প্রবাসে চাকরির জন্য আগ্রহী বাংলাদেশি নাগরিকদের সেবা প্রদানের জন্য সরকারের চালু করা আমি প্রবাসী অ্যাপে নিবন্ধন করেছেন ২ হাজার ৪৭৭ জন বিদেশ গমনেচ্ছু পিএইচডিধারী। এর মধ্যে এক হাজার ৯০০ জনই বিদেশে যাওয়ার মরিয়া প্রচেষ্টায় কায়িক শ্রমের কাজ বেছে নিয়েছেন।
অতি উচ্চশিক্ষিত এসব ব্যক্তির মধ্যে কিছুসংখ্যক বিদেশে পেশা হিসেবে প্রকৌশলী, হিসাবরক্ষক, আইটি পেশাজীবী ও চিকিৎসকের মতো উচ্চ দক্ষতার চাকরিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও তাদের মধ্যে সিংহভাগ বা ১ হাজার ৮৭৯ জন অ্যাপটিতে থাকা বিভিন্ন পেশার মধ্যে ‘শ্রমিক’ হিসেবে কাজের আগ্রহও প্রকাশ করেন।
এসব পিএইচডিধারীদের বাইরে, ৫০ হাজার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীও একইভাবে অভিবাসনের প্রচলিত গন্তব্যগুলোয় গিয়ে স্বল্প-দক্ষতার কর্মসংস্থানে নিযুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
অন্যান্য সাধারণভাবে নির্বাচিত কাজের মধ্যে আছে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্নতাকর্মী, গাড়িচালক, সাধারণ শ্রমিক, হোটেল বয়, সেলস ম্যান, অফিস সহকারী, নির্মাণ শ্রমিক, ইলেকট্রিশিয়ান, ওয়েটার এবং কম্পিউটার অপারেটরের চাকরি।
যোগ্যতার সঙ্গে চাকরির অসামঞ্জস্য
উচ্চ শিক্ষিত চাকরি সন্ধানীদের মধ্যে স্বল্প-দক্ষতার কাজের আগ্রহ বাড়ার এই প্রবণতার জন্য– দেশে পেশাজীবী কর্মসংস্থানের অভাব থাকা এবং সেই প্রেক্ষাপটে বিদেশে চাকরি নিশ্চিত করার জন্য এই চেষ্টা করাকেও দায়ী করেছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের কর্মসংস্থান বাজারে চাকরি না পাওয়ার হতাশা থেকে অনেক উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিই বিদেশে স্বল্প-দক্ষতার কাজ নিতেও আগ্রহী হয়ে থাকতে পারে।
তাদের অনেকেই হয়তো মনে করছেন, অ্যাপে নিবন্ধনের সময় কম দক্ষতার পেশা নির্বাচনের অপশন রাখলে তারা বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি সহায়তাও পাবেন। বাংলাদেশের শিক্ষিত জনশক্তির মধ্যে কর্মসংস্থানের প্রত্যাশার একটি বড় ও উদ্বেগজনক পরিবর্তন ঘটারও বার্তা দিচ্ছে এই প্রবণতা।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত আমি প্রবাসী অ্যাপ ও ওয়েব পোর্টাল চালু করা হয় বিদেশে কর্মসংস্থানে আগ্রহী বাংলাদেশিদের সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে। এই অ্যাপের মাধ্যমে প্রবাসে কর্মসন্ধানীরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী পাঁচটি কাজ ও গন্তব্য নির্বাচন করতে পারেন।
অ্যাপে বিশ্বের ১৮০টি দেশে ৫১৫ ধরনের কাজের মধ্যে থেকে পছন্দের কাজ ও গন্তব্য বেঁছে নেয়ার সুযোগ রয়েছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের।
গন্তব্যগুলোর মধ্যে রয়েছে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার, কুয়েত, ইতালি, সিঙ্গাপুর, বাহরাইন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্য।
আবেদনকারী এক নারী নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, তার স্বামী জাপানে থাকেন, তাই তিনিও জাপানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এই অ্যাপের মাধ্যমে আবেদন করেছেন।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি বা সমমানের ডিগ্রি নিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি। তবে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা বা ক্যারিয়ারের লক্ষ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে অস্বীকার করেন।
সাধারণভাবে পিএইচডিধারীরা স্বল্প দক্ষতার চাকরিগুলোয় আগ্রহ বেশি দেখিয়েছেন। তবে আমি প্রবাসী অ্যাপের তথ্যমতে, অন্তত ৮২ ধরনের দক্ষ ও পেশাজীবী কাজের অপশন-ও তারা বেঁছে নিয়েছেন।
উচ্চ দক্ষতার এসব চাকরির মধ্যে রয়েছে ব্যবস্থাপক, বিপণন বিশেষজ্ঞ, ফার্মেসিস্ট, ব্যাংকার, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, কেমিস্ট, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার ও পুষ্টিবিশারদসহ ইত্যাদি নানান ধরনের কাজ।
স্নাতকোত্তর শিক্ষাগত যোগ্যতার একজন কর্পোরেট চাকুরিজীবী নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, শুধু বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেতে তিনি ড্রাইভারের চাকরির অপশনটি রেখেছেন। স্বল্প-দক্ষতার চাকরি নির্বাচন করায় বিদেশ যাওয়া সহজ হবে বলে মনে করেছিলেন তিনি।
২০২২ থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত আমি প্রবাসীর ডেটাবেজে ২২ লাখের বেশি নতুন আবেদন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে ৭২ শতাংশই উচ্চ মাধ্যমিক পাশও করেননি।
প্রশ্নবিদ্ধ পিএইচডির মান
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) একজন পরামর্শক এবং অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, যিনি যে সাবজেক্টে পিএইচডি করেছেন– সেটার ভিত্তিতে হয়ত তার চাকরি পাওয়া কঠিন হচ্ছে, সে কারণে অনেকে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। জব মার্কেটের একটা হতাশা কাজ করে থাকতে পারে।
যেহেতু একাধিক অপশন চয়েজের সুযোগ আছে– তাই অনেকে হয়ত ভেবেছে যে তার সুযোগ বেড়ে যাবে যদি বেশি চয়েজ দেয়। মধ্যপ্রাচ্যেও যদি আলটিমেটলি কোনো একটা কর্মদাতার সঙ্গে এই সুযোগে কানেকশন হয়, তাহলে সে হয়ত নেগোশিয়েশন করতে পারবে, যে আমার কোয়ালিফিকেশন ভালো, কিন্তু জব পাচ্ছিলাম না বলে লেস-স্কিলড জবে আবেদন করেছি।
ইউরোপে বেশি প্রতিযোগিতা থাকায় উচ্চ শিক্ষিতদের জন্যও ভাল যোগ্যতা না থাকলে যাওয়া সহজ নয় জানিয়ে তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে তারা হয়ত চিন্তা করে যদি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে মিড লেভেলের কাজও হয়, তাহলে তিনি যা আয় করবেন– সেটি দিয়ে পরিবারকে সাহায্য করতে পারবেন।
বর্তমানে দেশের ৫৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও পিএইচডি করার সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনা- ২০২২ এর তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে পিএইচডি বা ডক্টরেট ডিগ্রিধারী রয়েছেন ৫১ হাজার ৭০৪ জন। আর ইউজিসির তথ্যমতে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী শিক্ষক্কের সংখ্যা ২০১৭ সালে ছিল ৪ হাজার ৭৬৬ জন, ২০২১ সালে যা বেড়ে ৫ হাজার ৬০৬ জন হয়েছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন ৪ হাজার ৪৩৩ জন শিক্ষার্থী। এছাড়া, ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয় এসময়ে ৪ হাজার ৪৩৩ জন ডক্টরেট ডিগ্রিতে ভূষিত করেছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রদত্ত ডক্টরেট ডিগ্রির মান নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের আলোচনা-সমালোচনার প্রেক্ষাপটে শিক্ষাবিদরা বলছেন, যেসব প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট মানদণ্ড পূরণ করতে পারবে, কেবল তাদেরই পিএইচডি প্রোগ্রামের অনুমোদন দেওয়া উচিত।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, আমলাসহ সরকারি চাকরিজীবীরা যথেষ্ট গবেষণা না করেই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার ঘটনা নিয়ে শিক্ষাবিদরা এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে ইউনিভার্সিটি অব ব্রুনেই দারুসসালামের ফ্যাকাল্টি সদস্য ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ড. এ কে এম আহসান উল্লাহ একটি সংবাদপত্রের নিবন্ধে লিখেছেন, বাংলাদেশে বর্তমান পিএইচডি ডিগ্রির দুরাবস্থার একটি প্রধান কারণ হলো গবেষণার গুণগত মানের অবনতি।
অনেক পিএইচডি প্রার্থী তাড়াহুড়ো করে থিসিস সম্পন্ন করেন, ফলে তাদের গবেষণার মূল যুক্তি এবং ভিত্তি অনেক সময় স্পষ্ট হয় না। গবেষণার গভীরতা এবং মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুতর ঘাটতি দেখা যায়।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post