হজ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যে পাঁচটি বিষয়ের ওপর ইসলামের মূল ভিত্তি, তার পঞ্চমটি হলো হজ। তবে নামাজ, রোজা থেকে হজের বিধানটি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
কেননা, এটি মুসলমানের ওপর প্রতিদিন অথবা প্রতি বছর ফরজ হয় না, বরং জীবনে মাত্র একবারই ফরজ হয়ে থাকে। আর হজ পালন আল্লাহর প্রতি বান্দার অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। সম্পদশালী, সচ্ছল ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবানদের জন্য জীবনে একবারই হজ করা ফরজ।
সারা বিশ্ব থেকে পবিত্র নগরী মক্কায় অর্থ ব্যয় করে হাজির হওয়ার মাধ্যমেই হজ পালন করতে হয়। পবিত্র নগরী মক্কায় আসা এবং এখানের আচার-অনুষ্ঠান সম্পাদন, ভ্রমণ ইত্যাদি কার্যক্রমের মধ্যেই শুধু হজের উদ্দেশ্য শেষ হয়ে যায় না বরং হজ পরবর্তী সময়েও রয়েছে তাদের জন্য বিশেষ জীবনযাপন ও আমলি জিন্দেগি।
হজের পর হজ পালনকারীদের উচিত আল্লাহর বিধি-বিধান পালনের প্রতি যথাযথ গুরুত্বারোপ করা। মনীষীগণ বলেছেন, হজ পরবর্তী জীবনে যেন হজ পালনকারী তার ভালো কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। পাপের কাজ থেকে দূরে থাকে। হজ পরবর্তী সময়ে সমাজে ভালো কাজের অংশগ্রহণ বাড়ানো। অন্যায় প্রতিহত করতে বিশ্বনবী (সা.)-এর পন্থায় অবিরাম চেষ্টা-সাধনা চালিয়ে যাওয়া। নিজে যেমন অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকবে তেমনি অন্যকেও অন্যায় থেকে হেফাজত করতে সচেষ্ট থাকা। হজ পালনকারীরা আল্লাহর মেহমান। যাদের হজ কবুল হয়, তাদের জীবনের মোড় ও কর্মের অভিযাত্রা ঘুরে যায়। ভবিষ্যতে গুনাহ থেকে বিরত থাকার আগ্রহ বাড়ে। আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি মানুষ যত্নবান হয়। হজ করার পর যার জীবনে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আসেনি, তার হজ কবুল হওয়ার বিষয়টি সন্দেহমুক্ত নয়। (আপকে মাসায়েল : ৪/২৫)
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান হজে যান। গত ১৫ জুন ২০২৪ পবিত্র হজ পালন করা হয়েছে। সৌদি পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ বছর ১৮ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ হজ করেছেন। তাদের মধ্যে ১৬ লাখ ১১ হাজার ৩১০ জন বিদেশি এবং ২ লাখ ২১ হাজার ৮৫৪ জন সৌদি ও প্রবাসী নাগরিক।
সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, এবার হাজিদের মধ্যে পুরুষ ৯ লাখ ৫৮ হাজার ১৩৭ জন এবং নারী ৮ লাখ ৭৫ হাজার ২৭ জন। এ ছাড়া আরব দেশ ছাড়া এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে এবার সবচেয়ে বেশি মানুষ হজ করেছেন। এই সংখ্যাটা ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে কম মানুষ এসেছে ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে। তাদের সংখ্যা ৩ দশমিক ২ শতাংশ। লাখ লাখ মুসলমান সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মক্কায় কাবা তওয়াফের মধ্য দিয়ে হজ কার্যক্রম শুরু করেন। বাংলাদেশ থেকে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ বছর সরকারি হজযাত্রীর কোটা ছিল ৪ হাজার ৫৬২টি এবং বেসরকারি হজযাত্রীর কোটা ছিল ৮০ হাজার ৬৯৫টি।
চলতি বছর ধর্ম মন্ত্রণালয় নির্ধারিত সাধারণ হজ প্যাকেজের মূল্য ছিল ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৮৪০ টাকা। এ বছর ২৫৯টি এজেন্সি বাংলাদেশ থেকে হজে লোক পাঠিয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৬০টি এজেন্সিকে বিভিন্ন অপরাধে জরিমানা করা হয়েছে।
দেশে গুণী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে; তবে সমাজের অনাচার কি কমছে? দেশ ও সমাজ তাদের মাধ্যমে কতটুকু উপকৃত হচ্ছে। তারাও কি যথাযথভাবে পরিশুদ্ধ হতে পারছেন? অনেকের হজ-ওমরাহ এমন যে, হানিমুন, শপিং, পর্যটন ও প্রমোদভ্রমণ উপলক্ষে দেশ-দেশান্তরে ছুটে চলার চেয়ে ভিন্ন নয়। মক্কা-মদিনার জিয়ারত ও পবিত্র সফর তাদের শুভবুদ্ধি ও সুন্দর অনুভূতি জাগ্রত করতে পেরেছে? যদি না হয়, তা হলে তারা কাক্সিক্ষত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। তাদের হজ কবুল হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ ভালো জানেন। এমন হয়ে থাকলে কর্তব্য হচ্ছে তওবা করা এবং নিয়ত শুধরে পুনরায় তা আদায়ের চেষ্টা করা।
হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে। এখন থেকে হাজিরা যার যার দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাই হজ থেকে ফেরার পর যেসব আমল করবেন, সেসব এখন থেকেই স্মরণ করা ভালো। হজ থেকে ফিরে এসে নিকটস্থ মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নত। হজরত কাব বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো সফর থেকে ফিরে আসতেন, তখন মসজিদে (নফল) নামাজ আদায় করতেন’ (সহিহ বুখারি)। হজ থেকে ফিরে শুকরিয়াস্বরূপ গরিব-মিসকিন ও আত্মীয়স্বজনকে খাবারের দাওয়াত দেওয়া বৈধ। ইসলামি ফিকহের পরিভাষায় সে খাবারকে ‘নকিয়াহ’ বলা হয়।
জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ‘রাসুল (সা.) যখন মদিনায় এসেছেন, তখন একটি গরু জবাইয়ের নির্দেশ দেন। জবাইয়ের পর সাহাবিরা তা থেকে আহার করেছেন’ (সহিহ বুখারি)। তবে অহংকার, লোক-দেখানো ও বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে এমন দাওয়াতের ব্যবস্থা করা ইসলাম অনুমোদন করে না। (ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া : ৭/১৮৫)
হাজিগণ ঘরে ফিরে প্রথমে দুই রাকাত নামাজ পড়বেন। হজ থেকে দেশে ফেরার পর ঘরে পৌঁছে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা মুস্তাহাব। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যখন তুমি ঘর থেকে বের হবে, তখন দুই রাকাত নামাজ পড়বে। সেই নামাজ তোমাকে ঘরের বাইরের বিপদাপদ থেকে হেফাজত করবে। আর যখন ঘরে ফিরবে, তখনও দুই রাকাত নামাজ আদায় করবে। সেই নামাজ তোমাকে ঘরের অভ্যন্তরীণ বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করবে’ (মুসনাদে বাজ্জার)। আর পরিবার-প্রতিবেশীদের কর্তব্য, হজযাত্রীদের অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা জানানো।
যারা হজ করে আসছেন, তাদের অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা জানানো, তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, মুসাফাহ ও কোলাকুলি করা এবং তাদের দিয়ে দোয়া করানো মুস্তাহাব। কিন্তু ফুলের মালা দেওয়া, তাদের সম্মানার্থে সেøাগান ইত্যাদি দেওয়া সীমা লঙ্ঘনের অন্তর্ভুক্ত। এসব কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত (আপকে মাসায়েল আওর ইনকি হল : ১/১৬২)। হজে গেলে হজযাত্রীরা জমজমের পানি সংগ্রহ করেন। বাড়িতে আসার সময় নিয়ে আসেন। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। জমজমের পানি নিয়ে এসে লোকদের পান করানো মুস্তাহাব। রোগীদের গায়ে ব্যবহার করাও বৈধ (মুয়াল্লিমুল হুজ্জাজ : ৩০৩ পৃ)। আয়েশা (রা.) জমজমের পানি সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন এবং বলতেন, ‘রাসুল (সা.) জমজমের পানি সঙ্গে নিয়ে যেতেন।’ (তিরমিজি : ১১৫)
পরিশেষে বলতে চাই, হজ পরবর্তী জীবন তো হবে নতুন এক জীবন, যা পূর্ববর্তী জীবনের ক্লেদাক্ততার কোনো রেশ থাকবে না। আর হজে মাবরুর নসিব হলে হজ-পালনকারী ব্যক্তি সদ্যপ্রসূত ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়। তাই হজ পালনকারী ব্যক্তি হজ-পরবর্তী জীবনে নিজেকে নিষ্পাপ কলুষমুক্ত রাখতে দুনিয়ার সব কাজেই আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করা একান্ত জরুরি। হজসহ ইসলামের সব ধরনের ইবাদত আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনে পালন করা জরুরি। নামাজ পড়ে বিধায় নামাজি; হজ করেছেন বিধায় হাজি ইত্যাদি ব্যবহার থেকে বিরত থাকাও জরুরি। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে লোক দেখানো
ইবাদাত বন্দেগি থেকে হিফাজত করুন। হজ পরবর্তী জীবন-জিন্দেগি ও ইবাদাত-বন্দেগি আল্লাহর পথে ও মতে পরিচালনা করার তওফিক দান করুন।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post