স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় গিয়ে মাসের পর মাস কারাবন্দি জীবন-যাপন করছে শত শত বাংলাদেশি কর্মী। একাধিক দালাল চক্রের হাত বদল হয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা থেকে ৬ লাখ টাকা ব্যয় করে দেশটিতে গিয়ে চুক্তি অনুযায়ী কাজ না পেয়ে দেশটির বিভিন্ন ক্যাম্প ও জেলখানায় দীর্ঘ দিন যাবত দর্বিষহ জীবন-যাপন করছেন হাজার হাজার বাংলাদেশি। তিন মাস চার মাস পর কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের লেবার কাউন্সিল জাহিদুর রহমান একবার জেলখানায় গিয়ে কর্মীদের শুরু আশ্বাসের বাণী শুনিয়ে আসেন আগামী ১৫/২০ দিনের মধ্যে তোমাদের দেশে পাঠিয়ে দেবো। আর কোনো তার দেখা মিলছে না। সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরাও গা-ডাকা দিয়েছেন। ওদিকে গ্রামের বাড়িতে ঋণের টাকার জন্য পাওনাদারা স্বজনদের সাথে দুর্ব্যবহার করছেন। পরিস্থিতি এমন দিকে গড়াচ্ছে যে এসব কারাবন্দি কর্মীদের দেখার কেউ নেই।
গতকাল শনিবার দেশটির মালাক্কাস্থ জেটিকে আরপি-৪ কারাগার থেকে কান্না জড়িত কন্ঠে বাংলাদেশি কর্মীরা এসব তথ্য জানান। মো. করিম মোল্লা মালাক্কার কারাগার থেকে জানান, কারাবন্দি বাংলাদেশি কর্মী রফিকুল ইসলাম (২৩) নানাভাবে প্রতারণার শিকার হয়ে জেলখানার ভেতরেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ২৬ দিন পর তার লাশ দেশে পাঠানো হয়েছে। এ কারাগারে পাথ ফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-১২৯৮) ৩৬ জন কর্মী দীর্ঘ দিন যাবত মানবেতন জীবন-যাপন করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশি হাইকমিশনের শ্রম সচিব জাহিদুর রহমান ৬ মাস আগে এসে বলেছিলেন, ১৫/২০ দিনের মধ্যেই তোমাদের কাজের ব্যবস্থা করে দেবো না হয়, দেশে পাঠিয়ে দেবো। বার বার যোগাযোগ করেও শ্রম সচিবের কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি। কান্না জড়িত কন্ঠে মালাক্কার কারাগার থেকে একাধিক কর্মী বলেন, আমাদের বাঁচান। আমাদের উদ্ধার করে দেশে নেয়ার ব্যবস্থা করুন স্যার। তারা বলেন, আমরা সিন্ডিকেটের এজেন্সির মাধ্যমে ঋণ করে বা ভিটেমাটি বিক্রি করে ৫ লাখ টাকা থেকে ৬ লাখ টাকা দিয়ে মালয়েশিয়ায় এসেছি। চুক্তি অনুযায়ী যে কাজ দেয়ার কথা তা’দিতে পারেনি। অন্য কাজ দেয়ায় পুলিশ ধরে নিয়ে জেল দিয়েছে। পাথ ফাইন্ডারের মালিক মাজহারুল ইসলামের যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি গা-ডাকা দিয়েছে বলেও তারা অভিযোগ করেন।
এ ব্যাপারে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে ভুক্তভোগির স্বজনরা একাধিক লিখিত অভিযোগ দেয়ার পরে অজ্ঞাতকারণে এসব কারাবন্দিদের উদ্ধারে উদ্যোগ নেয়া হয়নি। মালয়েশিয়ার মালাক্কাস্থ কারাগারে পাথ ফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের ৩৬ জন কারাবন্দির ক্ষতিপূরণ আদায় এবং তাদের উদ্ধারের অভিযোগের ফাইল চাপা পড়ার কারণ জানতে বিএমইটির মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফরের সাথে সম্প্রতি তার দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে জানান। ডিজি বিএমইটি তাৎক্ষণিকভাবে পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মাসুদ রানাকে ডেকে এসব অভিযোগের অগ্রগতি সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদোত্তর দিতে পারেননি। তিনি এ ব্যাপারে দু’দিনে সময় চান। এতে বিএমইটির ডিজি সালেহ আহমদ মোজাফফর হতবাক হন। এসময় বিএমইটি ডিজি বলেন, মালয়েশিয়ায় কারাবন্দি কর্মীরা আমার আপন ভাইও হতে পারতো।এসব অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে কোনো প্রকার ছাড় দেয়া হবে না বলেও ডিজি উল্লেখ করেন। গতকাল অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সি পাথ ফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলামের বক্তব্য নেয়ার জন্য মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
গতকাল শনিবার কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের লেবার কাউন্সিলর জাহিদুর রহমানের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। কুয়ালালামপুরে ডেপুটি হাইকমিশনার মো. খোরশেদ আলম খাস্তগীরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, শ্রম সচিব জাহিদুর রহমান ঢাকায় গিয়েছেন। মালয়েশিয়ার ক্যাম্প ও কারাগারে ১৩ শতাধিক বাংলাদেশি কর্মী রয়েছে বলেও তিনি জানান।
বিএমইটির সূত্র জানায়, ২০২২ সাল থেকে গত জুলাই পর্যন্ত ১শ’ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রায় ৪ লাখ ৭০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় চাকরি নিয়ে গেছে। দেশটি থেকে রেমিট্যান্স আয়ের দিকে থেকে বাংলাদেশ ৪র্থ অবস্থানে রয়েছে। একাধিক দালাল চক্রের হাত বদল হয়ে কর্মীরা ভিটেমাটি বিক্রি, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ৫ লাখ টাকা থেকে ৬ লাখ টাকা দিয়ে দেশটিতে চাকরি নিয়ে গেছে। এসব কর্মীদের মধ্যে হাজার হাজার কর্মী যথাসময়ে মালয়েশিয়ায় কাজ না পেয়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। অনেকেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কারাবন্দি হিসেবে নানা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কারাবন্দি বাংলাদেশি কর্মীদের উদ্ধার কিংবা ওই দেশে কাজের ব্যবস্থা না করে গা-ডাকা দিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। মালাক্কাস্থ কারগারে যেসব কর্মী প্রতারণার শিকার হয়ে দীর্ঘদিন যাবত মানবেতর জীবন-যাপন করছে তারা হচ্ছে, ধামরাইলের মো. করিম মোল্লা, বি-বাড়িয়ার আলামিন মীর, লিটন ঝিনাইদহ, আবু হানিফা কিশোরগঞ্জ, আকাশ বগুড়া, সলিম ময়মনসিংহ, সাহিন কিশোরগঞ্জ, সাব্বির বগুড়া, রাকিব জয়পুরহাট,শাহিন বগুড়া, হামিদ গাজীপুর, আশরাফ বগুড়া, সৌরভ জামালপুর, আলামিন টাংগাইল,গাজী আরশাদ বি বাড়িয়া নুর নবি জামালপুর, নাজমুল টাংগাইল,হোসেন টাংগাইল, শহিদুল ইসলাম ময়মনসিংহ, মান্না নাটর,জাহিদুল টাংগাইল,শামিম টাঙ্গাইল, মোজাম্মেল টাংগাইল,মজিব টাঙ্গাইল, লাবু টাঙ্গাইল, সাত্তার ময়মনসিংহ, আব্বাছ বরিশাল, অমর নাটর,মারুফ কিশোরগঞ্জ, জামাল ময়মনসিংহ, কাউসার বি-বাড়িয়া,আরিফ কিশোরগঞ্জ, সাকিল সিলেট, শামিম নাটর ও উজ্জ্বল টাঙ্গাইল।
মালয়েশিয়ায় প্রতারণার শিকার হয়েছেন ১০৪ জন বাংলাদেশি। চাকরি ছাড়াই রাজধানী শহরের চেরাসের একটি বাসায় তাদের আটকে রাখা হয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে কাজের ভিসায় আসার পর থেকে এসব বাংলাদেশি কর্মী চাকরিহীন রয়েছেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশি কর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্রিটিশ শ্রম অধিকারকর্মী এন্ডি হল বলেন, ১০৪ জন প্রবাসী কর্মী মালয়েশিয়ায় কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে ১৯ হাজার ৫০০ থেকে ২১ হাজার ৭০০ রিঙ্গিত নিয়োগ ফি দিয়েছেন, যেখানে তাদের ভালো জীবনযাত্রার সুবিধা এবং উচ্চ বেতনের চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। অথচ তাদের ঠিকমতো খাবারও জুটছে না। প্রতারণার শিকার একজন কর্মী এন্ডি হলকে বলেন, আমি অনেক বড় ঋণের মধ্যে পড়ে গেছি। বিভিন্ন উৎস থেকে টাকা ধার করার সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে বেতন পেয়ে মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করব। কিন্তু এখন পরিশোধ করতে পারবো না। ঋণদাতারা আমার পরিবারকে হুমকি দিচ্ছে। শ্রমিকরা জানান, মালয়েশিয়ায় আসার পর তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয় এবং তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। এছাড়াও, যে ব্যক্তি তাদের বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে নিয়ে এসেছিল, সেও তাদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। ফ্রি-মালয়েশিয়া টুডেতে এন্ডি হলের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১০০ জনেরও বেশি শ্রমিকের জন্য একটিমাত্র টয়লেট এবং একটি ঘরে গাদাগাদি করে তাদের থাকতে হচ্ছে। তাদর ঠিকমতো খাবার দেওয়া হচ্ছে না। তারা এখন অসহায় জীবন যাপন করছেন।
এদিকে, আফিয়া ওভারসীজের মাধ্যমে ৭৩ জন বাংলাদেশি কর্মী নওগাঁর আত্রাই উপজেলার দালাল সাজেদুর ও শাহিন দালের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য টাকা ও পাসপোর্ট জমা দেয় আল মাকাম ট্রাভেলসের মালিক জামাল হোসেনের কাছে। তারা শেষ পর্যাও দেশটিতে যেতে পারেনি। নওগা’র নাহিদ, সজিব , মিজানুর রহমান, রিজউদ্দৌল্লা ও শিপন আলী এসব তথ্য জানান। আফিয়া ওভারসীজের স্বত্বাধিকারী আফতাফ খান গতকাল ইনকিলাবকে জানান, ৭৩ জন কর্মী প্রায় আড়াই কোটি টাকা পরিশোধ করেনি। এ ব্যাপারে মামলা করা হয়েছে। তাদের দালাল পালিয়েছে। টাকা পরিশোধ করা হলে তাদের বিদেশে পাঠানো হবে বলেও আলতাফ খান জানান। আল মাকাম ট্রাভেলসের স্বত্বাদিকারী জামাল হোসেন রাতে জানান, দালাল সাজেদুর ও শাহিন ৭৩ জন কর্মীর সাথে প্রতারণা করে গা-ডাকা দিয়েছে।
দুই প্রান্তে ‘সিন্ডিকেটের কারণে’ মালয়েশিয়ায় গিয়ে বাংলাদেশি কর্মীরা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাই কমিশনার হাজনাহ মো. হাশিম। বিগত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে এ কথা বলেছিলেন তিনি। এক থেকে দুই লাখ বাংলাদেশির সম্প্রতি দেশটিতে গিয়ে কাজ না পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে করা এক প্রশ্নে হাই কমিশনার বলেন, “মালয়েশিয়ার সরকার এটাকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে এবং আমরা এটা সমাধানের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। “তারা এই সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার কারণগুলোর একটি হচ্ছে সিন্ডিকেট। যেটা মালয়েশিয়ার দিক থেকে যেমন রয়েছে, বাংলাদেশের দিক থেকেও রয়েছে। ফলে এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য আমাদের উভয় দেশের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। এদিকে, মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণকারী ১শ’সিন্ডিকেট ও সাবেক প্রবাসী মন্ত্রী ইমরান আহমেদ সাবেক প্রবাসী সচিব ড. আহমেদ মনিরুছ সালেহীনের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনের ধারায় রাজধানীর পল্টন মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা নং ০৬ (০৩-০৯-২০২৪) পল্টন মডেল থানা।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post