মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের পাসপোর্ট বিভাগের তিন কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে জিম্মি প্রবাসীরা। অভিযোগ উঠেছে, পাসপোর্ট অনুমোদন, সংশোধন ও বিতরণের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করেন তারা। সময় মতো পাসপোর্ট না পেয়ে ভিসাসহ নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশিরা।
অভিযুক্তরা হলেন– কাউন্সেলর (পাসপোর্ট ও ভিসা) মিয়া মোহাম্মাদ কেয়ামউদ্দিন, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মুহাম্মদ এমদাদ হোসাইন চৌধুরী ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের রেকর্ড কিপার (হাইকমিশনের অফিস সহকারী) মঞ্জিল হোসেন রাতুল।
জানা যায়, প্রতারণা এড়াতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ হাইকমিশন মালয়েশিয়ার উদ্যোগে ২০১৪ সালে আউটসোর্সিং কোম্পানি আইপিপিএল কনসোটোরিয়ামকে পাসপোর্ট সেবার দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতিটি এমআরপি ইস্যুর জন্য সার্ভিস চার্জ ৭৮ দশমিক ৪৮ রিঙ্গিত বা ১৮ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয়। আইপিপিএল কনসোটোরিয়ামকে বাদ দেওয়ার পর নতুন করে মালয়েশিয়াতে ইএসকেএলের সঙ্গে বাংলাদেশ হাইকমিশনের চুক্তি হয় ২০২৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। যা ই-পাসপোর্ট সেবা সুরক্ষা সচিবের মাধ্যমে উদ্বোধন হয়েছিল চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল এবং কার্যক্রম শুরু হয়েছিল একই বছরের ২৬ এপ্রিল। ইএসকেএলে ই-পাসপোর্টের সার্ভিস চার্জ লেবার এবং স্টুডেন্টদের জন্য মাত্র ৩২ রিঙ্গিত নির্ধারণ করা হয়। অথচ ২০১৩-১৪ সালে আউটসোর্সিং কোম্পানি ডেটা-এডজ আইপিপিএল এমআরপি পাসপোর্টের জন্য ১৮ ডলার চার্জ করতো যা ৮০ রিঙ্গিত এর সমান৷
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেক আবেদনকারী তাদের আবেদন নির্বিঘ্নে জমা দিতে পারায় ইএসকেএলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রবাসীরা।
কিন্তু কিয়াম অ্যান্ড গং এমআরপি পাসপোর্টকে উৎসাহিত করার কারণে প্রতি মাসে ১০ হাজারের অধিক এমআরপি আবেদন গ্রহণ করা হয়। এর বিপরীতে ই-পাসপোর্টকে নিরুৎসাহিত করার কারণে ই-পাসপোর্ট আবেদন গ্রহণ হয় মাসে মাত্র ২-৩ হাজার।
ইএসকেএল মূলত অ্যাপয়েনমেন্ট, ব্যাংকিং ও বায়োমেট্রিক এনরোলমেন্টের মতো প্রথম ধাপের কাজ করে। পরবর্তী ধাপের কাজ হাইকমিশনের পাসপোর্ট বিভাগের হাতে। দালালমুক্ত পরিবেশে মাত্র ৩২ রিঙ্গিতের বিনিময়ে প্রবাসীদের ই-পাসপোর্ট সেবা দেয় ইএসকেএল।
ভুক্তভোগীদের দাবি, দ্বিতীয় ধাপে এসে পাসপোর্ট পেতে ৩০০ থেকে ৫০০ রিঙ্গিত পর্যন্ত খরচ করতে হচ্ছে। হাইকমিশনের অসাধু কর্মকর্তারা দালালদের মাধ্যমে কৌশলে এ অর্থ আদায় করছেন। মঙ্গলবার মালয়েশিয়া প্রবাসী আবজাল হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, ৬ মে তিনি বায়োমেট্রিক করেও এখন পর্যন্ত ই-পাসপোর্ট পাননি। সময় মতো পাসপোর্ট না পেলে নানা পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হবে।
তাঁর মতোই চঞ্চল হোসেন ৯ মে ই-পাসপোর্ট পেতে আবেদন করেন। কয়েক সপ্তাহ ধরে অনলাইন সিস্টেমে এটি ‘অন দ্য ওয়ে’ দেখাচ্ছে। আর গৌতম শীল ৮ জুন ই-পাসপোর্টের বায়োমেট্রিক সম্পন্ন করেন। ২৬ জুন ঢাকা থেকে অনলাইন স্ট্যাটাস শিফট দেখা পর্যন্ত পাসপোর্ট হাতে পাননি গৌতম। চঞ্চল ও গৌতম বসবাসের জন্য মালয়েশিয়ায় ‘অবৈধ’ হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন জানিয়ে বলেন, হাইকমিশনই আমাদের বিপদে ফেলেছে। দীর্ঘদিনেও পাসপোর্ট দিচ্ছে না। কখন পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়, সে আতঙ্কে রয়েছি।
হাইকমিশনের দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা জানান, অন দ্য ওয়ে অর্থ ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে আবেদনকারী পাসপোর্ট হাতে পাবেন। অনলাইন ইনপুট দিলেই স্ট্যাটাস চেঞ্জ হয়। কার অবহেলায় পাসপোর্টের স্তূপ জমেছে, তা তিনিও জানেন না।
ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, এক সপ্তাহে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনে ১ হাজার ১৪৯ জনের এনরোলমেন্ট হয়েছে। এসব আবেদন হাইকমিশন থেকে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় সার্ভারে না পাঠালে, ঢাকা থেকে পাসপোর্ট তৈরির কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।
সূত্র জানায়, হাইকমিশনের পাসপোর্ট বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে পাসপোর্ট সেবা। ১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্ট সেবা চালুর পর থেকেই বেঁকে বসেছেন তারা। কেউ গেলে, ই-পাসপোর্টের পরিবর্তে ৫ বছর মেয়াদি এমআরপি করতে পরামর্শ দেন কর্মকর্তা-কর্মাচারীরা। ফলে জুন, জুলাই, ও আগস্ট– মাত্র তিন মাসে অন্তত ১০ হাজার আবেদন জমা পড়ে এমআরপির। প্রবাসীদের অভিযোগ, এমআরপি করলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দালালদের মাধ্যমে বেশি অর্থ কামাতে পারেন। এ জন্য তারা সব সময় ই-পাসপোর্ট করতে নিরুৎসাহিত করেন। যদিও ১৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনকে প্রবাসীদের এমআরপির বিষয়ে নিরুৎসাহিত করতে নির্দেশ দিয়েছে।
জানতে চাইলে কাউন্সেলর মিয়া মোহাম্মাদ কেয়ামউদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। তবে হাইকমিশনের পাসপোর্ট বিভাগে সম্প্রতি একটি সংঘবদ্ধ চক্র মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
গ্রাহকদের এমআরপির ক্ষেত্রে উৎসাহ ও ই-পাসপোর্টে নিরুৎসাহিত করার বিষয়ে এমদাদ হোসাইন বলেন, ‘পাসপোর্ট রি-ইস্যুর ক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই ই-পাসপোর্ট করতে পরামর্শ দিই। তবে কারও এনআইডি কিংবা অনলাইন জন্মসনদ না থাকলে তাকে এমআরপি করার পরামর্শ দিই।’
সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে হয়রানি ও অর্থ নেওয়ার অভিযোগ এমদাদের মতোই অস্বীকার করেন অফিস সহকারী মঞ্জিল হোসেন রাতুল।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post