এ দেশের সব পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তা অবৈধ উপার্জন করেন, ঘুষ-দুর্নীতি করে টাকা বানান—এমন কথা কিন্তু দেশে কেউ বলছে না; বরং যাঁদের বিরুদ্ধে বিপুল সম্পদ অর্জনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, তাঁরা সবাই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল পদে থেকে তাঁদের সম্পদ উপার্জন করেছেন।
ছোটখাটো দুর্নীতি আমাদের দেশের মানুষের গা-সওয়া হয়ে গেছে। এসব দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে খুব একটা প্রকাশ পায় না। প্রকাশ হলেও তেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় না। কিন্তু কিছু দুর্নীতির ঘটনা বঞ্চিত, প্রতিনিয়ত টানাপোড়েনের শিকার সাধারণ মানুষকে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ করে তোলে। সৎপথে থেকে, সৎ উপার্জনে জীবন চালানো আমাদের দেশে বর্তমানে অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
অথচ কিছু কিছু মানুষ দিব্যি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছেন; বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তারা। আমাদের দেশে সরকারি চাকরির বেতন আহামরি খুব বেশি নয়। একজন সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তা বড়জোর এক লাখ টাকা বেতন পান। আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা হয়তো আছে। কিন্তু বর্তমানে জীবনযাত্রার যে ব্যয়, সেই ব্যয় নির্বাহ করে, কোটি কোটি টাকা সঞ্চয় করা, কোটি কোটি টাকার সম্পদ বানানো কীভাবে সম্ভব?
যখন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো ব্যক্তির এ ধরনের সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার খবর চাউর হয়, তখন মানুষ হতাশ হয়, ক্ষুব্ধ হয়। কেননা বেতনের সীমাবদ্ধ টাকায় বর্তমানে বাড়ি ভাড়া দেওয়া, বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল ও সন্তানদের লেখাপড়া, খাওয়ার খরচ জোগানো, যাতায়াত-যোগাযোগ, বিভিন্ন পারিবারিক-সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান, উৎসব পালন, চিকিৎসা ব্যয়, কাপড়-চোপড় কেনা, তৈজস ও ইলেকট্রনিকস দ্রব্যাদি কেনা ইত্যাদি বাবদ ব্যয় করার পর হাতে আর অবশিষ্ট কিছু থাকার কথা নয়। অথচ দেখা যাচ্ছে, একশ্রেণির মানুষ বিলাসী জীবনযাপন করার পরও অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক হচ্ছেন। এটা কী করে সম্ভব হচ্ছে? এটা সম্ভব হচ্ছে অবৈধ উপার্জনে, ঘুষ-দুর্নীতির চোরাপথে, ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে।
সম্প্রতি রাষ্ট্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার বিপুল সম্পদ অর্জনের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে তোলপাড় চলছে। এ তালিকায় পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছেন। রয়েছেন রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা। অর্থ উপার্জন ও সম্পদ বানানো খারাপ কিছু নয়। এ ব্যাপারে আইনগতভাবে কোনো বিধিনিষেধও নেই। কিন্তু সেই সম্পদ উপার্জন হওয়া চাই বৈধ পথে, আইন ও নীতি মেনে।
ঘুষ-দুর্নীতির চোরাপথে, ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদের মালিক হলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আইনেই উল্লেখ আছে। যাঁদের বিরুদ্ধে বিপুল সম্পদ বানানোর অভিযোগ, তাঁরা কেউ-ই কিন্তু নিয়ম মেনে, ট্যাক্স দিয়ে, বৈধ পথে এই সম্পদের মালিক হননি। রাষ্ট্র তাঁদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেনি। যখন তাঁরা অবৈধভাবে এই সম্পদ বানিয়েছেন, তখনো তাঁদের বাধা দেওয়া হয়নি। সংগত কারণেই এখন গণমাধ্যম তাঁদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও রোষ সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে তাঁদের নিয়ে চলছে সমালোচনার ঝড়!
সরকারের কাজ দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন। আমাদের দেশে সাধারণত তা হয় না; বরং সরকারে যাঁরা থাকেন, তাঁরা নিতান্ত বাধ্য না হলে দুষ্ট বা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে খুব একটা রা-করেন না। এখন প্রবল জনমতের চাপে অভিযুক্ত কয়েকজনের বিরুদ্ধে সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশনের একটু নড়াচড়া লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু সেটাও যেন অনিচ্ছায়! সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বরং বিষয়টাকে হালকা করার একটা চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাঁদের মুখে ‘সব পুলিশ কর্মকর্তা, সব সরকারি অফিসার চোর না’, ‘ঢালাওভাবে অভিযোগ করা ঠিক না’, ‘এটা পেশাজীবীদের ভাবমূর্তি বিনষ্টের ষড়যন্ত্র’—এমন মন্তব্য শোনা যাচ্ছে।
এ দেশের সব পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তা অবৈধ উপার্জন করেন, ঘুষ-দুর্নীতি করে টাকা বানান—এমন কথা কিন্তু দেশে কেউ বলছে না; বরং যাঁদের বিরুদ্ধে বিপুল সম্পদ অর্জনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, তাঁরা সবাই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল পদে থেকে তাঁদের সম্পদ উপার্জন করেছেন। তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি না। তাঁদের সম্পদের উৎসটাই মানুষ জানতে চায়। তাঁদের সম্পদ যদি অবৈধভাবে অর্জন করা হয়, তবে মানুষ সেই বেআইনি পথ গ্রহণের বিচার চায়! অল্প কিছু মানুষের এই অবৈধ পথে সম্পদ উপার্জনের পথ বন্ধ চায়। তারপরও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এমন সুরে কথা বলছেন কেন? কারণ, আসলে কিছুই নয়, শ্রেণিস্বার্থ।
খুঁটির জোর ছাড়া আমাদের দেশে হয়তো পাঁচ-দশ লাখ টাকা নয়-ছয় করা যায়, কিন্তু কোটি কোটি টাকার সম্পদ বানানো যায় না। খুঁটির জোর মানে ক্ষমতার জোর। ক্ষমতাবান বা ক্ষমতাসীনদের জোর। আশীর্বাদ। আশীর্বাদ তো আর এমনি এমনি হয় না। এর জন্য দেবতাকে তুষ্ট করতে হয়। একজন ভিক্ষুকও কাউকে এমনি এমনি দোয়া করে না। আপনি যতটুকু ভিক্ষা দেবেন, দোয়ার পরিমাণও তার সঙ্গে সমানুপাতিক!
পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠায় পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সভা করে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। তাদের মতে, সম্পদের তথ্য প্রকাশ করে গণমাধ্যমে পুলিশকে, বাহিনীকে হেয় করা হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাব্যক্তিদের অবস্থান দেখলে মাথা হেঁট হয়ে যায়। কোথায় তাঁরা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন, অভিযুক্তদের অভিযোগের তদন্ত ও শাস্তি চাইবেন, তা না করে তাঁরা দায়মুক্তি চাইছেন! তাঁদের সব অভিযোগ ও উদ্বেগ গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে। গণমাধ্যম যেন সংযত হয়, দায়িত্বশীল হয়, এমন নানা পরামর্শ ও উপদেশ তাঁদের বিবৃতিতে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁরা অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের খবর প্রকাশের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদও জানিয়েছেন (বিবৃতির ভাষা পড়লে মনে হয়, পারলে যেন তাঁরা গণমাধ্যমকর্মীদের মুণ্ডু চিবিয়ে খেতেন)!
কোনো ব্যক্তির অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদের সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করা কি তাকে হেয় করা? অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাব্যক্তিরা কেন দুর্নীতিবাজদের দায় নিচ্ছেন? নাকি তাঁরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত?
অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাব্যক্তিরা যদি দায়িত্বশীল হতেন, তাহলে বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অপকর্মের নিন্দা জানাতেন। প্রকাশিত সংবাদগুলোর তদন্ত ও বিচার চাইতেন। কোনো কর্মকর্তা দুর্নীতি করে থাকলে এটি নিতান্তই তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। এ নিয়ে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সংবাদমাধ্যমকে দোষারোপ করতে গেল কেন? তারা কি সব পুলিশের, সব অপকর্মের দায় নিচ্ছে? দুর্নীতি করলে কোনো সমস্যা নেই, সেটা প্রকাশ অন্যায়? ষড়যন্ত্র?
পুলিশের বিরুদ্ধেই কেন মানুষের এত অভিযোগ, এত ক্ষোভ? অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাব্যক্তিরা কি কখনো তা তলিয়ে দেখিয়েছেন? কেন টিআইবির প্রতিবেদনে পুলিশ বিভাগ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত বিভাগ হিসেবে চিহ্নিত হয়? থানা-পুলিশ নিয়ে এ দেশের সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা কিন্তু মোটেও সুখকর নয়। অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাব্যক্তিরা যদি একটা নিরপেক্ষ সংস্থা দ্বারা ‘পারসেপশন-সার্ভে’ পরিচালনা করেন, তাহলেই বুঝতে পারবেন, এ দেশের মানুষের থানা-পুলিশ সম্পর্কে ভাবনা কী, অভিজ্ঞতা কী!
পুলিশ যদি ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করে, জনহয়রানি বন্ধ করে, দাপট দেখানো বন্ধ করে, সত্যিকার অর্থেই জনবান্ধব ভূমিকা পালন করে, তাহলে পয়সা দিলেও সাংবাদিকদের দিয়ে পুলিশ সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করা সম্ভব হবে না। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে করোনাকালের কথা। করোনার সময় যখন সবাই প্রাণের ভয়ে ‘ঘরবন্দী’ হয়েছিল, তখন কিন্তু জনগণের বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে পুলিশই ভূমিকা পালন করেছে। সেই সময় ডাক্তার-নার্স-পুলিশকে নিয়ে অসংখ্য ভালো সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মানুষ তার কাজের দ্বারাই আলোচিত বা সমালোচিত হয়। ভালো ভালো কথা বলবেন, কিন্তু কাজ করবেন খারাপ, তাহলে তো গণমাধ্যম আপনাদের নিয়ে লাফাবেই।
সম্প্রতি আলোচিত অপর একজন সরকারি কর্মকর্তার কথাও প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়। ওই ব্যক্তি গণমাধ্যমের সামনে চরম মিথ্যা কথা বললেন, নিজের সন্তানকে অস্বীকার করেছেন, অথচ তাঁকে ওএসডি করা হয়েছে! ‘ওএসডি’, ‘ক্লোজড’ বা বদলিই কি তবে সরকারি চাকরির সর্বোচ্চ শাস্তি? ওই সরকারি কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হলো না কেন? এমন একজন মিথ্যাবাদী, যে নিজের সন্তানকে অস্বীকার করেন, তিনি সরকারি চাকরি করার, পদে থাকার সুযোগ পান কীভাবে? তাঁর অবৈধ সম্পদ অর্জনের কথা নাহয় বাদই রইল।
দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্ব প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নির্বাহীদের ওপর বর্তায়। তাঁরা শৈথিল্য দেখাচ্ছেন বলেই যাঁরা দুর্নীতি ও অপকর্ম করছেন, তাঁরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। তবে আশার কথা হচ্ছে, বঞ্চিত-ক্ষুব্ধ মানুষের মধ্যে যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ ও সোচ্চার হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। চলমান প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে হবে।
এই পথ অনেকটাই দীর্ঘ। প্রশাসন বা পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগগুলোর কেবল অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অনুসন্ধানে তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর কমিশনের অনুমতি সাপেক্ষে মামলা হবে। মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে।
বিচারে রাষ্ট্রপক্ষকে দুর্নীতির বিষয়গুলো প্রমাণ করতে হবে। তারপর রায়ে যদি শাস্তি হয়, যদি যথাযথ বিচার হয়, তবেই এর শেষ। এই শেষ দেখতে চাইলে ধৈর্য রাখতে হবে। সরকারকে চাপে রাখতে হবে। চাপে না রাখলে ‘লেজের নড়াচড়া’ দেখেই ক্ষান্ত হতে হবে। মনে রাখতে হবে, টিকটিকি কিন্তু লেজ ছাড়াও বাঁচে!
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post