আগের মতো না হলেও দেশে এখন মোবাইল ফোর-জি ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু আছে। তবে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, মেসেঞ্জার ও টিকটক বাংলাদেশে ব্যবহার বন্ধ রয়েছে, সেটা ঘোষণা দিয়েই। অর্থাৎ জনপ্রিয় এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশ থেকে ‘সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ’।
তবে অসাধারণদের প্রবেশাধিকার রয়েছে ফেসবুকে। গত রোববার গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালুর পরপরই ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে পোস্ট দেওয়া শুরু করেন। তিনি প্রতিনিয়তই নিজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের তথ্য ফেসবুকে পোস্ট করে আসছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন আয়োজনের সরাসরি সম্প্রচারও করছেন তিনি। ইনস্টাগ্রামেও তিনি সক্রিয় রয়েছেন। তাঁর ভেরিফায়েড টিকটক অ্যাকাউন্ট থেকেও তিনি পোস্ট করছেন।
বেশ কিছুদিন ধরেই ইন্টারনেট সেবায় বিঘ্ন দেখা যাচ্ছে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ও সহিংসতার মধ্যেই সরকার ১৯ জুলাই মধ্যরাত থেকে কারফিউ জারি করে, যা সময়-সময় শিথিল করে এখনো বলবৎ। কারফিউর আগেই ১৭ জুলাই মধ্যরাত থেকে মুঠোফোনে ফোর-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ করায় দেশের মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায়। ১৮ জুলাই রাত পৌনে ৯টা থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগও বন্ধ হয়ে যায়। পাঁচ দিন পর ২৩ জুলাই রাতে সীমিত পরিসরে পরীক্ষামূলক ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়। ২৪ জুলাই সারা দেশেই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু হয়। ২৮ জুলাই বিকেল থেকে মুঠোফোনে ফোর-জি ইন্টারনেট চালু করা হয়। তবে ফেসবুকসহ মেটার মালিকানাধীন অ্যাপগুলো ও টিকটক বন্ধ রাখা হয়েছে।
শুধু জুনাইদ আহ্মেদ নন, ফেসবুকে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং সরকার–সমর্থক অনেককে। সাধারণ মানুষের জন্য ফেসবুক বন্ধ, তবে প্রতিমন্ত্রীসহ কিছু ব্যক্তি ফেসবুক ব্যবহার করতে পারছেন, যা নিয়ে সাধারণের মধ্যে সমালোচনা রয়েছে। এ বিষয়ে গত শনিবার রাতে জুনাইদ আহ্মেদ বলেন, গুজব প্রতিরোধে মানুষকে সঠিক তথ্য জানাতে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় রয়েছেন। তিনিসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোও এভাবে সক্রিয় থাকতে পারবে বলেও জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীল আচরণ করলে এবং দেশের আইন মেনে চললে তাদের প্ল্যাটফর্ম দেশে উন্মুক্ত হবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
প্রতিমন্ত্রী সবার জন্য ফেসবুক বন্ধ করে নিজে ফেসবুক ব্যবহার করছেন। আবার তিনি বলছেন (ফেসবুক, টিকটক ইত্যাদি) বাংলাদেশের সংবিধান, আইন মানবে কি না এবং নিজেদের যে গাইডলাইন আছে, সেটা ঠিকমতো মেনে চলবে কি না, এসব নিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা যদি এসে ব্যাখ্যা দিয়ে যায়, তখন সরকার চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসবে।
এতই যদি সমস্যা ফেসবুক-টিকটকের, তবে প্রতিমন্ত্রী ও অন্যরা কেন ফেসবুকে সক্রিয় থাকছেন? ফেসবুক এখন শুধু সামাজিক যোগাযোগ বা প্রতিদিনের সুন্দর সুন্দর ছবি–কথা প্রকাশের মাধ্যম নয়। ফেসবুক অনেকের জীবিকার উৎস। ছোট ছোট লাখ লাখ উদ্যোগ ফেসবুকভিত্তিক। এ জন্য ‘এফ-কমার্স’ একটি বিশেষায়িত খাত এখন। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি, পণ্যের প্রচারণা চালাতে হয় অনেককে। প্রথম আলো অনলাইনে রোববার প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ফেসবুক বন্ধ থাকায় প্রতিদিন ৬৭ থেকে ৬৮ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে এফ-কমার্সে।
করোনা মহামারির বিপর্যয়ের সময় ও এরপর থেকে অনেকের জীবনধারণের মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই ফেসবুক। নারী উদ্যোক্তাদের ফেসবুক গ্রুপ উইমেন অ্যান্ড ই–কমার্স (উই) ট্রাস্টের সদস্য সংখ্যা করোনার সময় ১০ লাখ হয়েছিল। এখন এর সদস্য প্রায় ১৫ লাখ। এর প্রায় সবাই ফেসবুকভিত্তিক উদ্যোক্তা। নানা সূত্রের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ফেসবুকে ছোট–বড় উদ্যোক্তার সংখ্যা কমবেশি পাঁচ লাখ। এখন অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাই আছেন, যাঁদের ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থা। ফেসবুক পোস্ট দিলে বিক্রিবাট্টা হয়, না হলে নেই। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ‘ইন্টারনেট ক্র্যাকডাউন’-এর কারণে এই মানুষেরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
অন্যরা জীবন–জীবিকার জন্য ফেসবুক ব্যবহার করতে পারছেন না, কিন্তু মন্ত্রীরা ‘গুজব’ ঠেকাতে তাঁদের ভাষায় অগ্রহণযোগ্য সেই মাধ্যমই ব্যবহার করছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এটা তো একধরনের মশকরাই। তা আরও প্রকট হয়ে ওঠে যখন প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহ্মেদ এফ-কমার্স উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দেন নিজস্ব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে, নিজস্ব ওয়েবসাইট বানাতে। তিনি কি জানেন এই অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরি বা প্ল্যাটফর্ম তৈরির আর্থিক সামর্থ্য সত্যিই আছে? প্রতিমন্ত্রী মাঝেমধ্যেই বলেন, আমাদের নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তৈরি করা হবে। এসব কথা উপহাসের মতোই শোনায়। আর তা সাধারণের সঙ্গে।
দেশে এখন কারফিউ জারি আছে। কারফিউয়ের সময় বিভিন্ন সড়কে সর্বসাধারণের চলাচল নিষেধ। আর ওদিকে যেন ডিজিটাল কারফিউ জারি করা হয়েছে ভার্চ্যুয়াল জগতে। সড়কে বের হওয়া যাদের প্রয়োজন তাদের জন্য সরকারই কারফিউ পাস ইস্যু করে। কারফিউ জারি করা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতেও কি পাস লাগবে? তবে প্রযুক্তির এই সময় সেই পাস অর্থাৎ ভিপিএন কিন্তু জনগণের হাতে। প্রযুক্তির এই দুনিয়ায় নিজেদের স্বার্থে কোনো কিছু আটকে রাখা প্রায় অসম্ভব। তারপরও নিজেদের জন্য খোলা, আর সর্বসাধারণের জন্য প্রবেশ নিষেধ—এটা কোনো রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক আচরণ হতে পারে না।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post