হজের খরচ নিয়ে কয়েক বছর ধরেই নানা অভিযোগ রয়েছে। চলতি বছরের জন্য সম্প্রতি সরকারি ও বেসরকারি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিবছরই অভিযোগ ওঠে- নানা খাত দেখিয়ে হজের খরচ বাড়ানো হয়।
অথচ বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরব দূরত্ব কম হওয়ার পরও হজের খরচ বেশি। সেক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় হজের খরচ কম। যদিও এসব দেশের সরকার গড়ে ৫০ শতাংশ হারে হজ প্যাকেজে ভর্তুকি দিয়ে থাকে। সেখানে বাংলাদেশে ভর্তুকির পরিমাণ কম।
কম দূরত্বের বাংলাদেশ থেকে হজের খরচ বেশি কেন:
সৌদি আরবের দূরত্ব এসব দেশের চেয়ে বাংলাদেশ থেকে কম। কিন্তু বাংলাদেশে হজের খরচ বেশি। বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবের দূরত্ব ৪ হাজার ৮০ কিলোমিটার। এখান থেকে হজের খরচ ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৮৪০ টাকা।
ইন্দোনেশিয়া থেকে দূরত্ব ৭ হাজার ৫২৪ কিলোমিটার। এ দেশ থেকে হজের খরচ ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৩৪৭ টাকা। মালয়েশিয়া থেকে দূরত্ব ৬ হাজার ৪৯০ কিলোমিটার। এ দেশ থেকে হজের খরচ ২ লাখ ৫৮ হাজার ৬০০ টাকা।
পাকিস্তান থেকে দূরত্ব ২ হাজার ৫২৬ কিলোমিটার। এ দেশ থেকে হজের খরচ ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৬১৮ টাকা। ভারত থেকে সৌদি আরবের দূরত্ব ৩ হাজার ৩৩১ কিলোমিটার। এ দেশটি থেকে হজের খরচ ৪ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকার মধ্যে।
বাড়তি খরচ নিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা:
এ বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মতিউল ইসলাম বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের হজযাত্রীদের কয়েকটি খাতে খরচ বেশি হয়।
বাংলাদেশের হজযাত্রীরা মক্কার মিসফালা এলাকায় থাকেন। অন্য দেশের হজযাত্রীরা থাকেন মক্কার আজিজিয়া এলাকায়। আজিজিয়ার চেয়ে মিসফালা এলাকার বাসা ভাড়া বেশি।
তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশের সরকার হজের ক্ষেত্রে প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভর্তুকির পরিমাণ কম। মিনার অবস্থান আজিজিয়ার কাছে। তাই মিনায় অন্য দেশের হজযাত্রীরা পায়ে হেঁটে যেতে পারেন।
কোনো বাস ভাড়া করতে হয় না। অপরদিকে মিসফালা থেকে বাংলাদেশি হজযাত্রীদের মিনায় আনা-নেয়া করতে প্রতি ১০০ জনের জন্য একটি বাস ব্যবহার করা হয়। এতে খরচ বেড়ে যায়। মিনায় তাঁবুতে থাকার ভাড়াও বাড়তি দিতে হয়।
অন্যান্য দেশের হজযাত্রীদের মদিনায় যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে নন-এসি বাস ভাড়া করা হলেও বাংলাদেশিদের জন্য এসি বাস ভাড়া করা হয়।
হজযাত্রীরা যেসব অভিযোগ করেন:
হজযাত্রীদের যথাযথ সেবা না দেওয়ার বিষয়টিও প্রতিবছর আলোচনায় থাকে। অনেকে অভিযোগ করেন- সরকারি-বেসরকারি দুই জায়গাতেই কিছু সিন্ডিকেট নানাভাবে হজের খরচ বাড়াতে কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করে।
বিশেষ করে বেসরকারি এজেন্সিগুলো এ সময় বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এর আগে অনেক এজেন্সির লাইসেন্সও বাতিল করা হয়েছে। তারপরও তাদের দৌরাত্ম্য কমে না।
প্রতিবছর হজযাত্রী সংগ্রহের সময় মক্কার কাছে মানসম্মত থাকা-খাওয়া ও সুষ্ঠুভাবে হজের আনুষ্ঠানিকতা আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে এজেন্সিগুলো।
কিন্তু মক্কায় পৌঁছার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়- কাবাঘর থেকে অনেক দূরে, মানহীন, এমনকি পাহাড়ের উপর হাজিদের রাখা হয়। মানহীন খাবার পরিবেশন, নির্দিষ্ট খাত ছাড়াও বাড়তি টাকা আদায় করা হয়ে থাকে।
এছাড়া দেশে সময়মতো টিকিট ও ফ্লাইটের ব্যবস্থা না করা, এক তারিখের কথা বলে ঢাকায় এনে অন্যদিন ফ্লাইট করানো, এমনকি টাকা নিয়ে চম্পট দেওয়ার মতো অভিযোগও হজ মৌসুমে পাওয়া যায়।
২০২৩ সালে প্রতারণার শিকার ৭০৯ হজযাত্রী:
২০২৩ সালে হজ মৌসমে ১৭১ জন হজযাত্রীর সঙ্গে প্রতারণা করে বিএসবি ট্রাভেলস ও আল হেলাল ট্রাভেলস নামে দুটি এজেন্সি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একটি এজেন্সিরও লাইসেন্স ছিল না।
তারা হজযাত্রীদের ভিসা না দিয়ে, হজ ক্যাম্পে না নিয়ে, হোটেল ভাড়া না দিয়ে মোটা অংকের অর্থ আত্মসাৎ করেছে। পরে এজেন্সি মালিকদের আইনের আওতায় নেয়া হয়।
একই বছর রাজধানীর শ্যামপুরের এসএম ট্রাভেলসের দ্বারা প্রতারণার শিকার হন ৫৩৮ হজযাত্রী। তাদের প্রায় ৪ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যান এজেন্সির মালিক শাহ আলম। ফলে তাদের হজযাত্রা অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
পরে ঐ এজেন্সির মালিককে সৌদি আরব থেকে গ্রেফতার করে দেশটির পুলিশ। একইভাবে অর্ধশত হজযাত্রীর কাছ থেকে টাকা নিয়েও তাদের হজে পাঠাতে পারবে না বলে জানায় আকবর হজ এজেন্সি।
পরে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ে। এরপর সৌদি আরব থেকে গ্রেফতার করা হয় এজেন্সি মালিক মাহমুদুর রহমান এবং তার ছেলে সাদ বিন মাহমুদকে।
২০২৩ সালে আট এজেন্সিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ:
নানা অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২৩ সালে কমপক্ষে আটটি এজেন্সিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়। ঐ আটটি এজেন্সি হলো- আল কাশেম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস, ইউরো বেঙ্গল ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম, ইউরোপা ট্রাভেলস, কে আই ট্রাভেলস, এল আর ট্রাভেলস, এন জেড ফাউন্ডেশন অ্যান্ড হজ মিশন, শাকের ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস ও শানজারি ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস।
এ বছর হজ প্যাকেজে কোন খাতে কত খরচ:
এ বছর দুটি হজ প্যাকেজেই খরচের অংক ২০২৩ সালের তুলনায় কিছুটা কমেছে। সরকারিভাবে ১ লাখ ৪ হাজার ১৭৮ টাকা কমে মোট খরচ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৮৪০ টাকা, বেসরকারিভাবে ৮২ হাজার ৮১৮ টাকা কমিয়ে খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৮০০ টাকা। আর বিশেষ প্যাকেজ ৬ লাখ ৯৯ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে ২০২৩ সালে সরকারিভাবে হজ প্যাকেজের খরচ ধরা হয়েছিল ৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। আর বেসরকারি প্যাকেজে খরচের সর্বনিম্ন সীমা ছিল ৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা।
ধর্ম মন্ত্রণালয় ২০২৪ সালের হজ প্যাকেজে দেখা গেছে, বাড়ি ভাড়া, বিমান টিকিট ও সার্ভিস চার্জ আগের বছরের চেয়ে কমেছে। এ বছর বিমান ভাড়া ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮০০ টাকা, যা ২০২৩ সালে ছিল ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। এবার মক্কা ও মদিনায় বাড়ি ভাড়া ১ লাখ ৬৯ হাজার ৪১০ টাকা। এই খাতে গত বছর ২ লাখ ৪ হাজার ৪৪৫ টাকা ব্যয় করতে হয়েছিল হাজিদের।
২০২৩ সালে তাঁবু, ম্যাট্রেস, বিছানা, চাদর, বালিশ, কম্বল, খাবার সরবরাহে মোয়াল্লেম সার্ভিস চার্জ ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার ৬৩০ টাকা। এবার এই সার্ভিস চার্জ ও অন্যান্য চার্জের মোট অংক ১ লাখ ২৬ হাজার ৩৮৪ টাকা। এর বাইরে পরিবহন ব্যয় বা ভিসা ফি’র মতো খরচগুলো প্রায় অপরিবর্তিতই রয়েছে।
যেভাবে কমানো হলো হজের প্যাকেজ মূল্য:
হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি শাহাদত হোসাইন তসলিম বলেন, হজের অনেকগুলো খরচ নির্ধারিত। যেমন- বিমান ভাড়া কমানোর কোনো সুযোগ নেই। যেটা সরকারের নির্ধারিত থাকে সেটাই এখানে খরচ করতে হয়।
এছাড়া সৌদি আরবে কিছু চার্জ আছে, যেগুলো সৌদি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত। শুধুমাত্র কম্প্রোমাইজ করা যায় মক্কা, মদিনার হোটেল ভাড়ায়। আর, মিনা-আরাফায় যে তাঁবু আছে সেগুলোর ক্যাটাগরি আছে। এ, বি, সি বা ডি ক্যাটাগরি নেয়া যায়। আমরা এই জায়গাগুলোতেই মূলত কম্প্রোমাইজ করেছি।
তিনি আরো বলেন, হাজিদের কাছে হোটেলের মানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন হোটেল মক্কা, মদিনা, হারাম শরিফের কাছাকাছি। এসব ক্ষেত্রে দূরত্বটা একটু বাড়িয়ে খরচে ভারসাম্য আনা হয়েছে।
যে কারণে হজের খরচ বাড়ে-কমে:
হাবের সাবেক সহ-সভাপতি ফরিদ আহমেদ মজুমদার বলেন, এ বছর মক্কার বাড়ি ভাড়া ৭ হাজার ২০০ রিয়াল থেকে কমিয়ে ৪ রিয়াল নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু মক্কা ও মদিনার বাড়ি ভাড়া বাস্তবে কমেনি, বরং বেড়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের পলিসি হলো আগের যে দূরত্বে বাড়ি ভাড়া করা হতো, এখন আরো দুই কিলোমিটার দূরে বাড়ি ভাড়া করা হবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশে সাধারণ প্যাকেজের উপযোগিতা খুব একটা নেই। হজযাত্রীরা এই প্যাকেজের প্রতি আগ্রহী না। আমাদের দেশের লোকজন বয়োবৃদ্ধ অবস্থায় হজের নিয়ত করেন, যে কারণে অত দূর থেকে হারাম শরীফে গিয়ে ইবাদত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ইন্দোনেশিয়া-আফ্রিকার মানুষ কম বয়সে হজ করেন, এ কারণে তাদের দূর থেকে হারাম শরীফে আসতে কষ্ট কম হয়। এ কারণে এসব দেশে হজের খরচ কম।
সরকারি ও বেসরকারি হজ প্যাকেজের মধ্যে খরচের পার্থক্য বেশি নয়। দুটো প্যাকেজই সামঞ্জস্যপূর্ণ। এক্ষেত্রে সার্ভিসের ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি-কম হতে পারে বলেও জানান হাবের সাবেক সহ-সভাপতি।
কোন দেশে হজের খরচ কেমন:
নানা কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হজের খরচ কম-বেশি হয়। বেশ কিছু দেশেই বাংলাদেশের চেয়ে হজের খরচ কম। তবে এ বছর প্রায় সব দেশেই আগের চেয়ে হজের খরচ তুলনামূলক বেড়েছে।
ইন্দোনেশিয়া: ইন্দোনেশিয়া থেকে একজন মুসলমানকে এ বছর হজে যেতে খরচ করতে হবে ৩ হাজার ৩০০ ডলার বা ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৩৪৭ টাকা, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি। বাকি টাকা সরকারি ‘হজ ফান্ড ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি’ তহবিল থেকে ভর্তুকি দেওয়া হবে।
মালয়েশিয়া: মালয়েশিয়ায় যেসব পরিবারের মাসিক আয় ৯৬ হাজার টাকার কম, সেসব পরিবারের সদস্যদের জন্য হজের খরচ ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৮ হাজার ৭৫৪ টাকা। মাসিক আয় এর বেশি হলে দিতে হবে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৬০০ টাকা। দেশটিতে হজের জন্য সরকার বড় অংকের ভর্তুকি দিয়ে থাকে। তবে বেসরকারি হজ প্যাকেজগুলো বাংলাদেশি টাকায় ৯ লাখ টাকা থেকে শুরু হয়েছে।
পাকিস্তান: পাকিস্তানে গত বছরের তুলনায় হজের খরচ ৩৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ বাড়িয়ে এ বছর ১১ লাখ ৭০ হাজার পাকিস্তানি রূপি নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশি টাকায় যা ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৬১৮ টাকা।
ভারত: ভারতের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন হজ কমিটি অব ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছে, এ বছর তারা সর্বনিম্ন যে হজ প্যাকেজ স্থির করেছে রাজ্য বা স্থানভেদে সেটি ৩-৪ লাখ রুপি। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৪ থেকে সাড়ে ৫ লাখের মধ্যে।
সিঙ্গাপুর: সিঙ্গাপুরে হজের খরচ গত বছরের তুলনায় প্রায় দেড় হাজার ডলার বেড়েছে। সেখানে সবচেয়ে কম প্যাকেজের জন্য দিতে হবে ৬ লাখ ৬০ হাজার ৯২০ টাকা।
সার্বিক বিষয়ে ধর্মমন্ত্রী মোহাম্মদ ফরিদুল হক খান গণমাধ্যমকে বলেন, প্রতারণা করলে অভিযুক্ত হজ এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অতীতের মতো হজযাত্রীদের সঙ্গে কোনো ধরনের বিরূপ আচরণ কিংবা প্রতারণা করলে লাইসেন্স বাতিলসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post