সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার বিল ছাড়াও ঢাকা উত্তর সিটির কর্মকর্তারা খাওয়ার জন্য প্রতি কেজি বিস্কুট কিনছেন ৩৬০০ টাকায়। এছাড়া প্রতি কেজি কাজুবাদাম কিনছেন ৩১৫০ টাকায়। যা বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি অস্বাভাবিক। এভাবে বেশি দাম দেখিয়ে ভাউচার করে অর্থ লোপাট করা হতো ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে (ডিএনসিসি)। এমন লোপাটের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ডিএনসিসির কর্মকর্তারা।
দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জরুরি দাপ্তরিক তহবিল থেকে শুধুমাত্র আপ্যায়ন বাবদ মোট ১ কোটি ২০ লাখ ৫৯ হাজার ৭৯০ টাকা ব্যয় করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। এরসঙ্গে দু-একটি ক্ষেত্রে কাগজ কলম ও অন্যান্য ষ্টেশনারি ক্রয়ের তথ্যও যুক্ত করা হয়েছে।
দপ্তর সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে মোট সাতবার এই বিস্কুট কেনা হয়। এর মধ্যে পাঁচবার প্রতি কেজি বিস্কুট কেনা হয় ৩ হাজার ৬০০ টাকায়। বাকি দুবার কেনা বিস্কুটের দাম ছিল প্রতি কেজি ৩ হাজার ২০০ টাকা।
এছাড়া বছরের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসেই ৫-৬ কেজি করে বিস্কুট প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে কেনা হয়েছে। শুধু প্রধান নির্বাহীর দপ্তরে নয় অন্যান্য দপ্তরেও একইভাবে অস্বাভাবিক দামে বিস্কুট কেনা হতো। ওই সময় ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন সেলিম রেজা। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এমন কোনো খাত নেই যেখানে দুর্নীতি-লুটপাট হয়নি। সাবেক মেয়রের আত্মীয়রা দাপট দেখিয়ে জিম্মি করে রাখতেন কর্মকর্তাদের। সে সময় কেউ কোনো প্রতিবাদ বা কথা বলতে পারেননি। লুটপাটে সহযোগিতা না করলে বদলি ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
ডিএনসিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিভিন্ন সময় নানান দুর্নীতি হয়েছে। কিছু অসাধু কর্মকর্তারা এটা করেছে। তবে আন্তরিক ও সৎ অনেক কর্মকর্তাও আছেন। তারা কাজ করে যান কিন্তু অসাধুরা সেই সুনাম নষ্ট করে দেন। যারা এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিৎ। তাদের মুখোশ সবার সামনে উন্মোচন করা দরকার।
ডিএনসিসির দুর্নীতির কারিগর এপিএস ফরিদ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে নানা কর্মসূচির নামে ভুয়া ভাউচার করে অনিয়ম-দুর্নীতির কারিগর ছিলেন মেয়র আতিকুল ইসলামের একান্ত সহকারী সচিব (এপিএস) ফরিদ উদ্দিন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে- উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রোগ্রামের নামে অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে টাকা তুলে নিতেন তিনি।
২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে আগের সব প্রথা ভেঙে প্রথমবারের মত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে মুন্সীগঞ্জের একটি ব্যয়বহুল রিসোর্টে অনুষ্ঠিত হয় ডিএনসিসির বোর্ড সভা। সেখানে ডিএনসিসির সকল কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা দুদিন অবস্থান করেন। ঢাকা থেকে যাতায়াত করা হয় এসি বাসে। সেখানে সব খরচ বাবদ সিটি কর্পোরেশনের তহবিল থেকে খরচ করা হয়েছে ৬৪ লাখ ৮১ হাজার ২৬৫ টাকা।
শুধু এই রিসোর্টে বোর্ড সভা বা বনভোজন নয়, জাতীয় শোক দিবস, মেট্রোরেল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, জেলহত্যা দিবসের আয়োজনের ব্যয়ের পুরোটাই দেখানো হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন খাত থেকে। সংস্থাটি এসব খাতে সর্বমোট ব্যয় দেখিয়েছে ২ কোটি ৬৪ লাখ ৩৯ হাজার ২২৬ টাকা।
নথি থেকে জানা গেছে, ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বনানী কবরস্থানে আগমন উপলক্ষে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন শুধু প্যান্ডেল, গেট, লাইট বাবদ খরচ দেখিয়েছে ৪৯ লাখ ১১ হাজার ৬৮০ টাকা।
এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ও পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান উপলক্ষে খরচ দেখানো হয়েছে ৪০ লাখ ৩০ হাজার ৬৮১ টাকা, মেট্রোরেল উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এলাকায় ব্র্যান্ডিং সংক্রান্ত কাজ বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪১ লাখ ২১ হাজার ৬০০ টাকা। এসব অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে ভুয়া ভাউচার বানিয়ে বড় অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছেন এপিএস ফরিদ উদ্দিন।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের হিসেব রক্ষণ বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রোগ্রামের কথা উল্লেখ করে ব্যয়ের চেয়ে অস্বাভাবিক বেশি পরিমাণের টাকা উল্লেখ করে ভাউচার দিয়ে বিল নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। ক্ষমতাধর ব্যক্তি হওয়ার কারণে এই বিষয়ে কেউ কখনও কথা বলার বা আপত্তি করার সাহস করেনি। এমন সব ঘটনারই সঠিক তদন্তের মাধ্যমে বিচার হওয়ার উচিৎ। ভবিষ্যতে যেন কেউ এমন নয়-ছয় আর করতে না পারেন।
আত্মীয় চক্রের দাপট ছিল উত্তর সিটিতে
আতিকুল ইসলাম উত্তর সিটির মেয়র থাকাকালীন সময়ে তার আত্মীয় চক্রের দাপট ছিল সংস্থাটিতে। ২০২২ সালে ৫ জন উপদেষ্টা নিয়োগ দেন আতিকুল ইসলাম। তাদের মধ্যে চারজন বিশেষজ্ঞ থাকলেও নিজের বড় ভাইয়ের ছেলে ইমরান আহমেদ কোনও বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। আত্মীয় হওয়ার কারণে তিনি হয়ে যান মেয়রের উপদেষ্টা। এছাড়া উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সরাসরি নিয়োগ না দিলেও মেয়রের মেয়ে বুশরা আফরিন চিফ হিট অফিসার নিয়োগ পাওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
উত্তর সিটি কর্পোরেশনে মেয়র আতিকের ভাতিজা মেয়রের উপদেষ্টা ও ভাগনে ছিলেন ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রক। ভাগনে তৌফিক ডিএনসিসিতে পরিচিত ছিলেন দ্বিতীয় মেয়র হিসেবে। তার দাপটে চুপসে থাকতে হতো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
অন্যদিকে ২০২৩ সালের শুরুতে ডিএনসিসির ১৯তম বোর্ড সভায় বৃক্ষরোপণের জন্য শক্তি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে একটি চুক্তি অনুমোদন করে ডিএনসিসি। ওই চুক্তির অধীনে সবুজায়ন এবং পরিবেশ উন্নয়নে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। পরে সবুজায়ন সংক্রান্ত আরও একটি প্রকল্প দেওয়া হয় ওই শক্তি ফাউন্ডেশনকেই। এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী পরিচালক হুমায়রা ইসলাম। তিনি সাবেক মেয়র আতিকুলের শ্যালিকা। ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে এখানেও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে আত্মীয় চক্রকে।
অন্যদিকে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন, নিয়োগ, বদলি, বর্জ্য অপসারণ বাণিজ্যসহ ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতিতে যুক্ত ছিল আত্মীয় চক্র। মেয়রের ভাগিনা তৌফিকের মাধ্যমে ঠিকাদার ম্যানেজসহ সিটি কর্পোরেশনের প্রায় সব ধরনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা হতো। ঠিকাদার ও কর্মচারী-কর্মকর্তারা তাকে দ্বিতীয় মেয়র হিসেবেই চিনতেন।
অভিযোগ রয়েছে সাবেক মেয়র আতিকের আত্মীয় চক্রের নানা দুর্নীতি, অস্বাভাবিক হিসেবে অনুমোদন বা সহযোগিতা না করলে বদলি করে দেওয়া হতো কর্মকর্তাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএনসিসির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এমন কোনো খাত নেই যেখানে দুর্নীতি লুটপাট হয়নি। সাবেক মেয়রের আত্মীয়রা দাপট দেখিয়ে জিম্মি করে রাখতেন কর্মকর্তাদের। সে সময় কেউ কোনো প্রতিবাদ বা কথা বলতে পারেননি। লুটপাটে সহযোগিতা না করলে বদলি ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
আত্মীয় চক্রের বিষয়টি নিয়ে ডিএনসিসির সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের মন্তব্য নিতে বারবার কল করা হলেও তার ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ডিএনসিসির বিভিন্ন সময় সাবেক মেয়রের আত্মীয় চক্রের দুর্নীতি, প্রভাবসহ ডিএনসিসির বিভিন্ন খাতে লুটপাট, ভুয়া ভাউচার ও সার্বিক দুর্নীতির বিষয়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান ডিএনসিসির সবাই। ডিএনসিসির প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসানকে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে দাবি জানানো হয়েছে।
তিনি আশ্বস্ত করে বলেছেন, অনেক অভিযোগ এসেছে, এগুলো আমরা আমলে নিয়েছি। তবে এখনও কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। খুব দ্রুত এসব বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকেও যদি এসব তদন্তে কোনো উদ্যোগ নেয় আমরা সহযোগীতা করবো।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post