মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাসপোর্ট, এনআইডি সংক্রান্ত সেবা নিয়ে ভোগান্তির অভিযোগ বহু বছরের। আর্থিক ক্ষতি, সময়ের অপচয়, দালাল ও মধ্যস্বত্তভোগীদের দ্বারা দিনের পর দিন প্রতারণার শিকার হয়েছেন প্রবাসীরা। এসব সেবা খাতে প্রবাসীদের ভোগান্তির পেছনে দায়ী বাংলাদেশ হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার খোরশেদ আলম খাস্তগীর। হাইকমিশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে পাসপোর্ট, এনআইডি সংক্রান্ত সেবা প্রদানের কাজ বেআইনিভাবে তৃতীয় পক্ষকে পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার গোলাম সারোয়ারের বিদায়ের সময় তড়িঘড়ি করে হাইকমিশন ও এক্সপ্যাট সার্ভিসেস লিমিটেড, কুয়ালালামপুর (ইএসকেএল)- নামে বাংলাদেশি মালিকানাধীন একটি বেসরকারি আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনৈতিকভাবে চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যবস্থা করেন ডেপুটি হাইকমিশনার। এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ হাইকমিশনের ই-পাসপোর্ট, বিদেশিদের জন্য ভিসার অনুমোদন ও অন্যান্য সেবা দেওয়ার দায়িত্ব পায় ইএসকেএল।
মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাসপোর্ট, এনআইডি সংক্রান্ত সেবা নিয়ে ভোগান্তির পেছনে দায়ী বাংলাদেশ হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার খোরশেদ আলম খাস্তগীর।
এ ঘটনার কিছুদিন পরই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের ঘনিষ্ঠ খোরশেদ আলম খাস্তগীর বিশাল অংকের অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নিয়ে অনেকটা গায়ের জোরে হাইকমিশনের লেবার উইং থেকে জেনারেল ট্রাভেল পাসের কার্যক্রম ইএসকেএল-এর কাছে হস্তান্তর করেন। লেবার উইং ও পাসপোর্ট উইংয়ের অফিসাররা এর বিরোধিতা করলেও তিনি ইচ্ছামাফিক রেজুলেশন দেখিয়ে এ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেন, যা পুরোপুরি মালয়েশিয়ায় বসবাস করা প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্বার্থবিরোধী। আগে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে ট্রাভেল পাস নিতে খরচ হতো ৪৪ রিংগিত। আর বর্তমানে ইএসকেএল নিচ্ছে ৬৯ রিংগিত। অভিযোগ উঠেছে, জনপ্রতি বাড়তি ২৫ রিংগিত ভাগাভাগি হচ্ছে ইএসকেএল ও ডেপুটি হাইকমিশনার খোরশেদ আলম খাস্তগীরের মধ্যে।
শুধু পাসপোর্ট কিংবা এনআইডি সেবাই নয়, নিয়োগ, বাড়ি ভাড়া, বাড়ি কেনাসহ অন্যান্য কার্যক্রমও নিজেই সম্পন্ন করেন ডেপুটি হাইকমিশনার খোরশেদ আলম খাস্তগীর। এসব ক্ষেত্রে হাইকমিশনে দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকলেও তাদের কোনো কাজই করতে দেওয়া হয় না। এমনকি ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য পররাষ্ট্র ক্যাডারের অনেক মেধাবী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়েও দিয়েছেন তিনি।
এদিকে, চলতি বছরের মার্চে গণমাধ্যমে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের ট্রাভেল পাস ইস্যুতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে উঠে আসে এনজেড ট্রাভেলস নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য। এই প্রতিষ্ঠানকে হাইকমিশনে নিয়ে আসেন মোর্শেদ আলম নামে এনএসআইয়ের এক কর্মকর্তা। এখানেও বিরাট অংকের অবৈধ আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
শুধু পাসপোর্ট কিংবা এনআইডি সেবাই নয়, নিয়োগ, বাড়ি ভাড়া, বাড়ি কেনাসহ অন্যান্য কার্যক্রমও নিজেই সম্পন্ন করেন ডেপুটি হাইকমিশনার খোরশেদ আলম খাস্তগীর। এমনকি ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য পররাষ্ট্র ক্যাডারের অনেক মেধাবী কর্মকর্তাকে হাইকমিশনের দায়িত্ব থেকে সরিয়েও দিয়েছেন তিনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে পরবর্তীতে ডেপুটি হাইকমিশনার খোরশেদ আলম খাস্তগীরকে আহ্বায়ক করে এ বিষয়ে অনিয়ম তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত কমিটি ট্রাভেল পাস ইস্যু নিয়ে অনিয়মের প্রমাণ পেলেও তা রিপোর্ট দাখিল করেনি।
হাইকমিশনের তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মীর মধ্যে প্রায় ১২ লাখ কর্মী মেশিন রিডেবল পাসপোর্টধারী (এমআরপি)। এ অবস্থায় সেখানে এমআরপি সেবা বন্ধ করে ই-পাসপোর্ট চালুর পাঁয়তারা করছেন স্বয়ং ডেপুটি হাইকমিশনার। এতে মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ব্যাপক লাভবান হবে ইএসকেএল। আর পকেট ভারী হবে খোদ ডেপুটি হাইকমিশনার খোরশেদ আলম খাস্তগীরের।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের জন্য এনআইডি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু হাইকমিশনে একাধিক যোগ্য কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও এ দায়িত্ব ইএসকেএল-কে দেওয়া হয়েছে। এমনকি এনআইডির সার্ভার, কম্পিউটারসহ সব মালামাল ইএসকেএল-এর মাধ্যমেই কেনা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া এনআইডি’র কাজ ইএসকেএল-কে পাইয়ে দিতে সহায়তা করেছেন হাইকমিশনের এনএসআই কনস্যুলার মোর্শেদ আলম। এর বিনিময়ে ৩ কোটি টাকা নিয়েছেন তিনি।
মালয়েশিয়ায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মীর মধ্যে প্রায় ১২ লাখ কর্মী মেশিন রিডেবল পাসপোর্টধারী (এমআরপি)। এ অবস্থায় সেখানে এমআরপি সেবা বন্ধ করে ই-পাসপোর্ট চালুর পাঁয়তারা করছেন স্বয়ং ডেপুটি হাইকমিশনার। এতে মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পকেট ভারী হবে খোদ খোরশেদ আলম খাস্তগীরের।
এছাড়া এনআইডি সেবা দিতে সরকারিভাবে কোনো ফি না নেয়ার নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা মানছে না ইএসকেএল। একেকটি এনআইডি’র জন্য ৫০-৭০ রিংগিত করে নিচ্ছে তারা। শুধ তাই নয়, প্রতিটি সেবার জন্য দালালদের মাধ্যমে অতিরিক্ত ৩০০-৪০০ রিঙ্গিত করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই হাইকমিশনের সব লেনদেন করছে ইএসকেএল। এ কারণে পাসপোর্ট-এনআইডিসহ সব সেবার ফি বাবদ নেয়া অর্থ জমা হচ্ছে কোম্পানিটির নিজস্ব অ্যাকাউন্টে। এতে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে। আর সেই অর্থ যাচ্ছে ডেপুটি হাইকমিশনার খাস্তগীর ও ইএসকেএল-এর অ্যাকাউন্টে।
মোটা অংকের ঘুষ লেনদেন, জড়িত আরো দুই কর্মকর্তা:
অভিযোগ রয়েছে, পাসপোর্ট, এনআইডিসহ প্রবাসীদের অন্যান্য সেবা হাইকমিশন থেকে বের করে দেওয়ার জন্য ডেপুটি হাইকমিশনারকে ২৫ কোটি টাকা দিয়েছে ইএসকেএল। এতে তার সঙ্গে সরাসরি জড়িত হাইকমিশনের এনএসআই কনস্যুলার মোর্শেদ আলম ও হেড অব চ্যানসারি প্রণব কুমার ভট্টাচার্য।
ডেপুটি হাইকমিশনারের কর্মকাণ্ডে দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের অভিযোগ, ইএসকেএল-এর একজন বেনামি অংশীদার ডেপুটি হাইকমিশনার খোরশেদ আলম খাস্তগীর। এ কারণে হাইকমিশনের সব কাজ বেআনিভাবে ইএসকেএল-কে পাইয়ে দিচ্ছেন তিনি।
এনআইডি সেবা দিতে সরকারিভাবে কোনো ফি না নেয়ার নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা মানছে না ইএসকেএল। একেকটি এনআইডি’র জন্য ৫০-৭০ রিংগিত করে নিচ্ছে তারা। শুধ তাই নয়, দালালদের মাধ্যমে অতিরিক্ত ৩০০-৪০০ রিঙ্গিত করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, ডেপুটি হাইকমিশনার খোরশেদ আলম খাস্তগীরকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রথমে বাহরাইন ও পরে পোল্যান্ড পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এ কর্মকর্তা ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে মালয়েশিয়াতেই থেকে যান। এর পেছনের কারণ সম্পর্কে খোরশেদ আলমের ব্যক্তিগত স্বার্থকেই দেখছেন হাইকমিশনের ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
ইএসকেএল-এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার:
আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান এক্সপ্যাট সার্ভিসেস লিমিটেড, কুয়ালালামপুর (ইএসকেএল) মূলত বাংলাদেশের গত আওয়ামী লীগ সরকারের চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী লিটন মালিকানাধীন বলে জানা গেছে। ডেপুটি হাইকমিশনার খোরশেদ আলম খাস্তগীরের সঙ্গে যোগসাজশ করে ঐ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ মালয়েশিয়ায় পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে ঐ রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে।
বেআইনি জব পোর্টাল চালু:
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগ দেওয়ার পর থেকেই হাইকমিশনের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত ডেপুটি হাইকমিশনার খোরশেদ আলম খাস্তগীর। যোগদানের অল্প সময়ের মধ্যেই আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে ‘ডটলাইন’ নামে একটি জব পোর্টালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ‘বাংলা টাইগার ডিজিটাল’ ও ‘চাকরির খোঁজ’ নামে দুটি বেসরকারি জব পোর্টাল চালু করতে সহযোগিতা করেন তিনি। এতে জড়িত ছিলেন ‘ডটলাইন’ এর মালিক মাহবুব মতিন নামে এক বাংলাদেশি।
পাসপোর্ট, এনআইডিসহ প্রবাসীদের অন্যান্য সেবা হাইকমিশন থেকে বের করে দেওয়ার জন্য ডেপুটি হাইকমিশনারকে ২৫ কোটি টাকা দিয়েছে ইএসকেএল। এতে তার সঙ্গে সরাসরি জড়িত হাইকমিশনের এনএসআই কনস্যুলার মোর্শেদ আলম ও হেড অব চ্যানসারি প্রণব কুমার ভট্টাচার্য।
মালয়েশিয়া সরকারের যথাযথ অনুমোদন না থাকায় খাস্তগীরের এমন কর্মকাণ্ডে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল হাইকমিশনকে। পরবর্তীতে গণমাধ্যমে খাস্তগীরের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ এনে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ায় ‘ডটলাইন’ জব পোর্টালটি বন্ধ হয়ে যায়।
আলোর মুখ দেখেনি খাস্তগীরের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ:
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রবাসী বাংলাদেশি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে যোগদানের পর থেকেই ঘুষ-মানিলন্ডারিংসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন খোরশেদ আলম খাস্তগীর। তার বিরুদ্ধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অসংখ্য অভিযোগ এসেছে। কিন্তু সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের অত্যন্ত কাছের মানুষ হওয়ায় প্রভাব খাটিয়ে সব অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়ে যান তিনি।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post