সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগ্রুপ এস আলমের ‘বেনামি ঋণের’ মাধ্যমে অর্থ তুলে নেওয়ার চেষ্টা ঠেকিয়ে দিয়েছে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক।
গত মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) ব্যাংক খোলার প্রথম দিনেই কর্মকর্তাদের তৎপরতায় ৮৮৯ কোটি টাকা উত্তোলন আটকে যায়। এসব অর্থ তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল ‘গ্লোডেন স্টার’ ও ‘টপ টেন ট্রেডিং হাউজ’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান।
ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, টাকা উত্তোলন ঠেকিয়ে দেওয়া এই দুটি প্রতিষ্ঠানই ব্যাংকের মালিকপক্ষ তথা এস আলম গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত।
জানা গেছে, মঙ্গলবার ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখায় সোনালী, জনতা, রূপালী, পূবালী ও সিটি ব্যাংকের পাঁচটি চেক নগদায়নের জন্য পাঠানো হয়। সাধারণত একটি নির্ধারিত পরিমাণ অর্থের চেক শাখা ব্যবস্থাপকই নগদায়ন করে দিতে পারেন। কিন্তু বেশি অঙ্কের চেক নগদায়নের জন্য ব্যাংকের হেড অফিসের অনুমোদন নিতে হয়।
‘গ্লোডেন স্টার’ নামে প্রতিষ্ঠানটি পাঁচটি চেক ইস্যু করেছিল। প্রতিষ্ঠানের মূল হিসাব ছিল চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখায়। ওই পাঁচটি চেক আগ্রাবাদ শাখার ম্যানেজার প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়ার পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে ৩৪৬ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
তবে ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের তৎপরতায় তা আটকে যায়। একই দিন টপ টেন ট্রেডিংয়ের ৫৪৮ কোটি টাকার বেনামি ঋণও আটকে দেয় ব্যাংকটি। এ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
টাকা উত্তোলনের নেপথ্যে কে?
‘গ্লোডেন স্টার’ ও ‘টপ টেন ট্রেডিং হাউজ’ নামক প্রতিষ্ঠান দুটি মূলত ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি ও সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলমের পিএস আকিজ উদ্দিন ও এস আলম গ্রুপের সুবিধাভোগী বেনামি প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আকিজ উদ্দিন বেনামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বরাবরের মতোই টাকা তুলে নিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আকিজ উদ্দিনের সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানের চেক বুঝতে পেরে টাকা আটকে দেয় ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।
এই আকিজ উদ্দিন এখন কোথায়, তা খোদ ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারাও জানেন না। ইসলামী ব্যাংকের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টিকারী আকিজ উদ্দিন গত তিন দিন ব্যাংকে আসেননি। আবার ব্যাংক থেকে তিনি ছুটিও নেননি।
ইসলামী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন, এই আকিজ উদ্দিন বেনামে কোম্পানি খুলে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করতেন।
ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা জানান, গ্লোডেন স্টারের ওই অ্যাকাউন্ট থেকে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ঘুষ দেওয়ার কথা বলে মাঝেমধ্যে বড় অঙ্কের টাকা উত্তোলন করা হতো।
যে তিন শীর্ষ কর্মকর্তা পালাতক
বেনামি প্রতিষ্ঠান খোলা ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে, একাধিক ডেপুটি গভর্নরকে ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের লোকদের ঘুষ দেওয়ার কথা বলে প্রতিদিন ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা উত্তোলন করতেন ডিএমডি আকিজ উদ্দিন। যাকে তাকে নিয়োগ দেওয়া ও যখন তখন যার তার চাকরি খাওয়া ছাড়াও গভর্নরসহ সরকারকে ম্যানেজ করতেন এই আকিজ উদ্দিন। তিনি এখন পালাতক।
এছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষ করে আমদানি রফতানির মাধ্যমে এসআলমের কোটি কোটি টাকা পাচারের সহযোগিতা করতেন ইসলামী ব্যাংকের আরেক ডিএমডি মিফতা উদ্দিন। তার ভয়ে তটস্থ থাকত অধীনরা। অবৈধভাবে অর্থ পাচারের কাজে যারাই বাধা হতো, তাদেরই রাজাকার বা জামায়াত-শিবিরের তকমা দিয়ে চাকরিচ্যুত করা হতো। মেফতা উদ্দিনও তিন দিন ধরে অফিসে আসছেন না।
জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংকের বিদেশি শেয়ার বিক্রি ও এস আলমের বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে কেনার কাজে সহযোগিতা করতেন জেকিউএম হাবিবুল্লাহ। তিনি ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি সেক্রেটারি।
বেনামি ঋণ সৃষ্টি করে ওই অর্থ দিয়েই ইসলামী ব্যাংকের বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এস আলমের বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার কিনতে সহযোগিতা করেছেন এই হাবিবুল্লাহ। আর এভাবেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এই হাবিবুল্লাহও অফিসে আসেননি। আবার অফিস থেকে ছুটিও নেননি।
প্রসঙ্গত, সোমবার (৫ আগস্ট) শেখ হাসিনা সরকারের পতনের অনেক আগে থেকেই এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ (এস আলম) বিদেশে অবস্থান করছেন। দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে দুই হাতে টাকা লুটে তিনি সিঙ্গাপুরে সাম্রাজ্য গড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নতুন করে সরকারের বিদায়ের পরও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post