আরাফাতের দিন পবিত্র কাবাঘরকে ধুয়েমুছে এমনভাবে পরিচ্ছন্ন করা হয়, যেন বাসররাতের নববধূ। কারণ, ওই দিন নতুন একটি গিলাফ চাড়ানো হয় তার ওপর। এতে পবিত্র ঘরটির সৌন্দর্য বেড়ে যায় কয়েক গুণ। গিলাফের ওপর স্বর্ণালি অক্ষরের কোরআনের আয়াতগুলো ঝলমল করতে থাকে। কাবার গিলাফ পাল্টানোর সময় এটির দরজা খোলার দৃশ্যটিও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু সবার কি জানা আছে কাবার চাবি বহনকারী ওই ব্যক্তি ও এই দায়িত্ব পালনে তার বংশীয় পরম্পরার কথা?
এই সৌভাগ্যবান মানুষটির নাম শায়খ সালেহ ইবনে জায়নুল আবেদীন আল শাইবা। তিনি সাহাবি হজরত উসমান ইবনে তালহা রা:-এর ১০৮তম উত্তরসূরি। মক্কা বিজয়ের দিন হজরত মোহাম্মদ সা: হজরত উসমান ইবনে তালহার হাতে কাবার চাবি দেন এবং অনাগতকালে তার বংশেই কাবার চাবি সংরক্ষণের দায়িত্ব থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। চৌদ্দ শ’ বছর পরও নবী করিম সা:-এর সেই ওয়াদা বহাল আছে। এখনো ওই বংশের কাছেই কাবার চাবি থাকে। শায়খ সালেহ আল শাইবা ওই বংশের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি, তাই তিনিই এখন পালন করছেন কাবার চাবি সংরক্ষণের দায়িত্ব।
মক্কা বিজয়ের পর থেকে বিগত চৌদ্দ শ’ বছরে অনেক শাসক, সুলতান, রাজা-বাদশাহ মক্কা-মদিনায় কর্তৃত্ব করেছেন। কিন্তু কাবার দরজা খোলার কর্তৃত্ব হজরত উসমান ইবনে তালহার বংশধররা করে আসছেন।
কিভাবে এ দায়িত্ব পেলেন?
মক্কা বিজয়ের দিন। মক্কার সবকিছুই সেদিন হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধীন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমানের কাছে কাবার চাবি চাইলেন। বরকতময় সে চাবি সাথে সাথে নবীর সা:-এর হাতে তুলে দিলেন উসমান। চাবি নিয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে বায়তুল্লাহর দরজা খুললেন। ভেতরে প্রবেশ করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন।
বাইরে তখন অপেক্ষমান জনতা। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হওয়ার পর সবাই সীমাহীন কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। কাকে দেয়া হবে কাবার চাবি, কে পাবে এই মোবারক দায়িত্ব?
হজরত আব্বাস রা: এবং হজরত আলী রা: উপস্থিত ছিলেন সেখানে। দুজনই চাবি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করছিলেন। এমনকি তারা এ ব্যাপারে আবেদনও করেছিলেন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে। কিন্তু না, সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নবী করিম সা: দরাজ গলায় ডাকলেন উসমান ইবনে তালহাকে। তার হাতেই দিলেন কাবার চাবি। বললেন, ‘এখন থেকে এ চাবি তোমার বংশধরের হাতেই থাকবে, একেবারে কেয়ামত পর্যন্ত। তোমাদের হাত থেকে এ চাবি কেউ নিতে চাইলে সে হবে জালিম।’
উসমানের মনে পড়ে গেলো হিজরতের আগের ঘটনা। হিজরতের আগে প্রত্যেক সোম ও বৃহস্পতিবার কাবার দরজা খোলা হতো। এ দু’দিন লোকেরা আল্লাহর ঘরে প্রবেশের সৌভাগ্য লাভ করতো। একদিন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কয়েকজন সাহাবাকে নিয়ে বায়তুল্লায় প্রবেশ করতে চাইলেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালেন উসমান ইবনে তালহা, তিনি তখনো মুসলমান হননি।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধৈর্যের সাথে উসমানের বাধা মেনে নিলেন। সেই সাথে বললেন, ‘উসমান! একদিন তুমি এই চাবি আমার হাতে দেখতে পাবে। আমি তখন যাকে ইচ্ছে চাবিটা দেব।’
এরপর উসমান ইবনে তালহা ইসলাম কবুল করেন। ৪২ হিজরিতে তার মৃত্যু হয়। ইসলাম পূর্ব জাহিলী যুগ ও ইসলাম পরবর্তী যুগে কাবার চাবির রক্ষক তার বংশধররা। সেই ধারা এখনো চলমান। তাদের কাছ থেকে চাবি নিয়েই বিভিন্ন সময় সৌদি আরবের বাদশাহ এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ পবিত্র কাবা ঘরে প্রবেশ করে থাকেন। তারাই কাবার দরজা খুলে দেন।
সাহাবি উসমান ইবনে তালহার ‘বনি শাইবা’ গোত্রের কাছে কাবার চাবি থাকা নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো বিতর্ক হয়নি। ইনশাআল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত এই গোত্রের বংশধরদের কাছেই কাবার চাবি রক্ষিত থাকবে।
৫৮ বার কাবার তালা-চাবি বদলানো হয়েছে
এ পর্যন্ত অসংখ্যবার কাবার তালা-চাবি পরিবর্তন করা হয়েছে। কাবাঘরের চাবি একটি বিশেষ ব্যাগে রাখা হয়। এই ব্যাগটি পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ নির্মাণ কারখানায় বানানো হয়। কাবাঘরের চাবি কখনো হারায়নি। তবে বহু বছর পূর্বে এক ব্যক্তি এই চাবি চুরি করেছিল। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তার কাছ থেকে কাবাঘরের চাবি ফেরত নেয়া হয়।
আব্বাসী, আইয়ুবী, মামলুক ও ওসমানিয়া যুগে কয়েকবার কাবাঘর মেরামত করা হয়েছে। তখন প্রয়োজনমতো নতুন তালা-চাবিও বানানো হয়েছে।
২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর সর্বশেষ কাবাঘরের চাবি পরিবর্তন করা হয়। এখনো ওই তালা-চাবি ব্যবহার করা হচ্ছে। সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সৌদি প্রেস এজেন্সির বরাতে একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০০৯ সালে সৌদি বাদশাহ আবদুল আজিজ সিটি সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজিকে কাবাঘরের পুরাতন তালাটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিশেষজ্ঞ দল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ২০১৩ সালের শেষের দিকে ৩০ বছরের পুরনো মরচে ধরা তালা পরিবর্তন করে। তারা ১৮ ক্যারেট সোনা দিয়ে তৈরি একটি নতুন তালা বানিয়ে দেন। বর্তমানে ব্যবহৃত তালার চাবির দৈর্ঘ্য ৩৫ সেন্টিমিটার। এই তালার আগের তালাটি ওসমানিয়া বাদশাহ আবদুল হামিদ খানের নির্দেশে ১৩০৯ হিজরিতে বানানো হয়েছিল।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বর্তমানে ব্যবহৃত তালা-চাবি বাদে বাকি ৫৭টি তালা ও চাবি অত্যন্ত যত্নের সাথে বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে ৫৪টি চাবি রয়েছে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে ঐতিহাসিক তোপকাপি জাদুঘরে, ২টি চাবি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের বিশ্বখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামে এবং আরেকটি মিসরের কায়রোর ইসলামিক আর্ট মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
ইসলামপূর্ব যুগেও কাবাঘরের যেকোনো ধরনের সেবাকে সৌভাগ্যের কারণ মনে করা হতো। এ কাজে যারা নির্বাচিত হতেন সমাজে তারা পরিচিত হতেন সম্মানিত ও মর্যাদাবান হিসেবে। তখন কাবা ঘরের বিভিন্ন সেবা ভাগ করে দেয়া হতো বিভিন্ন গোত্রের বিভিন্ন মানুষের মাঝে। যেমন, হাজিদের জমজমের পানি পান করাতেন হজরত আব্বাস রা:। কাবায় আলো জ্বালানোসহ আরো কিছু দায়িত্ব ছিলো নবীজীর চাচা আবু তালেবের ওপর। এরই ধারাবাহিকতায় কাবাঘরের চাবির দায়িত্বে ছিলেন উসমান ইবনে তালহা।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post