আর্জেন্টিনা ফুটবল তারকা দিয়েগো ম্যারাডোনার মৃত্যুতে শোক বার্তা পাঠিয়েছেন ওমানের সুলতান হাইথাম বিন তারিক। ওমান নিউজ এজেন্সি (ওএনএ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “সুলতান হাইথাম বিন তারিক আর্জেন্টিনা ফুটবল তারকা দিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনার মৃত্যুতে আর্জেন্টিনা প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি আলবার্তো ফার্নান্দেজকে শোকের বার্তা প্রেরণ করেছেন।”
আর্জেন্টিনার বস্তি থেকে আজকের ম্যারাডোনা
সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার ডিয়েগো ম্যারাডোনা। জন্ম ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসে। ম্যারাডোনার নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা জেতে। ওই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর জোড়া গোলের একটি ‘গোল অব সেঞ্চুরি’র মর্যাদা পায়।
আর অন্যটি ‘হ্যান্ড অব গড’ হিসেবে ব্যাপক আলোচিত। ফিফার বিশ শতকের সেরা ফুটবলারের তালিকায় তিনি ও ব্রাজিলের পেলে যৌথভাবে প্রথম স্থান অধিকার করেন। গত ২৫ নভেম্বর এই কিংবদন্তি ফুটবলার মারা গেলেন। ম্যারাডোনার আত্মজীবনী ‘এল ডিয়েগো’ ও সার্বিয়ান সংবাদপত্র পলিটিকায় দেওয়া ম্যারাডোনার সাক্ষাৎকার অবলম্বনে তাঁর জীবনের কিছু গল্প রইল এখানে…
আজকের বিশ্ব সেরা ফুটবল তারকা ম্যারাডোনার নাম কে না জানে? কিন্তু এই ম্যারাডোনার মা অর্থের অভাবে ৩ বেলা পেটপুরে খেতেও পারেননি। পেটব্যথার ভান ধরে কিছু খেতেন না ম্যারাডোনার মা৷ তার মা সেই খাবার তাঁর সন্তানদের জন্য রেখে দিতেন৷
ম্যারাডোনার বাবা কাভানটাকা মার্কেটে কাজ করতেন৷ তিনি সব সময় ভারী ব্যাগ বহন করতেন৷ বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ঘাড়ে ব্যাগ টানতেন৷ তার বাবা যখন বাড়ি ফিরতেন, তাঁর পিঠ আর ঘাড়ে বরফের ব্যাগ রেখে দিতেন তার মা৷
আরো পড়ুনঃ বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি, প্রবাসীদের ক্ষোভ
ম্যারাডোনা বলেন, মাঝেমধ্যে আমি চিন্তা করি, আমার পুরো জীবনই যেন এক সিনেমা৷ সিনেমার রিলে যেন আমার জীবনের সব ছবি ধারণ করে রাখা আছে৷ সবাই ছোটবেলায় বিখ্যাত কাউকে অনুসরণ করে৷
আমার ছোটবেলায় আর্জেন্টিনায় সত্যিকারের বিখ্যাত অনুকরণীয় ফুটবলার কেউ ছিল না৷ ফুটবল ছিল তখন আর্জেন্টিনার গরিব আর বস্তিতে থাকা ছেলেদের মুক্তির একটা বড় উপায়৷ দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচতে আমরা ফুটবলকে বেছে নিতাম৷
বুয়েনস এইরেসে আমরা খুব ছোট্ট একটা বাড়িতে থাকতাম৷ ছাদ দিয়ে বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকে যেত৷ আমার বয়স যখন তিন, তখন আমার এক কাজিন আমাকে একটা চামড়ার বল উপহার দেয়৷ সেটাই ছিল আমার প্রথম বল৷ আমি সেই বলটিকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাতাম।
আমার বাড়ির পেছনেই ছিল চতুর্থ লিগের এক ফুটবল দলের স্টেডিয়াম৷ আমি সারা দিন এলাকার আনাচকানাচে ফুটবল খেলতাম৷ সন্ধ্যায় অন্য সব ছেলেপেলে বাড়ি ফিরে গেলে আমি আরও খেলতাম৷ অন্ধকার হওয়ার ঘণ্টা দুয়েক পরও আমার পায়ে ফুটবল থাকত৷
অন্ধকারে আমি চোখে কিছুই দেখতাম না৷ সে জন্য আমি শুধু সামনের দিকে বল কিক করে যেতাম৷ আমি দুটি কাঠি দিয়ে গোলপোস্ট বানাতাম৷ অন্ধকারে সেই গোলপোস্টের অদৃশ্য জালে কিকের পর কিক করে যেতাম৷
এর বছর দশেক পর, যখন আমি প্রথম ক্লাব আর্জেন্টিনো জুনিয়র্সের হয়ে চুক্তি করি, তখন বুঝেছিলাম অন্ধকারে সেই ফুটবলচর্চা আমার কত কাজে লেগেছে৷ আমার প্রথম আয় করা টাকা দিয়ে আমি এক জোড়া ট্রাউজার কিনেছিলাম৷
আরো পড়ুনঃ প্রাকৃতিক সুন্দরের অপরূপ লীলাভূমি ওমান
আমার জন্ম বুয়েনস এইরেসের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত অংশ ফ্যাবেল ফিওরিটোতে৷ সেই অঞ্চলের দারিদ্রের মাত্রা আর আমার ছোটবেলার বন্ধুরা এখনো সেই আগের মতোই আছে৷ শুধু রাজনীতিবিদ আর সরকারি লোকেরাই দিনকে দিন ধনী হচ্ছে৷
আমার সামনেও ধনী হওয়ার অনেক সুযোগ ছিল৷ কিন্তু আমি সেই সুযোগকে ‘না’ করে দিই৷ আমার ‘না’ বলার পেছনে যুক্তি ছিল, আমাকে ধনী হতে হলে গরিবের কাছ থেকে চুরি করতে হবে৷
আমি একবার গরিবদের কথা বলার জন্য আর্জেন্টিনার রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু কেউ আমার একটি কথাও শোনেনি৷ আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল কিংবা কিউবা সব জায়গাতেই একই সমস্যা—দারিদ্র। ধনী দেশগুলো জন্য আমাদের এই দীনতা৷
এটা সত্য, কোনো কিছু বদলে দেওয়া বেশ কষ্টকর৷ কিন্তু এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা সেই কুশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে জানি৷ কেউ গরিবদের পক্ষে কথা বলে না৷ সেটা স্বয়ং পোপ থেকে শুরু করে সব দেশের রাজনীতিবিদেরা৷ বার্লিন ওয়াল ধ্বংসের পরে সারা পৃথিবীতে দারিদ্র্যের সংখ্যা বেড়েছে নয় গুণ৷ এদের দেখার কেউ নেই৷
আরও পড়ুনঃ শান্তিপ্রিয় একটি দেশের নাম ওমান
আমি সব সময় আমার বাবার কথা মনে আনি৷ বাবা যখন কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতেন, আমরা তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতাম৷ আট সন্তানের জন্য তিনি বেশি কিছু আয়ও করতে পারতেন না৷ আমরা চুপ করে বাড়িতে বসে থাকতাম৷ আমাদের কোনো খাবার থাকত না৷ আমাদের কষ্ট কেউ বুঝবে না৷ আপনি যদি ক্ষুধার্ত না হন, তাহলে আমার কষ্ট বুঝতে পারবেন না৷
আমার বোন কম খেত, যেন আমি রাতের বেলায় বেশি খেতে পারি৷ এমন পরিস্থিতিতে আপনার অন্য মানুষের প্রতি মায়া, মমতা আর ভালোবাসা তৈরি হবে৷ আমার মা পেটব্যথার ভান ধরে কিছু খেতেন না৷ তিনি সেই খাবার তাঁর সন্তানদের জন্য রেখে দিতেন৷ পাত্রের শেষ দানাটুকু পর্যন্ত তিনি আমাদের দিয়ে দিতেন৷ এই কষ্ট নিয়েই আমার বেড়ে ওঠা৷
আরো পড়ুনঃ সুলতান কাবুস ছিলেন একজন মহা নায়ক
আমার মা আমাকে মিথ্যা বলে খাওয়াতেন৷ কেউ কেউ একে কল্পকাহিনী বলে উড়িয়ে দেয়৷ কিন্তু আমার কাছে দারিদ্র্যই সত্য, বাস্তবতা৷ আমি সেসব কষ্টের সময়ের কথা ভুলিনি৷ আমি যে ভুলতে পারব না৷ আমার বাবা কাভানটাকা মার্কেটে কাজ করতেন৷
তিনি সব সময় ভারী ব্যাগ বহন করতেন৷ বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ঘাড়ে ব্যাগ টানতেন৷ বাবা যখন বাড়ি ফিরতেন, তাঁর পিঠ আর ঘাড়ে বরফের ব্যাগ রেখে দিতেন মা৷ আমরা ভাইবোনেরা অবাক হয়ে তা দেখতাম৷
আমি ছোটবেলায় কখনো জন্মদিন উদযাপন করতে পারতাম না৷ আমাদের কখনোই টাকাপয়সা হাতে থাকত না৷ জন্মদিনে আমার পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন আমার গালে চুমু দিত৷ সেই চুমুই ছিল আমার জন্য বড় উপহার৷
আমি ম্যারাডোনা, যে কিনা গোল করতে পারে, আবার ভুল করতে জানে৷ আমি সব বাধা নিজের মতো করে লড়তে জানি৷ আমার মা সব সময় চিন্তা করতেন আমিই সেরা৷ নিজের ওপর বিশ্বাস রাখাই সবচেয়ে কঠিন শ্রমের কাজ৷ আমি ছোটবেলা থেকে আমার মায়ের বিশ্বাসকে শক্তভাবে ধারণ করেছি৷
ফুটবল মাঠে বলের পেছনে দৌড়ানোই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সুখের স্মৃতি৷ সমালোচকেরা আমার নামে অনেক কিছুই বলে৷ কিন্তু কেউ বলতে পারবে না আমি ঝুঁকি নিতে পারি না৷
ক্যারিয়ারের শীর্ষে বিশ্বের সর্বাধিক বেতনের খেলোয়াড়দের একজন ছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। সারা জীবন আয়ও করেছেন বিপুল। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস জানিয়েছে, নাপোলির সঙ্গে চুক্তির সময় ৩০ লাখ ডলার বেতনের পাশাপাশি বিভিন্ন পণ্যের বাণিজ্যিক দূত হয়ে ১ কোটি ডলার আয় করেছিলেন আর্জেন্টাইন তারকা।
তাঁর ওই ১ কোটি ৩০ লাখ ডলারের মূল্য এখনকার সময়ে প্রায় দ্বিগুণ, ২ কোটি ৬০ লাখ ডলারের সমান। জীবনের বিভিন্ন সময় ফুটবলের সঙ্গে জড়িয়ে থেকে আয় করেছেন বিপুল অঙ্কের অর্থ। অথচ এক্সপ্রেস ডটকমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত্যুর সময় এই ফুটবল কিংবদন্তির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৮৫ লাখ টাকার মতো।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রম বাজার ওমান
ফুটবল কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনার মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান আর্জেন্টিনা। দেশটিতে ইতিমধ্যে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক শুরু হয়েছে। আর্জেন্টিনায় নিজ বাড়িতে গত ২৫-নভেম্বর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ম্যারাডোনা। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।
ম্যারাডোনার মৃত্যুতে শুধু আর্জেন্টিনাতেই নয়, সারা বিশ্বে ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে শোক নেমে এসেছে। দেশে দেশে ভক্তরা ফুটবলের এই জাদুকরকে নানাভাবে স্মরণ করছেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাচ্ছেন। ফুটবল কিংবদন্তি দিয়াগো মারাডোনার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দু:খ প্রকাশ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ বিশ্ব নেতারা।
সদ্য প্রয়াত এই কিংবদন্তির বিখ্যাত কিছু উক্তিঃ
– ‘বল দেখা, এর পেছনে ছোটার মাধ্যমে আমি হয়ে উঠি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।’
– ‘আমি ভুল করেছি এবং সেগুলোর জন্য মাশুলও গুণেছি। কিন্তু বল এখনও খাঁটি।’
– ‘আমি ম্যারাডোনা। যে গোল করে, ভুলও করে। আমি এগুলো সবই বয়ে বেড়াতে পারি। সবার সঙ্গে লড়াই করার মতো বিশাল এক কাঁধ রয়েছে আমার।’
– ‘আপনি আমার সম্পর্কে অনেক কথা বলতে পারেন। কিন্তু আমি ঝুঁকি নেই না, এ কথা কখনও বলতে পারবেন না।’
– ‘আমি কালো কিংবা সাদা হতে পারি কিন্তু জীবনে কখনও ধূসর হব না।’
– ‘আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা সবকিছুই ঘৃণা করি। আমি এগুলোকে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘৃণা করি।’
ফুটবলের আরেক কিংবদন্তি পেলের সম্পর্কে
– ‘পেলে এবং আমার মধ্যে কে সেরা তা নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকবে না। সবাই আমার কথাই বলবে।’
– ‘পেলের উচিত যাদুঘরে চলে যাওয়া।’
আরো পড়ুনঃ ওমানের কিংবদন্তি সুলতান কাবুস
হ্যান্ড অব গড সম্পর্কে
– ‘(গোলটি দেয়ার পর) আমি চাইছিলাম সতীর্থরা আমাকে জড়িয়ে ধরুক কিন্তু কেউ আসছিল না…আমি তাদের বললাম, এসো আমাকে জড়িয়ে ধর। নাহলে রেফারি এটা বাতিল করে দেবে।’
– ‘ক্ষমা চেয়ে ইতিহাস পাল্টে দিতে পারলে আমি অবশ্যই তা করতাম। কিন্তু গোলটি এখনও একটি গোলই। আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হল এবং আমি হয়ে গেলাম বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়।’
মেসি ও রোনালদো সম্পর্কে
– গোল করার পরে মেসি স্বাভাবিক উদযাপন করে। আর ক্রিশ্চিয়ানো গোল করে এমন ভাব করে যেন সে শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন শ্যুটিং করছে।
আরো দেখুনঃ ওমানের কিংবদন্তি সুলতান কাবুস
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post