ভাগ্য পরিবর্তনে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য মালয়েশিয়া। ২০১৮ সালে দুই দেশের মধ্যে জিটুজি প্লাস চুক্তির পর থেকে বাজারটি সিন্ডিকেটের কবজায় চলে যায়।
এ সিন্ডিকেট দুই দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মো. হাসিম।
তিনি বলেন, কিছু বিষয় রয়েছে যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, যেটা আপনি সিন্ডিকেটের বিষয়ে বলেছেন। এটা এমন একটা বিষয়, তা মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশ কোনো সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
তবে এর সমাধানের জন্য দুই দেশের সরকার পরস্পরকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া সরকার তাদের পাঁচটি খাতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে রাজি হওয়ার পর ২০১৬ সালে ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়।
পাঁচ বছর মেয়াদী এই সমঝোতা স্মারকের আওতায় লোক পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয় ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সিকে।
এ সময় শ্রমবাজারের সিন্ডিকেট নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে হাইকমিশনার হাসিম বলেন, বাংলাদেশ একমাত্র দেশ নয় যেখান থেকে মালয়েশিয়া কর্মী নিয়ে থাকে। মালয়েশিয়া বিশ্বের ১৫টি দেশ থেকে কর্মী সংগ্রহ করে।
এসব দেশ থেকে আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভালো কর্মী নিয়ে থাকি। আমাদের এখানে সিন্ডিকেট থাকতে পারে, যা বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া উভয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
বুধবার (২৯ মে) রাজধানীর একটি হোটেলে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশের (ডিক্যাব) সঙ্গে মতবিনিময়ের আয়োজন করে মালয়েশিয়ার হাইকমিশন।
তিনি আরো বলেন, ৩১ মের পর বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশ থেকে আর কোনো শ্রমিক মালয়েশিয়ায় ঢুকতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে কুয়ালালামপুর। দেশটির এ সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসবে না বলেও জানিয়েছেন হাসিম।
তিনি বলেন, কর্মীদের কর্মপরিবেশ উন্নত করতে মালয়েশিয়া সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং আন্তরিক। আগামী ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়ায় কোটা অনুযায়ী সব কর্মী পাঠাতে হবে। বিষয়টি আগেই জানানো হয়েছে।
হাইকমিশনার বলেন, এটি লুকানোর কিছু নেই যে মালয়েশিয়ায় প্রচুর অবৈধ লোকজন বসবাস করছে। তাই মালয়েশিয়া সরকার দেশের জাতীয় এবং কর্মীদের নিরাপত্তা স্বার্থ বিবেচনা করে বিদেশি কর্মী-সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা নতুনভাবে সাজাচ্ছে।
আশা করা যায়, এর পর থেকে অবৈধভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ হবে। আশ করছি, সামনে বাংলাদেশ থেকে যারা কুয়ালালামপুরে যাবে, তারা উন্নত পরিবেশ পাবে।
বর্তমানে দুই দেশের উড়োজাহাজের অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, করোনার সময় সব দেশের সীমান্ত বন্ধ ছিল। উড়োজাহাজ প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা করতে পারেনি। তাই পরবর্তী সময়ে তারা সেই লোকসান সমন্বয় করছে।
সেই সঙ্গে বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যবসা করা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মুনাফা দেশে নিয়ে যেতে পারছে না, এ কারণে উড়োজাহাজের ভাড়া অতিরিক্ত। দুই দেশের সম্পর্কে চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশির ভাগ সমস্যাই বাণিজ্যকেন্দ্রিক।
বিশেষ করে মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে কর-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে মালয়েশিয়া প্রথম বাংলাদেশকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছিল। বিষয়টি তখন কঠিন ছিল। তবে মালয়েশিয়া সব সময় বাংলাদেশের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বিষয়ে হাইকমিশনার বলেন, মালয়েশিয়ার ২৬তম রপ্তানি এবং ৪৯তম আমদানি গন্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশ। দুই দেশের বাণিজ্য প্রায় ২৭৮ কোটি মার্কিন ডলার।
এরমধ্যে বাংলাদেশের রফতানি ৩৩ কোটি ডলার। বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ানোর জন্য দুই দেশের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সই করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন তিনি।
হাসিম বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে মালয়েশিয়ার দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রবি আজিয়াটার প্রায় ৪০০ কোটি ডলার।
আর এরই অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ই ডট কো-এর মূল্য হবে ১০০ কোটি ডলার। দুই দেশের মধ্যে এফটিএ সই হলে বাংলাদেশে মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ বাড়বে। তিনি এ দেশে শিক্ষার্থী ও চিকিৎসাপ্রত্যাশীদের মালয়েশিয়ায় আকৃষ্ট করার ওপর জোর দেন।
এদিকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী নিয়ে ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়ে গত ২৮ মার্চ দুদেশের সরকারকে একটি চিঠি পাঠানোর কথা জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয়।
দুই সরকারের তরফে কোনো প্রতিক্রিয়া না আসায় কমিশনের চার জন বিশেষজ্ঞের দেওয়া ওই চিঠি ২৬ মে তারিখে প্রকাশ করে জাতিসংঘের এই সংস্থা।
চিঠিতে বলা হয়, শ্রমিকদের নিয়োগের বিষয়টি শুরুই হয় ‘ঘুষ’ লেনদেনের মাধ্যমে। আর মালয়েশিয়ার মন্ত্রণালয়গুলো, বাংলাদেশ মিশন এবং সিন্ডিকেটের ‘দুর্নীতির’ কারণে বাংলাদেশি কর্মীদের সরকার নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে ‘আট গুণ বেশি’ ব্যয় করতে হচ্ছে।
এর আগে ১৯ এপ্রিল এক বিবৃতিতে ওই বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমরা খবর পেয়েছি দেশের উচ্চ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা এই কাজে জড়িত বা সহযোগিতা করছে।
এটা অগ্রহণযোগ্য এবং থামানো প্রয়োজন। এমন শোষণমূলক নিয়োগের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
চিঠিতে বলা হয়, পরবর্তীতে নিয়োগের অনুমোদন নিতে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি হাইকমিশন এবং বাংলাদেশি সিন্ডিকেট এজেন্টদের পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়।
প্রবাসী কর্মীরা অভিবাসনের জন্য সিন্ডিকেটের কাছে উড়োজাহাজ ভাড়া, পাসপোর্ট ও ভিসার খরচ ছাড়াও প্রকৃত নিয়োগ খরচের চেয়ে অনেক বেশি ফি দিয়ে থাকেন।
বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, অভিবাসীদের প্রতারিত করা হচ্ছে এবং জনপ্রতি সাড়ে চার থেকে ছয় হাজার ডলার পর্যন্ত নিয়োগ ফি নেয়া হচ্ছে।
যা ২০২১ সালে এই দুই দেশের মধ্যে সই হওয়া সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) খেলাফ। ওই এমওইউ অনুযায়ী, এই ফি হবে ৭২০ ডলার পর্যন্ত।
চিঠিতে লেখা হয়েছে, মালয়েশিয়ায় কাজ করতে ইচ্ছুক বাংলাদেশি অভিবাসীরা বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ নিয়োগ ফি প্রদান করেন, যা বাজারে প্রচলিত হারের চেয়ে অনেক বেশি।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একটি অপরাধী নেটওয়ার্ক কাজ করে। তারা কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করে এবং ভুয়া কোম্পানিতে নিয়োগ দেয়।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post