‘পুলিশের তিন কর্মকর্তা ঘুষ নেন বাকিতে’ এই শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। এ ঘটনার পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের শাহআলী থানার ওই অভিযুক্ত তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে ক্লোজড করা হয়েছে।
তারা হলেন- শাহ আলী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. এমাদুল, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) কামরুজ্জামান এবং সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) বদরুজ্জামান।
শাহআলী থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি মওদুদ হাওলাদার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ওসি বলেন, তিন পুলিশ অফিসারকেই ক্লোজড করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত চলছে।
মিরপুরে একটি জুতার দোকানের কর্মচারী মো. ফরিদকে মাঝ রাস্তায় পথ আটকিয়ে তুলে নিয়ে যায় শাহ আলী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. এমাদুল।
ফরিদকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর তার স্ত্রীকে ফোন করেন এসআই এমাদুল। দাবি করেন ৫০ হাজার টাকা।
জানান এই টাকা না দিলে তার স্বামীকে মাদক মামলায় আসামি করা হবে। পরে স্বামীকে বাঁচাতে ৩০ হাজার টাকা দিতে রাজি হন ফরিদের স্ত্রী।
এমদাদুলের কথামতো রাতেই নগদ ২৫ হাজার টাকা দিয়ে স্বামীকে ছাড়িয়ে নেন তার স্ত্রী। আর ৫ হাজার টাকা বাকি রাখেন তিনি। সেই বাকির ৫ হাজার টাকা দুদিন পরে দিয়ে দেন এসআই এমাদুলকে।
ভুক্তভোগী মো. ফরিদ কালবেলাকে বলেন, আমি শাহ আলী মার্কেটের একটি জুতার দোকানে কাজ করি। গত ১৪ রোজায় আমি রাতে দোকান থেকে হেঁটে বাসায় আসিতেছিলাম।
তখন সেখান থেকে এসআই এমাদুল আমারকে ধরে নিয়ে শাহ আলী থানার টিনশেডে নিয়ে যাইয়া, আমারে আটকাইয়া ফালাইছে। আটকাইয়া আমার কয় ফ্যামিলিরে ফোন দে।
তারপর আমি আমার ওয়াইফ-রে ফোন দিছি। এরপর এসআই এমাদুল আমার স্ত্রীকে বলে ওনাকে ছাড়াতে হলে ৫০ হাজার টাকা লাগবে।
ওনার কাছে মদের বোতল পাইছি। আসলে তারা আমার কাছে কিছুই পায় নাই। আমি পান ছাড়া জীবনে আর কিছুই খাই নাই।
তিনি আরও বলেন, এসআই এমাদুল তখন হাতে লাঠি নিয়ে বলে তোকে হিরোইন মামলা দেব, মারব বিভিন্ন রকমের ভয় দেখায়। তখন আমার স্ত্রী ভয়ে বলে ঠিক আছে ২০ হাজার টাকা দেব।
কিন্তু উনি তাতে রাজি হয় না, অনেক মারধোর করছে আমাকে। পরে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে ছাড়ছে। সেই রাতে দিছি ২৫ হাজার। আর বাকি ছিল ৫ হাজার। সেই বাকির ৫ হাজার ২ দিন পরে নিয়েছে।
স্বামীকে বাঁচাতে মাঝরাতে কোলের শিশুকে নিয়ে এত টাকা জোগাড় করা সম্ভব ছিল না ফরিদের স্ত্রীর। তাই বাধ্য হয়ে নিজের কানের দুল বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করেছিলেন তিনি।
ভুক্তভোগী ফরিদের স্ত্রী কুলসুম বেগম কালবেলাকে বলেন, সেই রাতে এমাদুল স্যার আমার জামাইকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর প্রথমে আমাকে কয় ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে।
আমি কই স্যার গরিব মানুষ এত টাকা কই পামু। তখন কয় টাকা না দিলে হিরোইন মামলা দিয়ে লাইফ শেষ করে দিমু।
এটা শুনে তো আমি ভয় পাইয়া যাই। পরে আমি হাতে পায়ে ধরে সেই রাতে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে জামাইরে ছাড়াইয়া আনছি। বাকি ৫ হাজার টাকা পরে দিছি।
শুধু এই স্বামী-স্ত্রীর গল্পই নয়। আরও এক ব্যক্তিকে মামলার ভয় দেখিয়ে তার স্ত্রীর কাছে থেকে দফায় দফায় টাকা নিয়েছেন এসআই এমাদুল।
মোছা. তাসলিমা নামের ভুক্তভোগী ওই নারী কালবেলার কাছে অভিযোগ করে বলেন, আমার স্বামী মুরগির গাড়িতে ডিউটি করে। যেহেতু গাড়িতে থাকে তাই হালকা পাতলা নেশা করেই।
কিন্তু আমার স্বামীর কারণে এসআই এমাদুল বারবার আমার বাসায় গিয়ে টাকা নিয়ে আসে। এ পর্যন্ত দফায় দফায় কমপক্ষে ৭০ হাজার টাকা নিয়েছে।
একদিন আমার ঘরে গিয়ে বলে তল্লাশি করবে। তল্লাশি করে কিছুই পায় নাই। তখন আমার ড্রয়ারে কিস্তির বইয়ের মধ্যে টাকা ছিল সেই টাকাগুলোও নিয়ে গেছে।
আমি এত করে বলছি এগুলো কিস্তির টাকা নিয়েন না। তবুও উনি থাবা দিয়ে টাকা নিয়ে পকেটে ঢুকাইয়া ফেলছে।
শুধু বাকিতেই আটকে নেই এসআই এমাদুল। রাস্তাঘাট থেকে ধরে নিয়ে হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে পকেটে থাকা সমস্ত টাকা বের করে নেন তিনি।
তাতেও কম পড়লে সেই ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের ফোন করে ডেকে নিয়ে আদায় করেন আরও টাকা। তার এসব অপকর্মের সঙ্গী একই থানার এএসআই কামরুজ্জামান এবং এএসআই বদরুজ্জামান।
একই ঘটনা ঘটিয়েছেন গত বছরের ১৬ অক্টোবর রাতেও। রিজন নামের এক ছেলেকে গুদারা ঘাটের ৮নং রোডের একটি চায়ের দোকান থেকে তুলে নিয়ে যান এসআই এমাদুল। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন এএসআই কামরুজ্জামান এবং এএসআই বদরুজ্জামান।
আটকের খবর পেয়ে ভাইকে বাঁচাতে থানায় যান রিজনের ভাই সোহাগ। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন বন্ধু আল আমিন। সেখানে যাওয়ার পরই এসআই এমাদুল ৩ লাখ টাকা দাবি করেন।
টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সোহাগ ও আল আমিনের হাতে হ্যান্ডকাপ লাগায় এএসআই কামরুজ্জামান। পরে সোহাগের পকেটে থাকা ৮ হাজার টাকা এবং আলামিনের পকেটে থাকা ৫ হাজার টাকা বের করে নিয়ে নিজের পকেটে রেখে দেন এই পুলিশ সদস্যরা।
তবুও মেলেনি রক্ষা। তাদের হাজতে ঢুকিয়ে রেখে বিকাশে আরও ১০ হাজার টাকা আদায় করেন এই তিন পুলিশ কর্মকর্তা। সেই তিনজনকে থানায় আটক রাখার ভিডিও এবং টাকা লেনদেনের অডিও পৌঁছেছে গণমাধ্যমের হাতে।
সেই রাতের পুলিশের নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারে কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী সোহাগ। কিন্তু অভিযোগ করার পরই তাকে নানা রকমের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে এই পুলিশ সদস্যরা।
ভুক্তোভুগি সোহাগ কালবেলাকে বলেন, তিন পুলিশের নামে অভিযোগ করার পর থেকেই অনেক চাপে আছি। নানা রকমের হুমকি দিচ্ছে তারা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে শাহআলী থানায় গিয়ে পাওয়া যায়নি অভিযুক্ত ৩ পুলিশের কাউকেই। পরে যোগাযোগ করা হয় তাদের মুঠোফোনে।
প্রত্যেকের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তা রিসিভ করেননি কেউই। এরপর তাদের মুঠোফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠালেও কোনো উত্তর মেলেনি।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অল্প সংখ্যক এমন কিছু পুলিশ সদস্যের কারণে পুরো বাহিনীর সুনাম নষ্ট হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক কালবেলা বলেন, শাহ আলী থানা এলাকার ৩ পুলিশ সদস্য ওইখানের মানুষের মনে যে আতঙ্ক তৈরি করেছে।
পুলিশের এই দুয়েকজন কর্মকর্তার অপেশাদার আচরণের কারণে মানুষের মনে কিন্তু অনেক অবিশ্বাস তৈরি হয়। প্রশ্ন হলো এই তিন পুলিশ যা করছেন তা কি তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দেখেন না।
যদি দেখেও না দেখার মতো থাকেন এটাও অপরাধ। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া খুবই জরুরি।
এতে জনগণ ও পুলিশের মধ্যে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ্য ও বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post