প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে এসেছিল রেমিট্যান্স প্রবাহ। গত জুনে রেকর্ড রেমিট্যান্স আসে দেশে। তবে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সংঘাত-সংঘর্ষ, ইন্টারনেট বন্ধ ও কারফিউর প্রেক্ষাপটে গত এক সপ্তাহে (১৯ থেকে ২৪ জুলাই) রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় চলমান ‘রেমিট্যান্স শাটডাউন’ প্রচারণার ফলে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের বক্তব্য, আন্দোলন-সহিংসতা, মৃত্যু ও ইন্টারনেট বন্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তাই অনেকেই দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে হুন্ডিতে পাঠানোর বিষয়ে ক্যাম্পেইন করছে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি জুলাইয়ে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমার সম্ভাবনা থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল রোববার কিছু ব্যাংককে রেমিট্যান্স সংগ্রহে নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দরে কেনার মৌখিকভাবে নির্দেশনা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে বেশি দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর মৌখিকভাবে এক ডজন ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন। যেসব ব্যাংক রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ পায়, এমন ব্যাংকগুলোকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে গত ৮ মে একটি ক্রলিং পেগ এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম চালু করেছে। এ পদ্ধতিতে ডলারের মধ্যবর্তী দর ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়, আগে যা ১১০ টাকা ছিল। এতে ডলারের দর এক লাফে ৭ টাকা বাড়ানো হয়। নতুন এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম চালু করার পর ব্যাংকগুলো প্রতি ডলারে সর্বোচ্চ ১১৮ টাকা অফার করতে সক্ষম হলেও গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশের পর বেশ কয়েকটি ব্যাংক প্রতি ডলার ১১৮ দশমিক ৫০ টাকা থেকে ১১৮ দশমিক ৭০ টাকায় অফার করছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, তার ব্যাংক ইতিমধ্যেই রেমিট্যান্স সংগ্রহের জন্য ডলারে দর বাড়িয়েছে। কারণ গত এক সপ্তাহ ধরে ইন্টারনেট বিভ্রাটের কারণে জুলাইয়ের রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রত্যাশিত স্তরে থাকবে না।
তিনি আরও বলেছেন, তার ব্যাংক এখন রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। কারণ আগামী দিনে ডলারের দর আরও বাড়তে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, রেমিট্যান্স সংগ্রহের জন্য ডলারের দাম বাড়ানোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা সম্পর্কে তার কাছে কোনো তথ্য নেই।
দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে হুন্ডিতে পাঠানোর বিষয়ে ক্যাম্পেইন করছেন প্রবাসীরা। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমার শঙ্কা দেখছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রবাসীরা এক-দুই মাস আয় পাঠাতে না পারেন। তবে যারা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠান, তারা হুন্ডিতে পাঠাবেন না। আগামী এক সপ্তাহ পর বোঝা যাবে রেমিট্যান্স কমবে কি না। এদিকে গত শনিবার বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। এ সময় সোস্যাল মিডিয়ায় চলমান গুজব ও অপপ্রচার বিশ্বাস না করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের যত সম্পদ, আমাদের সরকারের যত অবকাঠামো এগুলো কিন্তু আপনাদের রেমিট্যান্সের টাকা, দেশের কৃষক, শ্রমিক এবং ব্যবসায়ীর ট্যাক্সের টাকায় তৈরি। তিনি আরও জানান, যারা রেমিট্যান্স পাঠানোর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছেন তারা যদি টানা ছয় মাস রেমিট্যান্স না পাঠান বা বৈধ পথে না পাঠান তবে আমাদের দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষতি হবে। জানা যায়, পাঁচ দিনের জন্য ইন্টারনেট সেবা না থাকায় ব্যাংকের পাশাপাশি মোবাইল আর্থিক পরিষেবা (এমএফএস) মাধ্যমে রেমিট্যান্স সংগ্রহকে প্রভাবিত করেছে। যদিও গতকাল এমএফএস চালু হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এমএফএস সেবা না থাকার কারণেও রেমিট্যান্সে একটা প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯ থেকে ২৪ জুলাই ছয় দিনে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ৭ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। অথচ চলতি মাসের প্রথম ১৮ দিনে প্রতিদিন গড়ে প্রবাসী আয় এসেছিল ৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। তাতে দেখা যাচ্ছে, মাসের প্রথম ভাগে এক দিনের যে পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছিল, সর্বশেষ গত ছয় দিনে এসেছে তার সমপরিমাণ। গত ১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত অবশ্য ব্যাংকিং কার্যক্রম চলেছে মাত্র একদিন। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই শুক্রবার রাত থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। এরপর মঙ্গলবার পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ওই দিন লেনদেন চলে বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে প্রবাসী আয় আসাও সম্ভব ছিল না। এ সময়ের মধ্যে যারা বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন, গত বুধবার ব্যাংক খোলার প্রথম দিনেই তা দেশের ব্যাংকে জমা হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু সেটি হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, যদি কেউ বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় পাঠিয়ে থাকেন, ব্যাংকগুলো তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিতরণ করতে বাধ্য; কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশের প্রবাসী আয় প্রেরণকারী রেমিট্যান্স হাউসগুলো যদি এ আয় ধরে রাখে, তাতে তা দেশে আসতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১ থেকে ২৪ জুলাই দেশে বৈধপথে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৫৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার। চলতি মাসের একই সময়ে এসেছে ১৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রথম ১৮ দিনে এসেছিল ১৪২ কোটি ২০ লাখ ডলার। আর ১৯ থেকে ২৪ জুলাই ছয় দিনে এসেছে ৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এর আগে গত জুনে ২৫৪ কোটি ডলার আয় দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। জুনে দেশে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছিল, তা একক কোনো মাসের হিসাবে গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বশেষ ২০২০ সালের জুলাইয়ে ২৫৯ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছিল।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, রেমিট্যান্স পাঠানো হয় প্রধানত পরিবারের প্রয়োজনে। ফলে সংঘবদ্ধভাবে অনেক দিনের জন্য মানুষ রেমিট্যান্স পাঠাবে না, কিংবা হুন্ডি করবে তা বাস্তবসম্মত নয়। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে জাতিসংঘ যদি তদন্ত করে কোনো ব্যবস্থা নেয়, তখন বিদেশি ঋণ ও অনুদান বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকও সরে দাঁড়াতে পারে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post