মারা গেছেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনা। ৬০ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন বিশ্ব ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সেরা তারকা। আর্জেন্টাইন গণমাধ্যমগুলো বলছে, হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন বিশ্বকাপজয়ী এই তারকা।
সম্প্রতি বেশকিছু রোগে ভুগছিলেন তিনি। চলতি মাসেও মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেন তিনি। সেবার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে ২ সপ্তাহ হাসপাতালে ছিলেন তিনি। শেষপর্যন্ত সার্জারি সাকসেসফুল হয়েছিল তার। তবে এবার আর ফিরতে পারেননি ফুটবল ঈশ্বরখ্যাত এই মহাতারকা। হাসপাতাল থেকে ফেরার মাত্র ২ সপ্তাহের মাথায়, এবার চিরকালের জন্য বিদায় নিলেন ম্যারাডোনা।
ক’দিন আগে ৬০ বছর বয়সে পা রাখেন তিনি। এর আগেও বেশ কয়েকবার মৃত্যুর মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। মাঠ এবং মাঠের বাইরে সমানভাবে আলোচনায় থাকা ম্যারাডোনা ২০০০ সালে একেবারে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেবার দীর্ঘদিন পর হাসপাতাল থেকে মুক্তি পান তিনি। ২০০৫ সালেও জটিল রোগে ভুগতে হয়। পরবর্তীতে ২ বছর পুনর্বাসনে কাটাতে হয় তাকে।
খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই মাদকাসক্ত ছিলেন এই আর্জেন্টাইন তারকা। তার ব্যক্তিগত আইনজীবি মাতিয়াস মোরলাহাস গণমাধ্যমকে জানান, অতিরিক্ত মাদকাসক্তির জন্য শেষমুহূর্তেও মেডিসিন নিচ্ছিলেন তিনি।
আরো পড়ুনঃ বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানী
বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাবগুলো মাতিয়েছেন ম্যারাডোনা। ইতালিয়ান ক্লাব নাপোলিকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করে তুলেছিলেন তিনি। তবে সব ছাপিয়ে, ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনাকে একক নৈপুণ্যে বিশ্বকাপ জেতানোর জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন এই কিংবদন্তি ফুটবলার।
দিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা। ফুটবলেরই আরেক নাম। অনেকে ফুটবল বিশেষজ্ঞ, সমালোচক, সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড় এবং ফুটবল সমর্থক তাকে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবেই গণ্য করেন। ফিফার বিংশ শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়ে তার পাশে ছিলেন কেবলই ব্রাজিলের আরেক কিংবদন্তি পেলে।
দুবার ট্রান্সফার ফির বিশ্বরেকর্ড গড়া একমাত্র ফুটবলার ম্যারাডোনা। প্রথমবার বার্সেলোনায় স্থানান্তরের সময় ৫ মিলিয়ন ইউরো এবং দ্বিতীয়বার নাপোলিতে যাওয়ার সময় ৬ দশমিক ৯ মিলিয়ন ইউরো। নিজের পেশাদার ক্যারিয়ারে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স, বোকা জুনিয়র্স, বার্সেলোনা, নাপোলি, সেভিয়া এবং নিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে খেলেছেন এ কিংবদন্তি।
আর্জেন্টিনার হয়ে ৯১টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ৩৪টি গোল করেছেন ম্যারাডোনা। চারটি বিশ্বকাপ খেলা এ ফুটবলার দেশটি একক নৈপুণ্যে বিশ্বসেরার ট্রফি জিতিয়েছেন। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে তার অবদান শুধু আর্জেন্টিনাতেই নয়, বিশ্ব ফুটবলে রাজার আসনে আসীন করেছে তাকে। বলা যায়, এই ম্যারাডোনাই দুনিয়াজুড়ে আকাশি-সাদা জার্সির লাখো কোটি ভক্ত সমর্থক তৈরি করে গেছেন।
আরো পড়ুনঃ ওমানে চাকরীর সুযোগ
১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা ২–১ গোলে জয় লাভ করে। আর্জেন্টিনার পক্ষে দুটি গোলই করেন ম্যারাডোনা। দুটি গোলই ফুটবল ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে দুটি ভিন্ন কারণে। প্রথম গোলটি ছিল হ্যান্ডবল যা “হ্যান্ড অব গড” নামে খ্যাত। দ্বিতীয় গোলটি ম্যারাডোনা প্রায় ৬০ মিটার দূর থেকে ড্রিবলিং করে পাঁচজন ইংলিশ ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে করেন। ২০০২ সালে ফিফাডটকমের ভোটাররা গোলটিকে শতাব্দীর সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত করেন।
ঈশ্বরের বিচরণ সর্বত্র। তাই বলে ফুটবল মাঠে এসে দৈববলে নিজের হাতে গোল দিয়ে দেবেন? ব্যাপারটা কেউ হয়তো কল্পনায়ও আনবেন না। যদি না তার নাম ডিয়েগো ম্যারাডোনা না হয়! চোখ-ধাঁধানো পারফরম্যান্স দিয়ে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ মাতিয়ে রেখেছিলেন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক।
শেষ পর্যন্ত সে আসরের শিরোপাটাও উঠেছিল ম্যারাডোনারই হাতে। মাঠের দুর্দান্ত নৈপুণ্যের পাশাপাশি অকল্পনীয় এক বিতর্কের জন্ম দিয়েও স্মরণীয় হয়ে আছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার। এই বিশ্বকাপেরই কোয়ার্টার ফাইনালে তিনি ইংল্যান্ডের জালে বল পাঠিয়েছিলেন হাত দিয়ে।
পরে নিজেই সেই গোলের ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, ঈশ্বরই তার হাত দিয়ে গোলটা করিয়ে নিয়েছেন! সেই থেকে গোলটির গায়ে পাকাপাকিভাবে বসে যায় ‘ঈশ্বরের হাতের গোল’ উপাধিটি। সেই ফুটবলা ঈশ্বর ডিয়েগো ম্যারাডোনা পুরো ফুটবল বিশ্বকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কয়েক দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ৬০ বছর বয়সী এই কিংবদন্তি তিগ্রে-তে নিজ বাসায় মারা যান ম্যারাডোনা।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রম বাজার ওমান
আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাজ্যের মধ্যকার ফকল্যান্ড যুদ্ধের কারণে খেলায় ফুটবলীয় উত্তেজনার বাইরেও অন্য রকম উত্তেজনা ছিল। আশির দশকে ইংল্যান্ডের কাছে ফকল্যান্ড যুদ্ধে হারের দগদগে স্মৃতিটা তখনো তাজা আর্জেন্টাইনদের মনে।
তাই স্বাভাবিকভাবে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড ও আর্জেন্টিনার মাঠে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পাশাপাশি গ্যালারি ও দুদেশের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনায় চলে আসে ম্যারাডোনার সেই গোল।
কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে দুপক্ষের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে প্রথমার্ধ শেষ হয় গোলশূন্যভাবে। উত্তেজনাকর ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধ ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত ও অন্যতম সেরা ঘটনার জন্ম দেয়। আর্জেন্টাইন অধিনায়ক ম্যারাডোনা খেলার ৫১তম মিনিটে একটি গোল করে দলকে এগিয়ে দেন।
কিন্তু পরে টেলিভিশন রিপ্লেতে দেখা যায়, গোলটি করার সময় ম্যারাডোনা হাত ব্যবহার করেন। হাত দিয়ে বলে আঘাত করে তিনি সেটিকে গোলপোস্টের দিকে ঠেলে দেন। ম্যারাডোনা নিজেও পরে স্বীকার করেছিলেন যে তিনি গোলটি ইচ্ছাকৃতভাবেই হাত দিয়ে করেছিলেন, তার মাথায় বল স্পর্শ করেনি। সে মুহূর্তে তিনি জানতেনও গোলটি অবৈধ।
আরো পড়ুনঃ প্রাকৃতিক সুন্দরের অপরূপ লীলাভূমি ওমান
ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক পিটার শিলটন সঙ্গে সঙ্গেই অনেক প্রতিবাদ করেছিলেন। চার-পাঁচজন ইংলিশ ফুটবলার গোল বাতিলের দাবি জানিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন রেফারির দিকে। কিন্তু ব্যাপারটি রেফারি সত্যিই বুঝে উঠতে পারেননি। অন্যদিকে ম্যারাডোনাও সতীর্থদের সঙ্গে এমনভাবে গোল উদযাপনে মেতে ওঠেন যে সেটি বাতিল করার চিন্তাও আসেনি কারো মাথায়।
এমন বিতর্কিত গোলের ঠিক চার মিনিট পরেই দ্বিতীয় গোল করেন এই আর্জেন্টাইন তারকা। যে গোলকে পরে ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসের সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত করে। মাঠের অর্ধেকের বেশি অংশ দৌড়িয়ে, পাঁচজন ইংরেজ ডিফেন্ডার ও গোলরক্ষক পিটার শিলটনকে কাটিয়ে গোল করেন ম্যারাডোনা। ২০০২ সালে ফিফা অনলাইনে ভোটের আয়োজন করলে এই গোলটি ‘শতাব্দীর সেরা গোল’ হিসেবে নির্বাচিত হয়। কিন্তু সব ছাপিয়ে বিতর্কিত হয়ে আছে ম্যারাডোনার ‘ঈশ্বরের হাতের’ গোল।
আরো পড়ুনঃ রাষ্ট্রদূতদের একহাত নিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
২০০৫ সালের ২২ আগস্ট এক টেলিভিশন শোতে এসে ম্যারাডোনা পুরোনো বিতর্ক উসকে দেন। ওই প্রোগ্রামে তিনি স্বীকার করেন, বলে তার মাথা ছোঁয়নি, বরং হাত লেগেছে। তবে তার সুকৌশলী উত্তর ছিল এমন, ‘ম্যারাডোনার খানিকটা মাথা আর ঈশ্বরের খানিকটা হাত, এ দিয়েই গোল!’
শুধু কোয়ার্টার ফাইনালের সাফল্য নয়। সেমিফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষেও তিনি জোড়া গোল করেন। ফাইনালে প্রতিপক্ষ পশ্চিম জার্মানি তাকে ডাবল মার্কিং করে রাখে। তা সত্ত্বেও তারই বাড়িয়ে দেওয়া পাসে আর্জেন্টিনার পক্ষে জয়সূচক গোল করেন হোর্হে বুরুচাগা। ইস্তাদিও আজতেকার এক লাখ ১৫ হাজার দর্শকের সামনে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ৩–২ গোলের ব্যবধানে জয় লাভ করে শিরোপা বাগিয়ে নেয় আর্জেন্টিনা।
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের পুরো প্রতিযোগিতাজুড়ে ছিল ৫৮ বছর বয়সী ম্যারাডোনার দাপট। প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের আতঙ্কের কারণ ছিলেন তিনি। কেবল নিজের একক নৈপুণ্যে বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলতে সক্ষম হয় আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনার ঈশ্বরের হাত না থাকুক, তবে নিজের দেশকে এমন গৌরবময় সাফল্য এনে দেওয়ায় আর্জেন্টাইনদের কাছে তিনি হয়ে আছেন ‘ফুটবলের ঈশ্বর’।
আরো দেখুনঃ
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post