মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চালু আছে কথিত ‘ফ্রি’ ভিসা। এ ভিসায় বিদেশে গিয়ে কর্মীরা যেকোনো ধরনের কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে প্রবাসী শ্রমিকদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ফ্রি ভিসা। কাগজে-কলমে এ ভিসার অস্তিত্ব নেই, তবুও প্রচুর মানুষ এই ভিসায় বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।
‘ফ্রি’ ভিসায় যাওয়া প্রবাসীদের অধিকাংশই প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরছেন। অনেকে কাজ না পেয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোয় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। আবার অনেকে গিয়ে উপকৃতও হচ্ছেন। তবে প্রতারিত হওয়ার সংখ্যাই বেশি।
ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে ফ্রি ভিসায় সৌদি আরবে যান নড়াইলের শহীদ মোল্লা। এজন্য নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিক্রি ও জায়গা-জমি বন্ধক রাখেন তিনি। একই সঙ্গে কাঁধে তুলে নেন বড় অংকের ঋণের বোঝা।
দালালের মাধ্যমে বিদেশে পাড়ি দিয়ে পড়েন বেকায়দায়। এক বছরে তাকে দেওয়া হয়নি কোনো কাজ। এখন পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতের বেলা গাড়ি ধোঁয়ার কাজ করেন।
তিনি বলেন, সৌদি আরবের যেদিকেই তাকাবেন, সেখানেই বাংলাদেশি শ্রমিকদের কান্না দেখতে পাবেন। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কাজ খুঁজছেন তারা। অনেকেই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে পুলিশের কাছে ধরা দিচ্ছেন। কিছুদিন জেল খেটে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন।
শুধু শহীদ মোল্লা নন, প্রতি বছর লাখ লাখ শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের উদ্দেশ্যে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। আবার অনেকে খালি হাতে দেশে ফিরছেন।
মূলতঃ দালাল চক্রের ভাষা এই ‘ফ্রি’ ভিসা। তারা সাধারণ মানুষের কাছে লোভনীয় কথা বলে বিদেশ গমনে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করে। এই দালাল চক্র দুই দেশেই সক্রিয়।
ফ্রি ভিসায় সৌদি আরবে লোক নিয়েছেন এমন এক ব্যক্তি বলেন, এক কথায় ফ্রি ভিসা বলতে বোঝায় এই ভিসায় এসে যেকোনো কাজ করা যায়। অন্যদের থেকে অধিক টাকা আয় করাও সম্ভব। যখন খুশি কাজও পরিবর্তন করা যায়। তাই মানুষের আগ্রহ বেশি। এই ভিসায় বিদেশে আসতে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ হয়।
প্রকৃতপক্ষে ‘ফ্রি’ ভিসা কী? বিষয়টি সম্পর্কে সৌদি আরবের জিজান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রবাসী এবং অভিবাসীবিষয়ক গবেষক ড. হোসাইন আহমেদ বলেন, সৌদি আরবে দীর্ঘদিন ধরে থাকা স্থানীয় অনেক বাংলাদেশি ভিসা কেনাবেচা করেন।
ধরুন একটি ফার্মেসিতে দুজন কর্মীর প্রয়োজন। কিন্তু সেই জায়গায় দালালদের প্ররোচনায় নিয়োগকর্তা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনের তুলনায় অধিক ভিসা ইস্যু করেন। পরে দালালদের সঙ্গে একটি মৌখিক চুক্তিতে নিয়োগকর্তা তাদের হাতে ভিসা তুলে দেন।
তিনি আরো বলেন, ইস্যুকৃত ওই ভিসা বাংলাদেশের কিছু এজেন্সি বা দালালের কাছে বিক্রি করে। বাংলাদেশি দালালরা সেই ভিসায় সৌদিতে লোক পাঠায়। এই প্রক্রিয়ায় বিদেশে যাওয়ার পর প্রবাসীদের কাজ ছাড়াই থাকতে হয়।
মূলত নিজের কাজ নিজেই খুঁজতে হয়। অনেক সময় ঘরবন্দি থাকতে হয়। সৌদিতে এ রকম প্রবাসীর সংখ্যা এখন অনেক বেশি। ফলে সৌদিতে প্রবাসীর সংখ্যা বাড়লেও কার্যত বাড়ছে না রেমিট্যান্স। এখন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো অবস্থা ভয়াবহ হতে পারে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের পরিচালক দেবব্রত ঘোষ বলেন, বিএমইটি থেকে ফ্রি ভিসা নামে কোনো ভিসার ছাড়পত্র দেওয়া হয় না। তাহলে এজেন্সি বা এর সঙ্গে জড়িতরা হয়তো অন্য কোনো কাজ দেখিয়ে এই ভিসা করান। নয়তো এটি সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, শ্রমকিদের ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার একক কোনো কারণ নেই। কারণ অনেক শ্রমিক বিদেশে গিয়ে যে প্রজেক্টে তার কাজ, সেখানে কাজ করছেন না। বেশি বেতন পেলে তিনি অন্য কোনো প্রজেক্টে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু এটা আইনগতভাবে বৈধ না। কিন্তু তারা এই ঝুঁকি নিচ্ছেন।
তিনি আরো বলেন, যারা ফ্রি ভিসায় যাচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করেন। এখানে কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি শুধু সরকারি আনুষ্ঠানিকতা করে দেয়। সুতরাং এখানে পুরো দায়টা শুধু এজেন্সিগুলোকে দিলে হবে না।
জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় কথিত ফ্রি ফিসা চালু আছে। প্রতিনিয়ত মানুষ এই ভিসায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাচ্ছেন। তবে কতসংখ্যক মানুষ এই ভিসায় দেশ ছাড়েন তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।
তবে মধ্যপ্রাচ্যের বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে এই ভিসায় যাওয়া প্রবাসীর সংখ্যা সব থেকে বেশি। যার প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সে। কিছুদিন ধরেই প্রবাসীর তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে এই শ্রমবাজারে।
জানা গেছে, সাধারণত কাজের ভিসায় যারা সৌদি আরব যান, তাদের আকামা ও পাসপোর্ট মালিকের কাছে জমা রেখে কাজ করতে হয়। অনেক সময় যে পারিশ্রমিকের কথা বলে শ্রমিক নেয়া সেই পরিমাণ টাকা দেন না মালিকরা। আবার বেশি সময় কাজ করানো হয়। এতে শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কিন্তু ‘ফ্রি’ ভিসায় যারা যান কাজ পেলে তারা বেশি আয় করতে পারেন। এ কারণে বেশিরভাগ শ্রমিক ফ্রি ভিসা খোঁজেন।
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ছাড়পত্র নিয়ে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৪৩৫ জন বাংলাদেশি কর্মী সৌদি আরবে গেছেন।
এর আগে, ২০২৩ সালে ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৪ জন, ২০২২ সালে ৬ লাখ ১২ হাজার ৪১৮ জন, ২০২১ সালে ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২২৭ জন এবং ২০২০ সালে ১ লাখ ৬১ হাজার ৭২৬ জন কর্মী দেশটিতে যান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সৌদি আরব থেকে মাত্র ১৯৬ কোটি ৬৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।
এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৭৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৫৪ কোটি ১৯ লাখ ডলার এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৭২ কোটি ১৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে দেশটি থেকে। এতে প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post