পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিনই কমবেশি বিভিন্ন বয়সী মানুষের আনাগোনা থাকে। কেউ আসেন পাসপোর্ট করতে আর কেউ আসেন পাসপোর্ট নেওয়ার জন্য। এই আসা-যাওয়ার মধ্যে হঠাৎ করে নতুন কাউকে দেখলে তার আশপাশ ঘিরে বাড়ে আগন্তুক ব্যক্তির নজরদারি। একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করা হয়— ‘আপনি কি পাসপোর্ট করতে এসেছেন?’
কথাবার্তার মারপ্যাঁচে কেউ জালে আটকা পড়ে আগন্তুকের হাত ধরে পাসপোর্ট করেন আর কেউ পরিস্থিতি বুঝে কেটে পড়েন। আগন্তুক এই প্রশ্নকারী আসলে অনিয়মের মাধ্যমে পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়া চক্রের সদস্য। রংপুর বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে রয়েছে এই চক্রের বহু সদস্য।
সম্প্রতি গণমাধ্যমের দুই প্রতিবেদক রংপুর বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে এক সপ্তাহ ধরে যাওয়া আসা করে সরেজমিনে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের কেউ কেউ চক্রের মাধ্যমে সহজে পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। আবার কেউ কেউ সংশোধনের আবেদন করে ঘুরছেন মাসের পর মাস।
শুধু অসাধু চক্র আছে তাই নয়, পাসপোর্ট অফিসে সেবা প্রদানের দায়িত্বে থাকা আনসার ও পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধেও রয়েছে উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ। আর দালাল চক্রের ব্যবসার ধরন পরিবর্তন হওয়ায় এখন সেখানে বদলেছে ‘সেবার ধরনও’।
তবে অনলাইনে সব ধরনের সেবাগ্রহণ প্রক্রিয়া সহজ করার ফলে আগের চেয়ে ভোগান্তি, উৎকোচ প্রদানের হার ও বিড়ম্বনা কিছুটা কমে এসেছে বলে কেউ কেউ জানিয়েছেন।
তথ্য মিলবে বিলম্বে, নেপথ্যে দালাল চক্র
পরিচয় গোপন রেখে নতুন পাসপোর্ট করতে কী কী লাগবে, এমন তথ্য জানতে চাইলে পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত সদস্যরা তথ্য দিতে বিলম্ব করেন। এরই মধ্যে অপরিচিত একজন এসে জানতে চান পাসপোর্ট করব কি না। উত্তর দেওয়ার আগেই ওই ব্যক্তি নিজে থেকেই তার হাতে থাকা পাসপোর্ট দেখিয়ে বলেন, ‘এখানকার লোকেরা আপনাকে তথ্য দেবে কিন্তু এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সহজে তারা তথ্য দেবেন না। সময় নষ্ট না করে বাইরের যেকোনো একটি কম্পিউটারের দোকানে যান, সেখানে সব তথ্য পাবেন। আপনি চাইলে তারা সবকিছু করে দেবে। শুধু তাদের একটু বকশিশ দিলেই পুরো কাজটা হয়ে যাবে। আমি নিজেও পাসপোর্ট করতে এসে কম্পিউটারের দোকানের লোকদের সহযোগিতা নিয়েছি।’
এরপর ওই ব্যক্তি পাসপোর্ট অফিস থেকে বেরিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অপরিচিত ওই ব্যক্তি পাসপোর্ট করতে আসেননি। তিনি দালাল চক্রের সদস্য হিসেবে দূরদূরান্ত থেকে আসা সাধারণ মানুষদের কম্পিউটারের দোকান থেকে পাসপোর্ট করতে বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। এর বিনিময়ে চুক্তি অনুযায়ী কম্পিউটারের দোকানগুলো থেকে বকশিশ বা মাসোহারা পেয়ে থাকেন।
নির্ধারিত ফি’র চেয়ে বেশি খরচ নেওয়ার অভিযোগ
পাসপোর্ট অফিস থেকে বের হলেই চোখে পড়বে আইটি ওয়ার্ল্ড ট্রিটমেন্ট ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস নামের একটি দোকান। সেখান থেকে নতুন পাসপোর্ট করার আবেদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পাসপোর্ট সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য মিলবে।
ওই প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনলাইনে আবেদনের ক্ষেত্রে ৪৮ পৃষ্ঠার এবং পাঁচ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৪ হাজার ২৫ টাকা (বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আবেদনের ক্ষেত্রে ১৫% ভ্যাটসহ) ফি জমা দিতে হবে। এই পাসপোর্ট পেতে ১৫ থেকে ২১ দিন অপেক্ষা করতে হবে। আর জরুরি পাসপোর্ট করতে লাগবে ৬ হাজার ৩২৫ টাকা, আর এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৭ থেকে ১০ দিন। অন্যদিকে ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে অতীব জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা।
এ ছাড়া ৪৮ পৃষ্ঠার এবং দশ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৫ হাজার ৭৫০ টাকা লাগবে। এই পাসপোর্ট পেতে অপেক্ষা করতে হবে ১৫ থেকে ২১ দিন। আর ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে ফি দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এর বাইরে অতীব জরুরি পাসপোর্ট ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে নিতে চাইলে শুধু ফি গুনতে হবে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা।
সরকারি চাকরিজীবী যাদের এনওসি, অবসর সনদ (পিআরএল) রয়েছে তারা নিয়মিত ফি জমা দেওয়া সাপেক্ষে জরুরি সুবিধা/জরুরি ফি জমা দেওয়া সাপেক্ষে অতীব জরুরি সুবিধা পাবেন। পাসপোর্ট নবায়নের ক্ষেত্রে সমপরিমাণ ব্যাংক চালান প্রযোজ্য।
এদিকে নির্ধারিত ফি ছাড়াও অনলাইন ফি বাবদ ৩০০ টাকা এবং পাসপোর্টের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করতে দোকানগুলো অতিরিক্ত আরও ১ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। আবার কেউ কেউ না বুঝে চক্রের ফাঁদে পড়ে এর চেয়েও বেশি টাকা দিয়ে থাকেন। অভিযোগের সুরে এমনটাই জানিয়েছেন জোনাব আলী নামে এক ভুক্তভোগী।
প্রথমবার পাসপোর্ট করতে মিঠাপুকুর থেকে আসা এই ব্যক্তি গণমাধ্যমকে জানান, তিনি এ বছরের ১১ জানুয়ারি ১০ বছর মেয়াদের ৪৮ পৃষ্ঠার নিয়মিত পাসপোর্টের জন্য ৫ হাজার ৭৫০ টাকা দিয়ে অনলাইনে আবেদন করেন। নির্ধারিত ফি ছাড়াও অনলাইনে আবেদন, পুলিশকে ভেরিফিকেশন ও কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে প্রায় তিন হাজার টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে তার। পহেলা ফেব্রুয়ারি পাসপোর্ট দেওয়ার তারিখ থাকলেও ওই দিন থেকে পরপর দুইবার এসে ফেরত যান বলে জানান তিনি।
বাড়তি টাকায় খুশি পুলিশ-আনসার সদস্যরা
শুধু কম্পিউটারের দোকান বা অনলাইন সার্ভিস নেওয়ার ক্ষেত্রেই বাড়তি টাকা গুনতে হয় না। টাকা দিলে পাসপোর্ট পেতে ভোগান্তি কমবে এমন আশ্বাস দিয়ে কাজ করে দেন সেখানে দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যরাও। গাইবান্ধা জেলার বাসিন্দা হলেও বসবাস সূত্রে রংপুর থেকে পাসপোর্ট করতে কি করতে হবে, এ তথ্য জানতে কথা হয় এক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় জানতে না পারায় প্যাকেজ সিস্টেমে (একজনই সবকিছু করবে) পাসপোর্ট করার পরামর্শ দিয়ে ফাহাদ নামের ওই পুলিশ সদস্য বলেন, নিজ জেলায় গিয়ে পাসপোর্ট করা ভালো। তবে চাইলে রংপুরেও করা যাবে। আমার মাধ্যমে করলে ২ হাজার ৫০০ টাকা বেশি দিতে হবে। সব খরচ মিলিয়ে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা লাগবে।’
শুধু ওই পুলিশ সদস্যই নয় টাকা দিলে এমন কাজ পাসপোর্ট অফিসের আনসার সদস্যরাও করে দেন। তবে এ ক্ষেত্রে সহজ-সরল ও গ্রাম থেকে আসা মানুষজনই তাদের টার্গেটের শিকার হয়ে থাকেন। এমন ঘটনার কথা জানান বদরগঞ্জের আনোয়ারা বেগম। সত্তরোর্ধ্ব বয়সী এই বৃদ্ধা গণমাধ্যমকে জানান, ওমরা হজ করার জন্য তিনি পাসপোর্ট করতে রংপুর এসেছেন। এবার নিজের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আসায় ছবি তোলাসহ অন্যান্য কাজে তার কোনো ভোগান্তি হয়নি। এর আগে গত বছর তিনি একাই এসে পাসপোর্ট অফিসের এক দালালের খপ্পরে পড়েছিলেন। সেইবার তার কাছ থেকে এক অপরিচিত ব্যক্তি পাসপোর্ট করার জন্য ৪ হাজার টাকা নিয়ে সটকে পড়েন। তিনি ওই ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে না পারায় খোয়া যায় তার সেই টাকা।
পাসপোর্ট অফিস থেকে বের হলেই স্থানীয় ১৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সঙ্গে রয়েছে একটি হোটেল। সেখানে বসে কথা হয় দুই যুবকের সঙ্গে। তারা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, ‘পাসপোর্ট করতে আগের চেয়ে এখন ভোগান্তি কম। আগের মতো আর হয়রানিও হতে হয় না। সবকিছুই সহজ হবে যদি পাসপোর্ট অফিসের লোকদের খুশি রাখা যায়। এখন দালালকে সহজে চিহ্নিত করা যায় না, কারণ যে কাউকে টাকা দিলেই কাজ হয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাসপোর্ট অফিসের সঙ্গে যুক্ত দালাল চক্রের সদস্যদের একটি অংশ শহরের বিভিন্ন অফিস-আদালতে ঘোরাঘুরি করেন। বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশনের সামনে ও কাচারিবাজার এলাকায় এদের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। কেউ পাসপোর্ট করবেন জানতে পারলে তাদেরকে নানাভাবে ফুসলিয়ে পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন ওই চক্রটি।
গণমাধ্যম টিম পাসপোর্ট অফিসে অবস্থানকালে দুই দিন দেখা মেলে ত্রিশোর্ধ্ব বয়সী এক নারীর সঙ্গে। তার সঙ্গে কথা হলে জানান প্রায়ই আসেন তিনি। তার দুই সন্তানের পাসপোর্ট হাতে পেতেই এই দৌড়ঝাঁপ। কিন্তু একে একে বেশ কয়েকবার সংশোধনের আবেদন করেও অজ্ঞাত কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে সাড়া না দিয়ে হয়রানি করছেন বলে অভিযোগ করেন রাজিয়া আক্তার নামের এই নারী।
রংপুর নগরীর বাসিন্দা পরিচয় দেওয়া এই নারী গণমাধ্যমকে জানান, তার স্বামী সৌদি প্রবাসী। তিনি ২০১৮ সালে দুই সন্তানসহ নিজের পাসপোর্ট করেন। পরবর্তীতে স্বামীর নাম সংশোধনীর জন্য আবার নতুন করে ওই বছরেরই ফেব্রুয়ারি মাসে তিনটি পাসপোর্টের জন্য কাগজপত্র জমা দেন। পরে তিনি শুধু নিজের পাসপোর্ট হাতে পান, যা সংশোধিত ছিল। কিন্তু তার দুই সন্তানের পাসপোর্ট না দিয়ে “ad/dd justification” লেখা সম্বলিত স্লিপ তাকে ধরিয়ে দেয় পাসপোর্ট অফিস।
গণমাধ্যমকে রাজিয়া আক্তার বলেন, ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমি যতবার পাসপোর্ট অফিসে এসেছি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউই আমার মূল সমস্যা কী, তা কখনো বলেনি। শুধু আজ হবে না, কাল আসুন নয়ত পরে দেখা করুন, এসব কথা বলে বলে সময়ক্ষেপণ করে আসছেন। এভাবে দীর্ঘ পাঁচ বছরে আমি আমার রেমিট্যান্স-যোদ্ধা স্বামীর সন্তানদের সংশোধিত পাসপোর্ট হাতে পেতে মাসের পর মাস পাসপোর্ট অফিসে আসা-যাওয়া করছি।
তিনি আরও বলেন, এরই মধ্যে বেশ ক’জন এই অফিস থেকে অন্যত্র বদলি হয়েছেন। কিন্তু আমার আবেদনের কোনো সুরাহা কেউই করে যাননি। কেন বা কী কারণে আমাকে এভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, তা আমার বোধগম্য নয়। গত জানুয়ারি মাসে আমি ডিডি এবং এডির পরামর্শে আগের আবেদন বাতিল করে আবার নতুন করে আরেকটি আবেদন জমা করি। কিন্তু সেই আবেদন এডি খুঁজে পাওয়ায় আবার নতুন করে তারই পরামর্শে ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করি। পরে ছবি তোলার কক্ষে গেলে আমার নতুন আবেদনগুলো না মঞ্জুর করা হয়। বিষয়টি এডিকে জানালে তিনি আবার আমাকে নতুন একটা আবেদন ঢাকায় পাঠানোর জন্য জমা দিতে বলেন। এভাবে একটার পর একটা আবেদন বা চিঠি লিখেও আমার সন্তানদের পাসপোর্ট করতে পারিনি।
আক্ষেপ করে রাজিয়া আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, আমি একজন রেমিট্যান্স-যোদ্ধার সহধর্মিণী। আমার অবুঝ দুই শিশু তাদের বাবাকে দেখার জন্য মুখিয়ে আছেন। গত পাঁচ বছরে আমি যতবার পাসপোর্ট অফিসে এসেছি, তা আমার জন্য কষ্টকর। এখন এই পাসপোর্ট পেতে আরও কত বছর লাগবে বা কী কারণে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, এসব প্রশ্নের উত্তর পাসপোর্ট অফিসের কারও কাছ থেকে পাইনি।
পুলিশ ভেরিফিকেশন মানেই ‘৫০০-১০০০’ টাকা
পাসপোর্টের ভেরিফিকেশনে গেলে পুলিশকে সর্বনিম্ন হলেও ৫০০ টাকা দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে এর চেয়েও বেশি গুনতে হয় পাসপোর্ট প্রত্যাশীকে। কিছুদিন আগে ভেরিফিকেশনে আসা এক পুলিশ সদস্যকে ১ হাজার টাকা দিয়েছেন বলে জানান মিজানুর রহমান নামের এক ভুক্তভোগী।
তিনি গণমাধ্যমকে জানান, টাকা না দিলে পুলিশ রিপোর্ট অনেক সময় ভালো হয় না। আবার কখনো কখনো পুলিশ ইচ্ছে করে সংশ্লিষ্ট অফিসে ভেরিফিকেশন রিপোর্ট দিতে বিলম্ব করে। এ কারণে অনেকেই বাধ্য হয়ে টাকা দিয়ে তাদেরকে খুশি রেখে নিজের কাজটা করিয়ে নেন। এটা একটা সিস্টেম হয়ে গেছে- টাকা দিলে কাজ হবে নয়ত ঘুরতে হবে।
আমিনুল ইসলাম নামের আরেক ভুক্তভোগী গণমাধ্যমকে বলেন, ভেরিফিকেশনে যাওয়া পুলিশ সদস্যকে বকশিশ দিতেই হবে। তা না হলে ছোট ছোট ভুল তারা বের করবে, নয়ত হয়রানি করবে। অথচ পুলিশ তার পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসেবে ভেরিফিকেশন করে। এর জন্য রাষ্ট্র তাকে বেতনও দিচ্ছে। কিন্তু আমরা ভোগান্তি থেকে বাঁচতেই বকশিশের নামে টাকা দিচ্ছি। এই সুযোগে পুলিশ পাসপোর্টের ভেরিফিকেশনে গেলে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে যার কাছে যেমন পায় নেয়।
ভেরিফিকেশনে টাকা নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাসপোর্ট অফিসে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম না প্রকাশের শর্তে সেখানকার এক আনসার সদস্য গণমাধ্যমকে জানান, সচেতন কেউ টাকা দেয় না। যারা বুঝে না কিংবা জানে না তারাই মনে করে টাকা ছাড়া কাজ হয় না। এ কারণে ভেরিফিকেশনে যাওয়া পুলিশ সদস্যকে অনেকেই বকশিশ দিয়ে থাকেন। এটাকে কেউ কেউ আবার নিয়ম মনে করে থাকেন। তবে অনেক অভিজ্ঞ ও সচেতন ব্যক্তিকে দেখেছি কোনো ধরনের উৎকোচ না দিয়েই তারা পাসপোর্ট করেছেন।
বিষয়টি নিয়ে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. ইফতে খায়ের আলমের সঙ্গে কথা হলে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, পুলিশের দায়িত্ব পাসপোর্ট করতে চাওয়া ব্যক্তির সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। এই দায়িত্ব পালনে গিয়ে কারও কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা বা টাকা নেওয়া ঠিক নয়। কারণ পুলিশ সদস্যদের বেতন রাষ্ট্র দিয়ে থাকে। অথচ সাধারণ মানুষ মনে করে টাকা দিলে কাজটি দ্রুত হবে বা পুলিশ রিপোর্ট ভালো হবে।
ফিরেছে স্বস্তি, সচেতনতার পরামর্শ
সম্প্রতি পাসপোর্ট করেছেন রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ পৌর এলাকার শাহানা বেগম। তিনি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (এনজিও) চাকরি করছেন। এই নারী গণমাধ্যমকে বলেন, অনলাইনে সবকিছু আগে জেনেছি। তবে সরাসরি পাসপোর্ট অফিসে এসে নোটিশ বোর্ডে লাগানো নমুনা কপি দেখে নিজেই ফরম পূরণ করে জমা দিয়েছি। নির্ধারিত ফি ছাড়া অতিরিক্ত কোনো টাকা লাগেনি। দালালের খপ্পরে না পড়ে একটু সচেতন হলেই ভোগান্তি-হয়রানি ছাড়াই পাসপোর্ট পাওয়া যাবে।
আগের চেয়ে দালালের উপদ্রব কমেছে দাবি করে রংপুর মহানগরীর সাংস্কৃতিক সংগঠক আরিফুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, মাস দু-এক আগে আমি নিজেই ই-পাসপোর্ট করেছি। শান্ত চিত্তে সেবা গ্রহণ করা যায়। সেবাগ্রহীতাদের জন্য রয়েছে বসার সু-ব্যবস্থা। আগের মতো দালালের দৌরাত্ম্য নেই, নেই ভোগান্তি-হয়রানি। তবে একসময় পাসপোর্ট অফিসে দালালের উপদ্রব নিয়ে অনেক সমালোচনা ছিল। সেটা এখন কিছুটা হলেও কমে এসেছে।
কী বলছেন পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে রংপুর বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের উপ-পরিচালক শাহ মুহম্মদ ওয়ালিউল্লাহ’র সঙ্গে কথা বলেন গণমাধ্যমের প্রতিবেদক। সম্প্রতি রংপুরে যোগদান করা এই কর্মকর্তা পাসপোর্ট অফিসে দালালের উপদ্রব ও হয়রানি রোধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন।
উপ-পরিচালক শাহ মুহম্মদ ওয়ালিউল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, আমি কয়েক দিন আগে যোগদান করেছি। এখন পর্যন্ত আমার পাসপোর্ট অফিসে দালালের উপদ্রব চোখে পড়েনি। অফিসের বাইরে যদি দালাল থাকে সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা যাতে কেউ না নেন সেজন্য আমি অফিসের সকলকে সতর্ক করে দিয়েছি। কোনোরকম হয়রানি ছাড়াই দ্রুত সময়ে জনসাধারণকে পাসপোর্ট সেবা প্রদানের লক্ষ্যে নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। দালালের উপদ্রব ও হয়রানি রোধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা সবাইকে বলেছি।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন ১০০-১২০টা পর্যন্ত আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে অনেকের ত্রুটিপূর্ণ আবেদনও থাকে, যেগুলো পরবর্তীতে সংশোধন করতে হয়। কারও কোনো অভিযোগ থাকলে সেসব শোনা হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে সমাধানের মতো হলে সেটি করে দেওয়ার চেষ্টা করছি। আলাদাভাবে নির্দিষ্ট কোনো দিনে গণশুনানি হয় না। তবে প্রতিদিনই কমবেশি অনেকের অভিযোগ শোনা হয়। এক কথায় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই প্রতিদিনই গণশুনানি হয়ে থাকে। এতে কারও তথ্যের গরমিলের পাশাপাশি এনআইডি কার্ডের সঙ্গে পূর্বের পাসপোর্টের তথ্যের হেরফের নিয়ে বেশি শুনানি হয়।
শাহ মুহম্মদ ওয়ালিউল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, অন্যান্য বিভাগীয় শহরের তুলনায় রংপুর জেলায় পাসপোর্ট খুবই কম হয়। এখানে যারা সেবাগ্রহীতা তারা ওয়ান-টু-ওয়ান সার্ভিস নিতে পারেন। কোনো চাপ নেই, ঝামেলা নেই। কারও কোনো অভিযোগ থাকলে সেটিও সঙ্গে সঙ্গে শোনা হচ্ছে। আমার স্টাফদের বলেছি একটি ফরমও যদি রিজেক্ট করা হয়, সেটির কারণ যেন আমাকে অবগত করা হয়। পাসপোর্ট প্রত্যাশীর কাজ হলো আবেদন জমা করা। আমি যদি শতভাগ আবেদন জমা করি, তারপরও যদি কেউ দালালের কাছে যায় সেটার দায় দায়িত্ব তো আমাদের নয়।
এক রেমিট্যান্স-যোদ্ধার পরিবারের হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। কী কারণে তাকে পাঁচ বছর ধরে বারবার আবেদন করে ঘুরতে হচ্ছে, সেটা আগে জানতে হবে। এরপর করণীয় কী সেটা বলা সম্ভব হবে। তবে আমার কাছে গত দুই-তিনে এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে কেউ আসেনি।
দালালদের খপ্পরে না পড়ে সরাসরি অফিস নির্দেশনা অনুযায়ী পাসপোর্টের কাগজপত্র জমা দিতে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
গণমাধ্যমকে শাহ মুহম্মদ ওয়ালিউল্লাহ বলেন, পাসপোর্ট করতে অতিরিক্ত কোনো টাকা লাগে না-এমন নির্দেশনা সাঁটানো রয়েছে। তারপরও যদি কেউ দালালের খপ্পরে পড়ে অতিরিক্ত টাকা দেন তাহলে আমি কী করতে পারি? সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post