জীবনের গল্প পর্ব-১
জীবনের গল্প পর্ব-২
জীবনের গল্প পর্ব-৩
জীবনের গল্প, পর্ব-৪ ‘আসমানি কৈ মাছ’
জীবনের গল্প, পর্ব-৫ ‘লজিং মাস্টার’
সবে মাত্র ঘুমের তন্দ্রা আসছে একটু ঘুমিয়েই পরেছিলাম হটাৎ করে বাইরে থেকে খট খট শব্দ আসছে, মনে হলো বাইরে মিলের মেইন গেটের শব্দ। মিতাকে ডাক দিলাম, ও গিয়ে মিলের মেইন গেটের দরজা খুললো। ওদের কথায় আমার বুঝতে বাকী রইলোনা সেযে মিল চালানোর অপারেটর গোপাল সাহা। উনি আমার মিতা কে তুই মুই করে সম্বোধন করছে আর করবে নাইবা কেনো! মিতা তো মিলের কুলি।
আমার মিতার আবার ধৈর্য শক্তি একটু কম, সময় জ্ঞানও কেয়ার করে না, কথার ঢং বং নাই বললেই চলে। চোখ মুখ ধোয়ার আগেই সরাসরি তাকে বলছে- এই গোপাল’দা আপনি না অনেক আগে বলছিলেন একটা মাস্টার রাখবেন, আপনার ছোট ভাই বোনদের পড়ানোর জন্য? ওরে রাখবেন নাকি? গোপাল দা বলল হ রাহার তো দরকার কিন্তু হেয় থাকবো কই? মিতা কয় ক্যান হাপনের বাড়ী থাকবো।
হ্যাঁগোরে দুই ব্যালা পড়াইবো। গোপাল’দা বলে আমাগো বাড়ীতে আলাদা ঘড় মর নাই, তয় বারান্দায় একটা রুম আছে ডালের বস্তা থাহে। ওইটা পরিষ্কার কইরা যদি থাকতে পারে থাকবো। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে গোপাল’দার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। নিজের অসহায়ত্বের বহিঃপ্রকাশ পরিপূর্ণ ভাবে মুখমণ্ডলে ছেয়ে গেছে আমার। অসহায় এবং লজ্জায় কিছুই যেনো বলতে পারছি না।
[the_ad id=”652″]
গোপাল’দা মিলের ভিতরে গিয়ে মেশিন চালু করলো, পরিপূর্ণ কোন মতামত দিলো না মিতা কে। মেশিন চালু করার পর বিকট শব্দের শুরু হলো। আমি খুব হতাশাগ্রস্ত হয়ে মিলের বাইরে এসে অসহায়ের মতো বসে আছি। একটু পরে মিতা বের হয়ে গোয়ালচামট ১নং সড়কের দিকে রওনা হলো আমি বসে আছি, ও পিছনের দিকে তাকিয়ে বললো কিরে যাবিনা চল কয়ডা খাইয়া আসি। পরে আমি ওর পিছন পিছন হাটা ধরলাম।
ঘুপসি ঘরের মধ্যে একটা হোটেল সেখানে ঢুকলাম দুজনে। হোটেলটিতে সকালে আটার রুটি আর বুটের ডাল বানিয়ে বিক্রি করে। কম দামে খাবার বিক্রি করায় আশেপাশের কুলি রিক্সাওয়ালা গরিব মানুষের খাওয়ার একমাত্র হোটেল এটি। আমি তৃপ্তি সহকারে তিনটি রুটি এক প্লেট বুটের ডাল খেয়ে এক গ্লাস জল খেলাম, আহ কি তৃপ্তি! আবার দুজনে মিলে ফিরে আসলাম, আমার মিতা মিলের ভিতরে কুলির কাজ শুরু করলো, আর আমি বাইরে বসে আছি।
মিলের ম্যানেজার ইতিমধ্যে চলে এসেছে। ম্যানেজার নাম অরূপ চক্রবর্তী, ধুপকাঠি জালিয়ে কাগজের ঠাকুর’কে প্রণাম করে উনার চেয়ারে বসলেন। ম্যানেজার অরূপ চক্রবর্তী’কে নিয়ে আর কিছু বলতে চাচ্ছি না তবে উনি আমাকে উপকার করছিলেন। আমি অপেক্ষা করছি গোপাল’দার জন্য, উনি দুপুরে বাড়ীতে খাবার খেতে যান, অবশেষে গোপাল’দা বের হলেন দুপুর আড়াই টার দিকে। গোপাল’দা বাইরে আমাকে অপেক্ষায় দেখে বলে চলো আমার সাথে।
মিলের পিছেনেই উনার বাড়ী দুই/তিন মিনিটে পৌঁছে গেলাম। গোপাল’দার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল না। এদিকে গোপাল’দার বৌ বোবা কথা বলতে পারে না। কখন হাসে আবার কখনো’বা কাঁদে। গোপাল’দার কথা শুনে বোঝা গেল বৌদির মাথায় কিঞ্চিৎ গোলমাল আছে। পরিবারে ছোট দুই বোন ও এক ভাই, ওরা মহিম স্কুলে পড়ে, ওদের সকালে বিকালে পড়ানো আমার দায়িত্ব।
ঘড়ের বাইরে একটা জরাজীর্ণ টিন সেট মাটির বারান্দা কয়েকটি ডালের বস্তা ফেলানো, থাকার মতো কোন চকি (খাট) নাই, নোংরা মাকড়শার জালে ভর্তি, কারেন্টের কোন লাইট নাই। ঐ মাটির বারান্দায় আমাকে থাকতে হবে। বারান্দা দেখিয়ে গোপাল’দা হাতমুখ ধুয়ে পিড়িতে খেতে বসে গেল। আমারও খুব খুদা লেগে গেছে কিন্তু আমাকে খাবার কথা বললো না গোপাল’দা! হয়তো একজনেরই খাবার ছিলো।
যাক একটা থাকার ব্যবস্থা হল, আমি রুমটি পরিষ্কার করার কাজে লেগে গেলাম, মাকড়শার জাল গুলো ঝেরে ফেললাম। নিচের মাটি গুলো সমান না ওখানে কোন অবস্থাতে ঘুমানো সম্ভব না, চকির একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। আমি আবার অপু ইন্ডাস্ট্রিতে ফিরে গেলাম মিতার কাছে। মিতাকে নিয়ে ফরিদপুর ট্রাক স্ট্যান্ডের পাসে চকি পাওয়া যায়, সেখানে গিয়ে ২৫০ টাকা দিয়ে একটি চকি কিনলাম।
মাছ বিক্রি সেই টাকা মিতা দিয়েছে। এদিকে অর্থের সংকট আবার চকি নিয়ে আসবো কিভাবে সে চিন্তা। মিতা বললো দুর ধরতো, দুই পাশে দুজনে ধরে চকিটা নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কিছু দুর আসার পর আর পারছি না। ইতিমধ্যে আমার হাতে ঠোসা পরে গেছে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।
মিতার অবশ্য হচ্ছে না কারণ ওতো কুলির কাজ করে, মিতার হাব ভাবে মনে হচ্ছে এটা কোন ব্যাপারই না। অবশেষে ওর পরিচিত একজন ভ্যানওয়ালা পাইলাম, ভানে উঠিয়ে গোপাল দার বাড়িতে আসলাম। মিতা আমাকে দিয়ে চলো গেলো প্রতিদিনের মতো মিলের মধ্যে ও ঘুমাবে! গোপাল দার মা, আমি তাকে কাকিমা বলে সম্বোধন করলাম, কাকিমার কাছ থেকে দুটি কাঁথা এবং একটি বালিশ চেয়ে নিলাম। রাত ১০টার দিকে আমাকে খেতে ডাকলো, উনারা সবাই মাটিতে পাটি বিছিয়ে খায় আমাকে পিড়িতে বসিয়ে গোপাল দার বোবা বৌ বৌদি আমাকে খাবার দিলো, আমি পিড়িতে বসে খেয়ে নিলাম। বারান্দায় গিয়ে বিছানায় একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে আমি শুয়ে পরলাম।
বৈশাখ মাসে প্রচন্ড গরম এবং সেইসাথে মশার উপদ্রবটা একটু বেশি থাকে। আমি যে বারান্দায় থাকি সেখানে আলো-বাতাসের আসা যাওয়া একটু কম হয়। তাই রাতদিন মিলিয়ে খুব গরম অনুভব করি এবং বদ্ধ ঘরের আবহাওয়া বিরাজ করে। বলা যায় ৪০-৪২ ডিগ্রী তাপমাত্রা সবসময়। যেহেতু মিলের পিছনে বাড়ী সমস্ত মশা মনে হয় এই বারান্দায় বাসা বেঁধে আছে। হাত নারা চারা করলে মশা ধরা যায় ২০-৩০ টা।
এদিকে দশ মিনিটের মধ্যে আমার মুখমন্ডল মশার কামরে লাল হয়ে গেলো। টাকার অভাবে মশারি কিনতে পারিনি তাই কাঁথা দিয়ে মুখটি ঢেকে নিলাম, দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অতিষ্ঠ গরমে, তাই গা থেকে কাঁথাটি সরিয়ে ফেললাম, এবার হাজারো মশার কামড়ে ছটফট করছি। আমার মনে হয় নরকেও এত বেশি কষ্ট হয়না, ধাউ ধাউ আগুনের মধ্যে আমি যেনো ঝাঁপ দিয়েছি! আমি অসহ্য যন্ত্রণায় সারারাত কান্নায় ভেঙে পরলাম। মনে হলো তিন চার ঘণ্টার মধ্যে আমার গায়ে তাপমাত্রা বেড়ে ১০৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস দাঁড়ালো। মা পাশে থাকলে রাতে হয়তো পাশে বসে আমার মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিতো!
রাতটা অনিদ্রায় কেটে গেলো। মার কথা কেন যেনো বার বার মনে পরছে। বাড়ী যেতে ইচ্ছে করছে, আজ মনটাও খুব কাঁদছে বাড়ি যাওয়ার জন্য। সকালে আর থাকতে পারলাম না, গায়ে প্রচন্ড জ্বর নিয়ে গোপাল’দাকে বলে বাড়ীর দিকে রওনা হলাম। কানাইপুর থেকে বাড়ী হেঁটে গেলাম সারে তিন কিলোমিটার পথ। আমার বাড়ীর আর্থিক অবস্থা আরো খারাপ।
এমনিতেই আমাদের বড় একটা সংসার তিন বোন দুই ভাই বাবা মা এবং ঠাকুমা। মা স্নান করে ঠাকুর পূজা দিচ্ছিলো, আমি ঐ মুহূর্তে বাড়ীতে ঢুকলাম, প্রচন্ড জ্বর গায়ে। অনেক দুর থেকে হেটে এসেছি, ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, ঘড়ে যেয়ে সরাসরি শুয়ে পড়লাম। মা আমাকে দেখে একাধিক প্রশ্ন শুরু করলো, কিরে কখন আসলি? এতদিন বাদে আসার সময় হল তোর? ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘরে আয় বলে মা হটাৎ আমার গায়ে হাত দিলো এবং চমকে উঠলো!
গা আমার পুড়ে যাচ্ছে প্রচন্ড জ্বরে হয়তো ১০৩ ক্রস করেছে তাপমাত্রা। আমার দুরবস্থা আঁচ করতে পেরে মা যেন হঠাৎ করে পাগলের মত আচরণ শুরু করলো। জলপট্টি দেওয়া থেকে শুরু করে বাবাকে ডাক্তার ডাকতে বলল, উচ্চস্বরে বোনদের ডাকলো যেন চরম এক অশুভ সংকেত নেমে এসেছে বাড়িতে। ইতিমধ্যে গ্রাম্য ডাক্তার চলে এসেছে বাড়িতে। আমার পাল্স দেখা, তাপমাত্রা মাপা আরো কতো কি।
ডাক্তার মাকে বললো এই ওষুধ গুলো কিছু খাওয়ার পরে খাওয়ান। যেহেতু আমি বাইরে থাকি তাই মা সংসারের সাত জনের জন্য সাতটি বড় বড় আটার রুটি বানিয়েছে, তিন বোন ভাই বাবা এবং ঠাকুমা খাওয়া শেষ। মা দৌড়ে গিয়ে তার জন্য যে অবশিষ্ট রুটি’টি ছিলো সেটা এনে আমাকে খাওয়ালো। তারপর ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ টা আমায় খাওয়ালো মা। মা-তো-মা’ই সকালে তার খাবার জোটে নাই, দুপুরে তার রুটি’টি আমার মুখে তুলে দিলো, হারে মা! যখন জানলাম মা সকালে খায়নি দুপুরে মায়ের খাবারটুকু আমাকে খাইয়েছে। আমি অন্তর্দাহে হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম, সবাই বুঝলো আমি জ্বরে ঘোরে কান্না করছি…
https://www.youtube.com/watch?v=_CTbMb32NhY
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post