পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় অন্যতম গন্তব্য এখন মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরব। ইসলামের পবিত্র দুই নগরী মক্কা ও মদিনা এখানেই অবস্থিত। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মুসলমান দেশটিতে হজ ও ওমরাহ পালন করতে যাচ্ছেন। গত বছরও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১০ কোটিরও বেশি পর্যটক সৌদি আরবে গেছেন। বিপুলসংখ্যক পর্যটক আগমনের সুবাদে দেশটির পর্যটন খাতের আয় এখন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল (ডব্লিউটিটিসি)।
ডব্লিউটিটিসির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সৌদি আরব ট্রাভেল ও ট্যুরিজম থেকে ১১৮ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন (১১ হাজার ৮৪৪ কোটি) ডলার আয় করেছে, যা দেশটির মোট জিডিপির ১১ দশমিক ৫ শতাংশ। সৌদি সরকার এখন ভিশন-২০৩০-এর আওতায় আগামী পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যেই পর্যটকের সংখ্যা ১৫ কোটিতে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশী যাচ্ছে সৌদি আরবে। তাদের বড় একটি অংশ প্রবাসী শ্রমিক, যারা দেশটিতে যাচ্ছেন মূলত কর্মসংস্থানের খোঁজে। এছাড়া বাংলাদেশীরা মূলত ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে সারা বছরই দেশটিতে যাতায়াত করছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ট্যুরিজম স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট ২০২০-এ প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশী পর্যটকদের গন্তব্য হিসেবে সৌদি আরবের অবস্থান এখন ভারতের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চে। প্রতি বছর বিদেশে পর্যটনে যাওয়া বাংলাদেশীদের ৮ দশমিক ২১ শতাংশই যাচ্ছেন সৌদি আরবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশীদের দেশটিতে গমনের জন্য সুযোগ আরো অবারিত করেছে সৌদি সরকার। এরই অংশ হিসেবে ওমরাহ ভিসার মেয়াদ ৩০ দিন থেকে বাড়িয়ে ৯০ দিন করা হয়েছে। এ ভিসা ব্যবহার করে বাংলাদেশীরা এখন সৌদি আরবের মক্কা-মদিনা ছাড়া অন্যান্য শহরও ভ্রমণ করতে পারবেন।
বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টার (বিআইসিসি) গত বছরের আগস্টে আয়োজিত এক রোড শো চলাকালে সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহবিষয়ক মন্ত্রী ড. তৌফিক আল-রাবিয়াহ জানিয়েছিলেন, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সৌদি আরব ভ্রমণে বাংলাদেশীদের সংখ্যা বছরে ৩০ লাখে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে তাদের।
সৌদি আরব ভ্রমণে বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়াও সহজ করেছে দেশটির সরকার। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওমরাহ ভিসা দেয়া হচ্ছে। নারীরাও বাধ্যবাধকতা ছাড়াই মক্কা-মদিনায় যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, যা আগে ছিল না। এছাড়া সরাসরি ওমরাহ ভিসার জন্য ‘নুসুক’ নামে অনলাইন প্লাটফর্মে রেজিস্ট্রেশন করে ভিসা নেয়ার সুযোগ, ট্রানজিট ভিসা, যার মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোয় যাওয়ার জন্য বাংলাদেশী নাগরিকদের চারদিনের জন্য ভিসার সুযোগ, সৌদিতে ফ্লাইটের সংখ্যা বৃদ্ধি ও উদ্যোক্তা হিসেবে বিনিয়োগের সুযোগও বাড়িয়েছে দেশটি।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম গালফ নিউজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সৌদি আরবে ওমরাহ পালন করেছেন ৪৫ লাখের বেশি মানুষ। এ তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। গত বছর বাংলাদেশ থেকে ওমরাহ পালন করেছেন ২ লাখ ৩১ হাজার ৯২ জন।
প্রতি বছর গড়ে আড়াই থেকে তিন লাখ বাংলাদেশী ওমরাহ পালনের জন্য দেশটিতে প্রবেশ করছেন। ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর দেয়া হিসাব অনুযায়ী, এসব বাংলাদেশী ওমরাহ, উড়োজাহাজ ভাড়া, ভিসা প্রসেসিং, যাতায়াত ও কেনাকাটা বাবদ মাথাপিছু গড়ে ২ লাখ টাকা করে অর্থ ব্যয় করেন। তিন লাখ বাংলাদেশীর এ ব্যয় হিসাব করলে শুধু ওমরাহ পালনে প্রতি বছর বাংলাদেশীরা ব্যয় করেন বছরে অন্তত ৬ হাজার কোটি টাকা।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে রাজধানীর পল্টনে এক ট্রাভেল এজেন্সি গণমাধ্যমকে জানায়, সৌদি আরবে ট্যুরিস্ট বা ওমরাহ ভিসায় আগের চেয়ে অনেক বেশি বাংলাদেশী যাচ্ছেন। অনেকে হজের সামর্থ্য না থাকায় ওমরাহ পালনের জন্য যাচ্ছেন। সেটি করতে গিয়ে তারা সৌদি আরবের বিভিন্ন শহর ও ধর্মীয় স্থাপনা ঘুরে দেখছেন। এটি এখন প্রতি বছর বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক শিক্ষক এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সৌদি আরবে বাংলাদেশ থেকে অনেকে যাচ্ছেন। দেশটিতে পর্যটনে বাংলাদেশীরা যে সুবিধা পাচ্ছেন, তা পৃথিবীর সব দেশের নাগরিকরা পান না। কিছু দেশ পায় ধর্মীয় কারণে। মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ সমগ্র পৃথিবী থেকেই সৌদি আরবে যান। বাংলাদেশের সংখ্যাটি উল্লেখযোগ্য। এটিকে বলা হয় রিলিজিয়াস ট্যুরিজম বা ধর্মীয় পর্যটন।’
পর্যটনের বাইরে বাংলাদেশীদের শ্রমবাজার হিসেবেও সৌদি আরবের অবস্থান এখন শীর্ষে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে এ পর্যন্ত (১৯৭৬-বর্তমান) অন্তত ৫৭ লাখ প্রবাসী কর্মসংস্থানের জন্য গেছেন। বর্তমানে দেশটিতে কর্মরত রয়েছেন ৩০ লাখের বেশি বাংলাদেশী। ২০২৩ সালে সৌদি আরবের শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন অন্তত ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৪ জন বাংলাদেশী। আর ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির হিসাব অনুযায়ী দেশটিতে গেছেন ৩ লাখ ৬৫ হাজার বাংলাদেশী। বিপুলসংখ্যক এ বাংলাদেশী ২০২৩ সালে দেশটি থেকে কী পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন তার কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে মোট প্রবাসী আয় এসেছে ১ হাজার ৮৯৬ মিলিয়ন ডলার। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৭৮৭ মিলিয়ন ডলার।
সৌদি আরবের মদিনা শহরে বসবাসরত প্রবাসী গণমাধ্যমকর্মী আনিসুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সৌদি সরকার ভিশন-২০৩০ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে তারা জ্বালানি তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের জন্য নানা খাতে বিনিয়োগ উন্মুক্ত করছে। পাশাপাশি তাদের বিভিন্ন শহরে পর্যটক টানতে নানা ধরনের সুযোগ অবারিত করছে। বাংলাদেশীদের অনেকে সৌদি সরকারের বিনিয়োগের সুযোগকে লুফে নিয়েছেন। এখন অনেক বাংলাদেশী উদ্যোক্তা সৌদি আরবে আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি, খেজুর ও সবজির বাগানে বিনিয়োগ করছেন।’
সৌদি আরবে ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশীদের যাতায়াত কভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে বেড়েছে। বিশেষ করে সেখানে ওমরাহ পালনে সারা বছর বাংলাদেশীদের যাতায়াত-থাকায় বেসরকারিভাবে বিমান পরিচালনায় উদ্যোগ নিয়েছে বেসরকারি বিমান পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস। দ্রুতই দেশটিতে ফ্লাইট পরিচালনা করতে যাচ্ছে কোম্পানিটি। আগামী ১ আগস্ট থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে দাম্মাম ও জেদ্দা রুটে প্রথমবাবের মতো ফ্লাইট পরিচালন করবে ইউএস বাংলা।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের জেনারেল ম্যানেজার (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সৌদি আরবে ওমরাহ ভিসায় প্রচুর বাংলাদেশী দেশটিতে যাচ্ছেন। এতদিন দেশটিতে বাংলাদেশ বিমান ও সৌদি এয়ারলাইনস যাত্রী পরিবহন করত। বেসরকারি উড়োজাহাজ চলাচল সংস্থা হিসেবে ইউএস বাংলা দাম্মাম ও জেদ্দা রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্তে সৌদি প্রবাসী এবং দেশটিতে ভ্রমণেচ্ছুদের কাছ থেকে আমরা সন্তোষজনক সাড়া পাচ্ছি। আমরা দেখেছি সৌদি আরবে সারা বছরই বাংলাদেশীরা যাতায়াত করেন। ফলে এ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করলে যাত্রী পাওয়া যাবে, এমন জায়গা থেকেই আমরা পরিকল্পনাটি শুরু করেছি।’
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post