আশির দশকে ধর্ষণের বদলা নিতে ২০ জনকে হত্যা করেছিলেন ‘দস্যুরানী’ ফুলন দেবী এবং তার দলের সদস্যরা। সে সময় তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
এদিকে সেই হত্যাকাণ্ডের ৪৩ বছর পর সাজা ঘোষণা করল ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুরের একটি আদালত। ওই ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে বর্তমানে দুজন বেঁচে আছেন। তার মধ্যে একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন কানপুরের আদালত। এ ছাড়া প্রমাণের অভাবে অন্যজনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন বিচারক।
যেভাবে দস্যুরানী হয়ে উঠলেন ফুলন দেবী
ফুলন দেবী ভারতে নিচু বর্ণ হিসেবে পরিচিত মাল্লা বর্ণের এক পরিবারে ১৯৬৩ সালের ১০ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ফুলন দেবীর চেয়ে ‘দস্যু রানী’ হিসেবে অধিক পরিচিত। মাত্র ১১ বছর বয়সে চাচাদের চাপে তার পরিবার তাকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয় পুতিলাল নামে ৩০ এক ব্যক্তির সঙ্গে, যিনি ফুলন দেবীকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করতেন।
অত্যাচারের মুখে শিশু ফুলন দেবী বেশ কয়েকবার স্বামীর বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে ফিরে এলেও সামাজিক চাপের মুখে বারবার তাকে স্বামীর বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়। অবশেষে তার স্বামীর কার্যকলাপের প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি স্থায়ীভাবে নিজ পিতৃগৃহে ফিরে আসেন।অন্যদিকে ১৯৭৯ সালে মায়াদিন চুরির অভিযোগে ফুলন গ্রেফতার হন। সে সময় ফুলনের তিনদিনের কারাবাস হয়। কারাবাসে তিনি আইনরক্ষকের হাতে ধর্ষণের শিকার হন।
একই বছরের জুলাই মাসেই ফুলন দেবীকে তার বাবার বাড়ি থেকে অপহরণ করে বাবু গুজ্জর নামের এক ডাকাতের দল। বাবু গুজ্জর তাকে টানা তিনদিন ধর্ষণ করে। কিন্তু ওই দলের আরেক ডাকাত সদস্য বিক্রম মাল্লার ভালো লেগে যায় ফুলন দেবীকে। পরে অপহরণের তিন দিনের মধ্যেই বাবু গুজ্জরকে খুন করে দলের নেতা হয় বিক্রম মাল্লা। বিক্রম ফুলন দেবীকেও অস্ত্র চালানো শেখায় এবং ডাকাত দলের সদস্য করে নেয়। পরের প্রায় এক বছর তাদের ডাকাত দল উত্তর প্রদেশের দেভারিয়া, কানপুর আর ওরাই অঞ্চলে ত্রাস সঞ্চার করে।
ডাকাত রূপে ফুলন দেবী
বিক্রম মাল্লার বিয়ে করে ফুলন দেবীকে। এর পরেই ডাকাত দলটি ফুলনের প্রথম স্বামী পুতিলালের বসবাসকৃত গ্রামে ডাকাতি করে। ফুলন পুতিলালকে টেনে নিয়ে এসে জনসমক্ষে শাস্তি দেন ও খচ্চরের পিঠে উল্টো করে বসিয়ে নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে বন্দুক দিয়ে প্রহার করেন। তিনি প্রায় মৃত অবস্থায় পুতিলালকে ফেলে চলে যান। যাওয়ার সময় কম বয়সের বালিকা মেয়ে বিবাহ করা পুরুষদের জন্য সাবধানবাণী স্বরূপ একটি পত্র রেখে যান।
ফুলন দেবী বিক্রম মাল্লা থেকে বন্দুক চলানো শিখেছিলেন। এরপরে উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশ বসবাসকারী উচ্চ বর্ণের লোকদের গ্রামে লুণ্ঠন, ভূস্বামীদের অপহরণ, রেল ডাকাতি ইত্যাদি বিভিন্ন অভিযান চালায়।
বেহমাই হত্যাকাণ্ড
ফুলন দেবী ও বিক্রম মাল্লার এই ডাকাত দলের দৌরাত্ম্য থামে বিক্রম মাল্লার মৃত্যুতে। বিক্রম মাল্লার ডাকাত দলেরই উচ্চ বর্ণের সদস্য শ্রীরাম জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বিক্রমকে হত্যা করে ফুলন দেবীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় কানপুরের কাছে বেহমাই গ্রামে। বেহমাই গ্রামে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে ফুলন দেবীকে গণধর্ষণ করে শ্রীরামসহ আরও অনেকে, যারা অপেক্ষাকৃত উচ্চ বর্ণের ঠাকুর গোত্রীয় ক্ষত্রিয় শ্রেণির হিন্দু।
এ ছাড়া ফুলন দেবীকে শাস্তি দেয়ার জন্য বেহমাই গ্রামে গ্রামবাসীর সামনে তাকে নগ্ন অবস্থায় কুয়া থেকে পানি আনতেও পাঠানো হয়েছিল।
‘কুখ্যাত’ হয়ে ওঠা
নির্যাতিত ফুলনের দুঃখের কাহিনী শুনে বাবা মুস্তাকিন নামে এক ডাকাত নেতা তাকে নতুন একটি ডাকাত দল গঠন করতে সাহায্য করে। মান সিং ছিল তার দলের দ্বিতীয় নেতা। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ফুলন রাম ভ্রাতৃদ্বয়ের সন্ধান করেন। অবশেষে সন্ধান হয় যে শ্রীরাম বেহমাই গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে।
এরপর ১৯৮১ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি দল নিয়ে বেহমাই গ্রামে ফিরে যান ফুলন দেবী। সেখানে গিয়ে তারা গ্রামবাসীর বলেছিলেন শ্রীরামকে তার হাতে তুলে দিতে। কিন্তু পুরো গ্রামে শ্রীরামকে খুঁজে না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ২০ জন ঠাকুর সম্প্রদায়ের পুরুষকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে ফুলন দেবীর দলের সদস্যরা।
পরে ফুলন দেবী যখন আত্মসমর্পণ করেন, তখন তিনি দাবি করেছিলেন যে ওই হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না। সে সময় বেহমাই হত্যাকাণ্ডের জন্য উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ভি.পি সিং পদত্যাগ করার জন্য বাধ্য হয়েছিলেন।
আত্মসমর্পণ ও বন্দী জীবন
বেহমাই হত্যাকাণ্ডের পর ফুলন দেবীকে ধরার জন্য চাপ পড়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর। প্রায় এক বছর চেষ্টা করে ফুলন দেবীকে গ্রেফতার করতে না পেরে তাকে আত্মসমর্পণ করার জন্য চাপ দেয়ার চেষ্টা করে মধ্য প্রদেশের পুলিশ। পরে ফুলন দেবী কিছু শর্ত দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন।
শর্তগুলো হলো-
- ফুলন ও তার অন্যান্য সঙ্গীরা কেবল মধ্যপ্রদেশে আত্মসমর্পণ করবেন, বিচারের জন্য তাদের উত্তরপ্রদেশে নেয়া হবে না।
- ফাঁসি দিতে পারবেন না ও ৮ বছরের অধিক সময় কারাবাস হবে না।
- সম্পর্কীয় ভাতৃ মায়াদিন অবৈধভাবে দখল করা জমি ফুলনের বাবাকে ফেরত দিতে হবে।
- ফুলনের বাবা-মাকে মধ্যপ্রদেশে সংস্থাপিত করতে হবে।
- সরকারকে ফুলনের ভাইকে চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে।
পরে সরকার তার সবকয়েকটি শর্তে সম্মত হয়। বেহমাই হত্যাকাণ্ডের প্রায় দুই বছর পর ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় ৮০০০ জন দর্শকের উপস্থিতিতে ফুলন আত্মসমর্পণ করেন। সে সময় ফুলন পরিধান করেছিলেন একটি খাকি পোশাক। শরীরে ছিল একটি লাল চাদর। মাথায় ছিল একটি লাল কাপড় যা বেহমাই গ্রামে চলানো যৌন অত্যাচার ও নির্যাতনের পর প্রতিশোধের প্রতীক রূপে তিনি মাথায় বেঁধেছিলেন। কাঁধে ছিল একটি বন্দুক। হাতজোড় করে তিনি জনসাধারণকে নমস্কার জানান।
দেবী দুর্গা ও মহাত্মা গান্ধীর ছবির সম্মুখে তিনি বন্দুকটি রেখে আত্মসমর্পণ করেন। সরকারে ফুলনের দেয়া শর্ত মেনে নিলেও একটি শর্ত ভঙ্গ করেছিল। বিনা বিচারে তাকে ১১ বছরের কারাবাসে থাকতে হয়েছিল। অবশেষে ১৯৯৪ সালে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
রাজনৈতিক জীবন
ফুলন দেবীর রাজনৈতিক জগতের গুরু ছিলেন সমাজবাদী পার্টির নেতা মুলায়ম সিং যাদব। উত্তর প্রদেশের মির্জাপুর সংসদীয় অঞ্চলে অধিকাংশই ঠাকুর সম্প্রদায়ের ভোটার ছিল যদিও নিম্নবর্ণের মাল্লা ও জুলাহা সম্প্রদায়ের সন্মিলিত সংখ্যার বিপরীতে তাদের সংখ্যা কম। স্বাভাবিকভাবে এই আসনটি দখল করার জন্য ১৯৯৬ সালে সমাজবাদী পার্টি ফুলনকে মির্জাপুর আসনের জন্য টিকেট দেন। ভারতীয় জনতা পার্টি ও বেহমাই হত্যাকাণ্ডে নিহত হওয়া ঠাকুরের পত্নীদের ঘোর বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হন। ১৯৯৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ফুলন পরাজিত হলেও ১৯৯৯ সালে মির্জাপুর লোকসভা নির্বাচনে তিনি পুনরায় আসন দখল করতে সক্ষম হন। এরপর ১৯৯৬ সালে তাকে সমাজবাদী পার্টি লোকসভা নির্বাচনের টিকিট দিলে তিনি মধ্য প্রদেশ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আততায়ীর হাতে নিহত
সাংসদ থাকা অবস্থাতেই ২০০১ সালের ২৫ জুলাই ফুলন দেবীকে দিল্লির বাসভবনের সামনে গুলি করে হত্যা করে শের সিং রানা নামের এক যুবক। ফুলন দেবীর গায়ে সেদিন ৯টি গুলি লেগেছিল আর তার দেহরক্ষীর গায়ে দুটি গুলি লাগে। সেই সময়ে তিনি সংসদ থেকে বের হয়ে আসছিলেন।
আততায়ী শের সিং রানাকে দুইদিনের মধ্যেই গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে হাই সিকিউরিটি তিহার জেলে পাঠানো হয়। তিন বছরের মধ্যে ২০০৪ সালে জেল থেকে আদালতে নেয়ার সময় তিনি পালিয়ে যান এবং ২০০৬ সালে আবার ধরা পড়েন। ২০১৪ সালে দিল্লির একটি আদালত ফুলন দেবী হত্যার দায়ে শের সিং রানাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও ২০১৬ সালে জামিনে মুক্তি পান তিনি।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post