বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন সুনাবান ও পূর্ণিমা মণ্ডল নামে দুই বৃদ্ধা। দুজনেরই বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তারা।
‘ভাইবোনকে মানুষ করতে গিয়ে বিয়ে করিনি, এখন তারা খোঁজ নেয় না’
সম্ভবত সেই দৃষ্টি সবকিছু ভেদ করে পৌঁছে গেছে তাদের অতীতে। এক পলকেই যেন অতীত জীবনের হিসাব কষছেন তারা।
এক সময় যাদের জন্য প্রাণ উজাড় করে দিয়েছিলেন আজ বার্ধক্যের অসহায়ত্বে তারাই ছেড়ে গেছেন।
তাই দুই বৃদ্ধার ঠাঁই হয়েছে ‘বেলাশেষে’ নামে এক বৃদ্ধাশ্রমে। তাদের সঙ্গে আলাপ হয় গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে।
বৃদ্ধা সুনাবান প্রতিবেদককে বলেন, আমার বাড়ি নড়াইল পৌরসভার ভাটিয়ায়। আমার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় তার কাছে যেতে পারি না। সাত সন্তানের কেউ বেঁচে নেই। আছে শুধু তিন বোন।
বৃদ্ধাশ্রমে আসার আগে ওদের কাছেই থাকতাম। এক বোনই আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছে। এখানে ভালো আছি। থাকা-খাওয়ায় কোনো সমস্যা নেই। ইফতারি-সেহরিতেও ভালো মানের খাবার পাচ্ছি। বোনের বাড়ি মাঝে মাঝে বেড়াতেও যাই। তবে কিছুদিন হলো বোন হজ্বে গেছে। তাই সে বাড়িতে অনেকদিন যাওয়া হয় না।
পার্শ্ববর্তী জেলা যশোর থেকে বৃদ্ধাশ্রমে আসা পূর্ণিমা মণ্ডল বলেন, চার ভাই আর এক বোনকে আমি মানুষ করেছি। এখন ভাই-বোন আমাকে চেনে না। তাদের মানুষ করেছি কিন্তু কপাল পুড়েছে আমার।
ভাই-বোনকে মানুষ করতে গিয়ে জীবনে বিয়ে করতে পারিনি। এখন তারা কেউ খোঁজ খবর নেয় না। তাই নিজেই এসেছি বৃদ্ধাশ্রমে। দুই বছর ধরে এখানেই আছি। এখানে থাকা-খাওয়ার কোনো সমস্যা নেই।
শুধু সুনাবান বা পূর্ণিমা মণ্ডল নয় তাদের মতো আরও ৫ জন অসহায় বৃদ্ধ নারী-পুরুষের ঠাঁই হয়েছে নড়াইল সদর উপজেলার শাহাবাদ ইউনিয়নের আলোকদিয়ায় গড়ে ওঠা ‘বেলাশেষে’ বৃদ্ধাশ্রমে।
২০২২ সালে পারবারিক উদ্যোগে বৃদ্ধাশ্রমটি চালু করেন নড়াইল জজ কোর্টের আইনজীবী হেমায়েত উল্লাহ হিরু। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত এখানে এসেছেন মোট ৩২ জন অসহায় বৃদ্ধ নারী-পুরুষ।
তাদের মধ্যে অনেককেই পরিবারের মানুষেরা ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। বর্তমানে রয়েছেন ৪ জন পুরুষ ও ৩ জন নারী।
বর্তমানে প্রায় ৪০ জনের আবাসনের সুব্যবস্থা রয়েছে বৃদ্ধাশ্রমটিতে। কোনো কিছুরই অভাব নেই। ফলে অসহায়দের কাছে বেলাশেষে হয়ে উঠেছে শেষ আশ্রয়স্থল।
কিশোরগঞ্জ থেকে বৃদ্ধাশ্রমে আসা দুলালুর রহমান খান (৭৫) বলেন, জায়গা-জমি যা ছিল মেয়েকে লিখে দিয়েছি। মেয়ে আমাকে কাছে রাখতে চায় কিন্তু জামাই রাখে না। তাই আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছেন।
মেয়ে ফোনে খোঁজখবর নেয়। কিন্তু বাড়িতে ফিরিয়ে নেয় না। একেবারে ফিরে যেতে মন চায় কিন্তু মেয়ে ভরণপোষণ দিতে পারবে না ভেবে এখানেই পড়ে আছি। এখানে আল্লাহ ভালোই রেখেছে।
তিন মাস আগে এই বৃদ্ধাশ্রমে এসেছেন মুন্সী আব্দুল্লাহ (৬৩) নামে আরেক বৃদ্ধ। তিনি এসেছেন নড়াইল সদর উপজেলার কামালপ্রতাপ গ্রাম থেকে।
তিনি জানান, আগে ট্রাকের ড্রাইভার ছিলেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসারও ছিল তার। পরে স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়। নয় বছরের মেয়েটিও এখন তার মায়ের কাছে থাকেন। তাকে দেখার মতো কেউ নেই। শরীরও অসুস্থ। এখানেও ভালো আছেন। থাকা-খাওয়ার সমস্যা নেই, চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে।
বৃদ্ধাশ্রমের সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় এর প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডভোকেট হেমায়েত উল্লাহ হিরুর সঙ্গে। তিনি বলেন, অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা থেকেই পারিবারিকভাবে বৃদ্ধাশ্রমটি গড়ে তুলেছি।
এখানে আসা অসহায়দের বিনা পয়সায় থাকা, খাওয়া, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য নেওয়া হয়েছে নানান পরিকল্পনা।
সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষকে উদ্যোগী করতে নির্দিষ্ট একটি ফি জমাদানের মাধ্যমে তাদেরকে দাতা সদস্য করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এই কয়েকদিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি খাওয়া-দাওয়ার চেয়ে বয়স্ক লোকের চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি।
ফলে যাকাত তহবিলের একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই টাকা শুধু চিকিৎসা খাতে ব্যয় করা হবে। তাই বিত্তবানদের যাকাতের টাকা এখানে দেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post