কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নির্বিচার গুলি চালিয়ে গণহত্যা শুরু হলে আন্দোলনটি ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সে সময় শেখ হাসিনা তথা সরকারের সম্মতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান আন্দোলন দমনে সর্বোচ্চ বলপ্রয়োগ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আন্দোলন নেতৃত্বহীন করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে তুলে নেওয়ার পরিকল্পনায়ও ছিলেন সাবেক এই মন্ত্রী।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ পর্যন্ত অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা প্রায় সবাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছ থেকে ‘কড়া’ নির্দেশনা পাওয়ার কথা বলেছেন।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, জুলাই-আগস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে মন্ত্রীদের নিয়ে যেসব সভা করেছেন সেখানে শিক্ষার্থীদের উপর ‘বল প্রয়োগ’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রতিটি সভায় ‘আন্দোলন দমনে পুলিশ প্রস্তুত আছে’ বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান।
রিমান্ডে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, তার সঙ্গে আন্দোলনের সময় ক্ষণে ক্ষণে যোগাযোগ রেখেছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সাবেক সচিব। মন্ত্রী যে কোনো মূল্যে আন্দোলন দমনের নির্দেশনা দিয়েছেন। হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও টিয়ারশেল ছোড়ার নির্দেশনাও ছিল তার।
সূত্র জানায়, জুলাই মাসে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পুলিশের ওপর যখন হামলা হয়েছিল, তখন আন্দোলনকারীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। তখন প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার থেকে গুলির নির্দেশ দেন আসাদুজ্জামান। এরপর থেকে বহুবার র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়।
আসাদুজ্জামান খান এখন কোথায়?
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে তার সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপি আত্মগোপনে চলে যান। অনেকে পরিস্থিতি আঁচ করে আগেই পালিয়ে যান। মন্ত্রী-এমপিসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হলেও এখনো অধরা আছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান। তিনি এখন কোথায় আছেন, এ নিয়ে স্পষ্ট কিছু জানাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে তিনি দেশ থেকে পালাতে পারেননি এমন তথ্যই দিচ্ছে পুলিশ। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরে দায়ের হওয়া অন্তত তিন ডজন মামলার আসামি আসাদুজ্জামান খান।
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে গণহত্যাসহ নানা অভিযোগে অর্ধশতাধিক মামলার আসামি আসাদুজ্জামান খান। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী আমলা, মন্ত্রী, এমপি ও পুলিশের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসব।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন) মো. রেজাউল করিম
গত ১৪ আগস্ট রাতে ‘আসাদুজ্জামান খান আছেন’ এমন খবরে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় একটি বাড়ি ঘেরাও করেন স্থানীয়রা। রাত আড়াইটার দিকে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তবে সেখানে তাকে পাওয়া যায়নি।
পুলিশ সদর দপ্তর ও ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সারা দেশে নানা অভিযোগে অর্ধশতাধিক মামলা হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে বলে জানান তারা।
একাধিক সূত্রের দাবি, সরকার পতনের পর অসুস্থ হয়ে পড়েন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে একটি বাহিনীর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন) মো. রেজাউল করিম বলেন, ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে গণহত্যাসহ নানা অভিযোগে অর্ধশতাধিক মামলার আসামি আসাদুজ্জামান খান। ইতোমধ্যে অনেক প্রভাবশালী আমলা, মন্ত্রী, এমপি ও পুলিশের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
তিনি কোথায় জানতে চাইলে ডিআইজি বলেন, আমরা এখনো নিশ্চিত নই।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ইসরাইল হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অপরাধ করেছেন এবং অপরাধে সহায়তা ও নির্দেশ দিয়েছেন এমন কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পলাতক আছেন। তিনি যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন সেজন্য ঢাকাসহ সারা দেশে গোয়েন্দা জাল সক্রিয় রয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে তিনি গ্রেপ্তার হবেন।
আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পরিবারের নামে শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। পাশাপাশি সংস্থাটির অনুসন্ধানে আরও ২০০ কোটি টাকার বেশি মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে অনুসন্ধান টিম। সব মিলিয়ে আপাতত ৩০০ কোটি টাকার বেশি দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী তিনি আত্মগোপনে আছেন। পালাতে পারেননি। তাকে গ্রেপ্তারে পুলিশের সবগুলো ইউনিট কাজ করছে।
তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার খবরটি অস্বীকার করেন তিনি।
সমন্বয়কদের ডিবিতে তুলে নেওয়ার নির্দেশদাতা আসাদুজ্জামান খান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ‘নিরাপত্তা’ অজুহাতে ছয় সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। এরপর ২৮ জুলাই রাতে একটি ভিডিও বার্তা ও একটি লিখিত স্ক্রিপ্ট ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়। যেটি মূলত ডিবি পুলিশই ছড়িয়ে দিয়েছিল। আন্দোলন প্রত্যাহারের যে ঘোষণা দেন সমন্বয়করা তা জোরপূর্বক নেওয়া হয় বলে পরে জানান সমন্বয়করা। ডিবি থেকে বেরিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা।
জানা গেছে, আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশেই আন্দোলন নেতৃত্বহীন করতে ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনাটি তখন আন্তর্জাতিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপে ফেলে। সমালোচিত হন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ। সরকার পতনের পর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় এক নেতার সঙ্গে আলোচিত ডিবি প্রধান হারুন আর রশিদের ফোনালাপ ফাঁস হয়। সেখানে তিনি দাবি করেন, ৬ সমন্বয়ককে ডিবি অফিসে ধরে আনতে চাননি তারা। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে ডিবি হেফাজতে নিয়েছেন। বিষয়টি জানতেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুলিশের আইজি ও এসবি প্রধানও অবহিত ছিলেন।
‘আন্দোলন ছাত্র-জনতার নয়, বিএনপি-জামায়াতের’ বলে দমনে কঠোর বার্তা
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন প্রথমে শুরু হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ৫ জুন সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল করার রায় প্রকাশ করেছিলেন হাইকোর্ট। ৬ জুন বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। জুলাইয়ের শুরুতে এসে আন্দোলন দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
১৫ জুলাই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও পুলিশি হামলার ঘটনা ঘটলে আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১৭ জুলাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। ১৮ ও ১৯ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পুরোদমে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাদের ওপর নজিরবিহীন হামলা ও গুলি চালায় পুলিশ। নির্বিচার গুলিতে ১৮ জুলাই অর্ধশত এবং পরদিন ১৯ জুলাই শতাধিক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ নিহত হন। এ হত্যাকাণ্ড আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আন্দোলন দমনে শুরু থেকেই এটিকে রাজনৈতিক তকমা দিতে থাকে আওয়ামী লীগ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও একাধিকবার জামায়াত-শিবির বিএনপির আন্দোলন বলে প্রচার করেন।
একাধিক সূত্রের দাবি, সরকার পতনের পর অসুস্থ হয়ে পড়েন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে একটি বাহিনীর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন) মো. রেজাউল করিম বলেন, ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে গণহত্যাসহ নানা অভিযোগে অর্ধশতাধিক মামলার আসামি আসাদুজ্জামান খান। ইতোমধ্যে অনেক প্রভাবশালী আমলা, মন্ত্রী, এমপি ও পুলিশের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
তিনি কোথায় জানতে চাইলে ডিআইজি বলেন, আমরা এখনো নিশ্চিত নই।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ইসরাইল হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অপরাধ করেছেন এবং অপরাধে সহায়তা ও নির্দেশ দিয়েছেন এমন কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পলাতক আছেন। তিনি যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন সেজন্য ঢাকাসহ সারা দেশে গোয়েন্দা জাল সক্রিয় রয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে তিনি গ্রেপ্তার হবেন।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post