সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি দুই দিনের সফরে পাকিস্তান গিয়েছিল। এই সফরকে দেশের জন্য ‘লাভজনক’ বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তারা।
রমজানের শেষে মক্কায় প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান একটি বৈঠক করেন। সে সময় অর্থনৈতিক বিষয়ে, বিশেষত পাকিস্তানে বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের মতে ওই বৈঠকের পরবর্তী ধাপই হলো এই সাম্প্রতিক সফর।
পাকিস্তান সফরে এসে স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কাউন্সিলের সঙ্গে বিনিয়োগের পরিবেশ ও সুযোগ নিয়ে আলোচনা করেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সল। পাশাপাশি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি।
সফরের শেষে প্রিন্স ফয়সল পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একটা যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন।
সেখানে পাকিস্তান সফরকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে বর্ণনা করে সে দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে আশাপূর্বক মন্তব্যও করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, তিনি পাকিস্তানের অর্থনীতির উন্নতির বিষয়ে আশাবাদী।
পাকিস্তান – সৌদি আরব সম্পর্ক
গত এক দশকে পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্কের উত্থান-পতন ঘটেছে। ইয়েমেন যুদ্ধে পাকিস্তানের অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত সৌদি আরব ভলোভাবে নেয়নি।
পিটিআইয়ের শাসনকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মালয়েশিয়াতে ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোর সংগঠন ওআইসি’র বৈঠক আয়োজনের যে চেষ্টা করেছিলেন সেটি সৌদি আরবের পছন্দ হয়নি।
তবে শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের সাম্প্রতিক পর্বে দুই দেশের সম্পর্ক আবারও উন্নতির দিকে। সৌদি আরবের কাছ থেকে শতশত কোটি ডলার বিনিয়োগের আশা করছে পাকিস্তান।
সৌদি প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্ত করে পাকিস্তানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন তারা বিনিয়োগ করলে পূর্ণ সুরক্ষা ও সমর্থন করবে পাকিস্তান।
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন পাকিস্তানে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
তিনি বলেন, ইনভেস্টমেন্ট কাউন্সিলের বিস্তারিত ব্রিফিং-এর পর বিষয়টিকে তারা আরও ইতিবাচক দিক থেকে দেখছেন। একই সঙ্গে জানিয়েছেন পাকিস্তানের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পছন্দ হয়েছে তার।
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের পর থেকেই পাকিস্তানে বিনিয়োগ নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠছে যেমন কোন কোন খাতে বিনিয়োগ করা হবে বা তার (বিনিয়োগের) আকার কতটা বড়।
পাকিস্তানের মতো একটি ‘অস্থিতিশীল’ এবং ‘দুর্বল অর্থনীতির’ দেশে বিনিয়োগ করে সৌদি আরব কীভাবে লাভবান হবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
পাকিস্তান-সহ মিত্র দেশগুলোকে সরাসরি সহায়তা না দিয়ে সৌদি আরব এখন কেন বিনিয়োগনীতি অনুসরণ করছে- সে বিষয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
কোন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হবে?
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আয়োজিত এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুহম্মদ ইসহাক দার জানিয়েছেন, পাকিস্তান সৌদি আরবকে তথ্যপ্রযুক্তি, খনিজ, কৃষি, জ্বালানি ও অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
পাকিস্তানের পরিকল্পনা বিষয়ক মন্ত্রী আহসান ইকবাল এবং বিশেষ বিনিয়োগ সুবিধা কাউন্সিলের (এসসিআইএফ)-এর সচিব জামিল আহমেদ কোরেশির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল বিবিসি। তবে তারা এই বিষয়ে কিছু বলতে চাননি।
অর্থনীতি বিষয়ক সিনিয়র সাংবাদিক শাহবাজ রানা জানিয়েছেন, এই বিষয়টা ঠিক যে পাকিস্তানের কর্মকর্তারা বিনিয়োগের বিষয়ে এখনও পর্যন্ত স্পষ্টভাবে কিছু বলেননি।
তিনি বলেন, “এই সফর নিয়ে গণমাধ্যমে কার কথা বলা উচিত – এসসিআইএফ, বিদেশ মন্ত্রক না প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়- সে বিষয়য়ে সরকার এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি।”
মি. রানা জানিয়েছেন, পাকিস্তান সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর নিয়ে দ্বিধা ছিল।
এর আগে পাকিস্তান সৌদি আরবের কাছে বিনিয়োগের জন্য যে অনুরোধ জানিয়েছিল তার জবাবেই একটা সৌদি প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানে বিনিয়োগের সুযোগের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা।
ওই প্রবীণ সাংবাদিক ব্যাখ্যা করেছেন, সৌদি প্রতিনিধি দল এখন ফিরে যাবে এবং বিনিয়োগ সম্পর্কিত সিদ্ধান্তের কথা পাকিস্তান সরকারকে জানাবে।
অর্থনৈতিক বিষয়ক বিশ্লেষক খুররম হুসেন জানিয়েছেন, বিনিয়োগ নিয়ে পাকিস্তান সরকার কোনও কিছু স্পষ্টভাবে বলেনি তার কারণ রয়েছে।
পাকিস্তান সৌদি আরবকে সম্ভাব্য বিনিয়োগের সুযোগের একটি তালিকা দিয়েছে। কোন কোন খাতে সৌদি আরব বিনিয়োগ করতে পারে এবং মুনাফা অর্জন করতে পারে সে বিষয়ে তথ্য দেওয়া হয়েছে। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে পাকিস্তানের দেয়া তালিকায় উল্লখ করা কয়টি খাতে বিনিয়োগ করবে সৌদি আরব।
যেহেতু নির্দিষ্ট খাতে বিনিয়োগ এবং তার আকার সম্পর্কে সৌদি আরবের সিদ্ধান্ত জানে না তাই তাড়াহুড়ো করতে চাইছে না পাকিস্তান সরকার।
সৌদি আরবের সম্ভাব্য বিনিয়োগের প্রশ্নে খুররম হোসেন বলেন, সফরে কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী তারা। এর মধ্যে রয়েছে খনিজ, খনন, বিশেষত রিকোহ ডেক প্রকল্প।
সৌদি আরবের কী লাভ?
কেন পাকিস্তানে বিনিয়োগ করবে সৌদি আরব সে বিষয়ে জিজ্ঞসা করা হলে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও পাকিস্তানের বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক প্রধান হারুন শরিফ বিবিসিকে বলেন, “এই প্রশ্নের দুটি দিক রয়েছে। প্রথমটা হল পাকিস্তানের অস্থিতিশীল অর্থনীতি, যার কারণ পূর্ববর্তী সরকারগুলোর নীতি। ”
“আপনি যদি পাকিস্তানের অর্থনীতিতে কর্পোরেট মুনাফার (অর্থাৎ বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলোর মুনাফার হার) বিষয়টা লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন বেসরকারি কোম্পানির মুনাফা খুবই ভাল।”
বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত প্রায় ৮৩টি কোম্পানির মুনাফা এশিয়ার বাকি সংস্থার মুনাফার চাইতে অনেক বেশি। এ থেকে বোঝা যায়, পাকিস্তানের বেসরকারি খাতে চাহিদা এবং সুযোগ দুই-ই রয়েছে।”
মি. শরিফের মতে সৌদি আরব পাকিস্তানে বিনিয়োগ করতে চায় কারণ ভিশন ২০৩০ এর অধীনে তারা অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করে তুলতে চায়।
পাকিস্তান তাদের কৌশলগত ও কূটনৈতিক সহযোগী, মুসলিম দেশ হিসাবে সেখানেও নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চায় সৌদি আরব।
হারুন শরীফ বলেন, পাঁচ বছর আগে বিনিয়োগের ভিত্তিতে এই অংশীদারিত্বের বৈচিত্র্য আনার বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা হয়।
মূলত তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে তৈরি এটা। এর মধ্যে প্রথমটা হল ধর্মীয় পর্যটন, দ্বিতীয় সৌদি আরবে কর্মরত পাকিস্তানের মানুষ এবং তৃতীয়টা হল প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব।
খুররম হুসেন এ নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করেছেন। তার মতে এর উত্তর খুঁজতে হলে সৌদি আরবের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে।
সৌদি আরব গত তিন-চার দশক ধরে প্রায় সব খাতে তেল থেকে অর্জন করা অর্থ বিনিয়োগ করে আসছে। তবে বিনিয়োগের বেশিরভাগটাই সৌদি আরবের ভেতরে করা হচ্ছিল।
এখন মিশর থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত বাজার খুঁজছে সৌদি আরব, যেখানে শুধুমাত্র মূলধন বিনিয়োগই নয় ভৌগলিকভাবেও নিজেদের প্রভাব বাড়াতে পারবে তারা।
মি হারুন জানিয়েছেন, সৌদি আরব এমন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী যাতে তারা লাভবান হবে। একই সঙ্গে তাদের অর্থনীতি এবং কৌশলগত গুরুত্বও বাড়বে।
তিনি বলেন, পাকিস্তানে সৌদি আরবের বিনিয়োগের আরেকটি কারণ হচ্ছে দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং মধ্যপ্রাচ্য এবং আরব বিশ্বে উত্তেজনা।
পাকিস্তানের সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে সৌদি আরবের। ঠিক সেই কারণেই বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না করে সরকারি প্রকল্পে অর্থ ঢালতে আগ্রহী তারা।
কেন সাহায্যের পরিবর্তে বিনিয়োগ?
কেন পাকিস্তানকে সহায়তার বদলে বিনিয়োগের নীতি বেছে নেওয়া হচ্ছে? সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে খুররম হুসেন বলছেন, কয়েক বছর আগে থেকেই মিত্র দেশগুলোকে সাহায্য করা বন্ধ করেছে সৌদি আরব।
শুধু পাকিস্তানই নয়, সৌদি আরব থেকে সাহায্য গ্রহণকারী সব দেশকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ভবিষ্যতে সাহায্যের প্রয়োজন হলে তারা যেন সহায়তার আর্জির বলদে বিনিয়োগ প্রকল্পের প্রস্তাব দেয়।
মি. খুররমের মতে, শুধু পাকিস্তান নয়, মিশরও সৌদি আরবের কাছ থেকে প্রচুর সহায়তা পেয়েছে। কিন্তু কিছুদিন আগেই নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে সৌদি আরব। তারা জানিয়েছে সহায়তার বদলে বিনিয়োগের নীতি অনুসরণ করবে তারা।
হারুন শরিফ জানিয়েছেন, এই নতুন নীতির আওতায় কিছুদিন আগে সৌদি আরবকে বিনিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল পাকিস্তান। এরপর পাকিস্তান সফর করেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
তিনি বলেছেন, “এই অঞ্চলের বাজারে লাভজনক ও কৌশলগতভাবে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী সৌদি আরব।”
একদিকে পাকিস্তানে বৈদেশিক মুদ্রার জন্য ডলারের প্রয়োজন আর সৌদি আরব খুঁজছে এমন একটা মার্কেট যেখানে তারা বিনিয়োগ করতে পারে। তাই দুই পক্ষের জন্যই এটা জয়ের পরিস্থিতি।
তবে তার মতে এই বিনিয়োগ পাকিস্তানের সরকারকে চলতি হিসাবের ঘাটতি কমাতে সাহায্য করলেও সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেবে না।
তার যুক্তি এই অর্থ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নয় এটা এসেছে সার্বভৌম সম্পদ তহবিল বা পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট থেকে যা সৌদি আরবের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ভারসাম্য বজায় রাখে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post