারা দিনই এ সড়ক ছিল হেফাজত সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে। তারা বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে ও আগুন দেয়। এসময় ঢাকার সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ থাকে। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে সিলেট ও চট্টগ্রামগামী কোন দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যেতে পারেনি।
ওদিকে গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকেও কোনো বাস ছাড়েনি। দোকানপাট-মার্কেট ও বিপনিবিতান খোলা ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংঘাতের কারণে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেটের রেল যোগাযোগ বন্ধ ছিল। হরতালকে ঘিরে কঠোর অবস্থানে ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেন পুলিশ, র্যাব, বিজিবির সদস্যরা। এপিসি জলকামান নিয়ে বিভিন্ন সড়কে টহল দেন তারা। এদিকে পুলিশের পাশাপাশি মাঠে ছিলেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তারা রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেন।
দেশের বিভিন্ন জেলায় পালিত হয়েছে হেফাজতে ইসলামের হরতাল কমসূচি। সবচেয়ে উত্তাপ ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে নগরজুড়ে। হামলা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার কার্যালয়ে। ভাঙচুরের পাশাপাশি সেখানে থাকা গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। গাড়ি ভাঙচুর করা হয় মৎস্য অফিসের। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে সদরের ভূমি অফিস। হামলা হয়েছে প্রেস ক্লাবে। আহত হয়েছেন প্রেস ক্লাব সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামি।
সকালে শহরের পীরবাড়ি এলাকায় পুলিশের সঙ্গে হেফাজত কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। একই সময়ে শহরের পৈরতলায় পুলিশ ও বিজিবির সদস্যদের সাথে সংঘর্ষ হয় হেফাজত সমর্থকদের। পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। হাটহাজারী-খাগড়াছড়ি মহাসড়কে খাল কেটে অবরোধ করেন বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসা ছাত্ররাসিলেট নগরীতে সকাল থেকেই হরতালের সমর্থনে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে অবস্থান নেন হেফাজতের নেতাকর্মীরা। এতে শহরের গণপরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শহরে সরকার সমর্থকদের সঙ্গে হেফাজত কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। সুনামগঞ্জে শহরের সড়কে অবস্থান নেন হেফাজতের কর্মীরা। ফেনী-নোয়াখালী সড়ক অবরোধ করেন হেফাজত সমর্থকরা। ওদিকে রাজশাহী মহানগরীর ট্রাক টার্মিনালে রাখা বিআরটিসির দুটি বাসে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post