অন্যান্য যানবাহনের মতো বিমানেরও আয়ুষ্কাল থাকে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট করে দেয় কত বছর ধরে একটি বিমান নিরাপদে ওড়ানো যাবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই বিভিন্ন কারণে একটি বিমান ওড়ার অযোগ্য হয়ে পড়তে পারে। তাহলে প্রশ্ন জাগে, অবসরপ্রাপ্ত বিমানগুলোর কী হয়?
সিএইচ অ্যাভিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বে ২২ হাজার ৭৯৯টি সচল বিমান রয়েছে। একটি বিমান তৈরিতে প্রচুর টাকা খরচ হয়। তবে এর আয়ুষ্কাল বেশি দিন নয়। প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে পুরনো বা অবসরে যাওয়া বিমানগুলোর কোথায় যায়? কী গতি হয় সেগুলোর?
দ্য ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্স অ্যাসোসিয়েশনের (আইএসটিএ) হিসাব অনুযায়ী, গত ৩৫ বছরে সারা বিশ্বে যাত্রীবাহী এবং কার্গো বিমান মিলে ১৬ হাজার বাণিজ্যিক বিমান অবসরে গেছে। প্রতিবছর প্রায় ৭০০টি জেট বিমানের মেয়াদকাল ফুরিয়ে আসছে। অবসরে যাওয়া অথবা অকেজো হয়ে যাওয়ার পর বিমানগুলো অক্ষত ভাবেই রাখা হয় কি? কখন আর একটি বিমান ওড়ার যোগ্যতা রাখে না?
একটি গাড়ির আয়ুষ্কাল পরিমাপ করা হয় গাড়িটি কত দূর অতিক্রম করেছে তার ওপর। বিমানের ক্ষেত্রে বিষয়টা আলাদা। আপাতদৃষ্টিতে বিমানের বয়স অনুযায়ী আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করা উচিত বলে মনে হলেও বাস্তবে তা হয় না। এক্ষেত্রে বোয়িং, এয়ারবাস, বম্বার্ডিয়ার, ড্যাসল্ট, এমব্রেয়ার এবং গালফস্ট্রিমের মতো বড় বড় এরোস্পেস ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানিগুলো বিমানের আয়ুষ্কাল নির্ধারণে ব্যবহার করে কিছু মাপকাঠি বা নির্দেশককে।
এক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় বিমানটির পারফর্মড টেকঅফ (কতবার সেটি টেকঅফ করেছে), ল্য়ান্ডিং সাইকেল (কতবার ল্যান্ড করেছে), ফ্লাইট আওয়ার (কতক্ষণ উড়েছে) মেইন্টেন্যান্স আওয়ার (কতক্ষণ রক্ষণাবেক্ষণ) হয়েছে ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একটি পুরু কাঠামোর এয়ারবাস এ৩২০ বিমান অবসরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার সাইকেল সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। অন্য়দিকে একটি চওড়া কাঠামোর বোয়িং ৭৪৭ বিমান সহ্য রতে পারে ৩৫ হাজার সাইকেল বা ১ লাখ ৬৫ হাজার ফ্লাইট আওয়ার। সাধারণ এই পরিমাণ সাইকেলে পৌঁছাতে একটি বিমানের মোটামুটি সময় লাগে ৩০ বছর।
আইটিএর মতে করোনার সময় বিশ্বজুড়ে এয়ারলাইন্সগুলো অপেক্ষাকৃত পুরোনো এবং কম কর্মক্ষম, বিশেষ করে বড় কাঠামোর যাত্রীবাহী বিমানগুলোকে দ্রুত অবসরে পাঠাতে পেরেছিল। পরিবেশগত কারণে ও ফ্লাইটের নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি এড়াতে মেয়াদোত্তীর্ণ বিমানগুলোকে সরানোর কাজটি পরিচালনা করতে হয় খুব সাবধানে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক এরোস্পেস স্ট্র্যাটেজি কনসাল্টেন্সি নেভিও-এর হিসাবে দেখা গিয়েছে, প্রতি বছর মোট বিমানের গড়ে ১.৭ শতাংশ থেকে ৩.৪ শতাংশ বিমান অবসর গ্রহণ করে। সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০২১ সালে গোটা বিশ্বে বিমান অবসরের গড় হার ছিল ১.৫ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত আনুমানিক ৬৫টি বিমান স্ক্র্যাপ করতে পাঠানো হয়।
২০২০ সালে ৭৩৮টি বিমানকে পাঠানো হয় অবসরে। এই বিমানগুলোর গড় বয়স ছিল ২৩.১২ বছরের কাছাকাছি। অন্যদিকে ২০২১ সালে অবসরে যাওয়া ৪২৯টি বিমানের গড় বয়স ২৩.০৯ বছর ছিল। নেভিও-র অনুমান আগামী বছরগুলিতে আরও বেশি সংখ্যক বিমানকে অবসরে পাঠানো হবে। তবে এই সংখ্য়াটি নির্ভর করে বিমান সারাইয়ের গতি, জ্বালানির দাম, নতুন বিমান তৈরির একাধিক ইস্যুর ওপর।
সার্ভিস থেকে অব্যাহতির পর কোথায় রাখা হয় বিমানগুলোকে?
দুর্ঘটনা এড়াতে অনেক সময় আয়ুষ্কাল শেষের আগে অবসরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিমানগুলোকে। বিমানকে অবসরে পাঠানোর অর্থ সবসময় এই নয় যে সেগুলো অকেজো হয়ে গিয়েছে। অনেক সময় অনেক দিন ধরে বিমানগুলোকে রাখা হয় সংরক্ষণাগারে। পরে বাজারের অবস্থার উন্নতি হলে সক্রিয় করা হয় সেগুলোকে। অনেক সময় এয়ারলাইন্সগুলো ছোট এয়ারলাইন্সের কাছে বিক্রি দেয় বিমানগুলোকে।
যদি বিমানের যন্ত্রাংশের দাম বিমানের দামের থেকে বেশি হয় তখন বিমানটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় একেবারে অবসরে। এক্ষেত্রে বোনইয়ার্ডে পাঠানো হয় বিমানগুলোকে।
বোনইয়ার্ড সাধারণত মরুভূমিতে থাকে। কারণ মরুভূমির শুষ্কতায় মরিচা ধরার মাত্রা অনেক কম। ছোট-বড় মিলিয়ে একটি বিমানে প্রায় তিন লাখের বেশি যন্ত্রাংশ থাকে। যন্ত্রংশগুলো মেরামত করে অন্য বিমানে ব্যবহার করা যায়। বোনইয়ার্ডে বিমানের মূল্যবান যন্ত্রাংশগুলো পুনর্ব্যবহার বা পুনঃবিক্রির জন্য বের করে নেওয়া হয়। বাকি কাঠামো স্ক্র্যাপ করা হয়।
একটি স্ক্র্যাপট বিমানের অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে দৈনন্দিন ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা হয়। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পানীয়র ক্যান, এরোসেল বোতলের ঢাকনা, জানালার ফ্রেম, কয়েন ইত্য়াদি। ইঞ্জিন কম্পার্টমেন্টের মতো যন্ত্রাংশ পুনর্ব্যবহার করা যায়। বিমানের ফার্নিচারগুলো দিয়ে এভিয়েশন থিমের বিভিন্ন কেবিন, কনফারেন্স ডেস্ক ও চেয়ার তৈরি করা যায়। অনেক উদ্যোক্তা অবসরপ্রাপ্ত বিমানগুলোতে হোটেলও বানিয়েছেন।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post