মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত ৭ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বেশ স্পষ্টবাদী অবস্থান নিয়েছিল। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর থেকেই তারা তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে।
নির্বাচন নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে ওয়াশিংটন জানায়, ‘নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি’। ওয়াশিংটনের এ ভূমিকার মধ্যে ঢাকায় দেশটির দূতিয়ালির দায়িত্ব পালন করা রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এরইমধ্যে জানান দেন নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চায় মার্কিন প্রশাসন। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়ে একই আগ্রহের কথা জানালেন খোদ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। চিঠিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহের কথা উল্লেখ করেন।
সরকারপ্রধানকে বাইডেনের পাঠানো চিঠি ইতিবাচক সাইন হিসেবে দেখছেন ঢাকার কূটনৈতিক অঙ্গন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, চিঠিটি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত দেয়। শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চাওয়ার বার্তা দিয়েছে মার্কিন প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারত্বের পরবর্তী অধ্যায় শুরুর পর্বে আমি বলতে চাই, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, মানবিক সহায়তা, বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ আরও অনেক ইস্যুতে আমাদের প্রশাসন একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহের কথা আমি তুলে ধরছি
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মাফা চিঠি, ওয়েল ড্রাফট। খুব শক্তিশালী চিঠি। যুক্তরাষ্ট্রের যেসব বিষয়ে আপত্তি আছে চিঠিতে সেগুলোর বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। কোথাও নির্বাচন ইস্যুটি তোলা হয়নি এবং নির্বাচন নিয়ে তাদের সমর্থনের কথাও নেই। যে যে ক্ষেত্রে সামনে যাওয়া যায় এবং সম্পর্ক যেন উপরে যায় সেই বার্তা রয়েছে চিঠিতে। বাংলদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উপরের দিকে যাবে। সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বার্তা বহন করে চিঠির ভাষায়। নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার বিষয়টি চিঠিতে প্রকাশ করা হয়েছে।’
মন্ত্রণালয়ের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, শ্রম ইস্যুসহ যেসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব বিষয়ে আপত্তি রয়েছে সেগুলোকে প্রাধান্য না দিয়ে রাজনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া এবং নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার বার্তা দিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের সরকারপ্রধানকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের লেখা চিঠি কূটনৈতিক পত্রের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে ঢাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক তিনি বলেন, “আমি মনে করি, বাইডেনের চিঠি একটা ইতিবাচক সাইন। কারণ অনেকে অনেক কথাবার্তা বলছিল, সেটা আশা করি কিছু দিনের জন্য অবসান ঘটবে।”
চিঠিতে বাইডেন লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারত্বের পরবর্তী অধ্যায় শুরুর পর্বে আমি বলতে চাই, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, মানবিক সহায়তা, বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ আরও অনেক ইস্যুতে আমাদের প্রশাসন একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহের কথা আমি তুলে ধরছি।’
বাইডেন লিখেছেন, ‘সমস্যা সমাধানে একসঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের দীর্ঘ ও সফল ইতিহাস রয়েছে। আর আমাদের এই সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে দুই দেশের জনগণের শক্তিশালী সম্পর্ক।’ চিঠির শেষে প্রেসিডেন্ট বাইডেন লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সমর্থন এবং একটি অবাধ ও মুক্ত ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অভিন্ন স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে সাবেক এক কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে লক্ষ্য ছিল, তা কিন্তু অর্জিত হয়নি। চিঠিতে নির্বাচন প্রসঙ্গ আনাই হয়নি। তার মানে এই নয় যে নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থানের পরিবর্তন করেছে। তবে বাইডেন প্রশাসন যে নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চায় সেটি জানিয়ে দিয়েছে। এটাও ভাবা ঠিক হবে না যে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের কনসার্নের (উদ্বেগের) বিষয় থেকে সরে যাবে। চিঠিটি ওয়েল ড্রাফট বলা যেতে পারে।
জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমি মনে করি, বাইডেনের চিঠি একটা ইতিবাচক সাইন। কারণ অনেকে অনেক কথাবার্তা বলছিল, সেটা আশা করি কিছু দিনের জন্য অবসান ঘটবে। তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) দিক থেকে চেষ্টা থাকবে এ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক করে তাদের যে অর্থনৈতিক এজেন্ডা বা জাতীয় স্বার্থ আছে সেটা যেন বাড়ে। আর এটা না চাওয়ার কোনো কারণ নাই। কারণ তারাও ভালো করে জানে যে, বাংলাদেশ তো আর বসে থাকবে না।
ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, অনেক দেশ আগ্রহ প্রকাশ করছে বাংলাদেশের সঙ্গে বড় সম্পর্ক করার। সেটা মোটামুটি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ঠিকঠাক হবে। বড় আকারে কার সঙ্গে কোন প্রজেক্ট তৈরি হবে এবং পাইপলাইনে যেসব প্রজেক্ট আছে সেগুলো সামনে চলে আসবে। স্বাভাবিকভাবে আমেরিকা চাইবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক যেন থাকে। যদিও তাদের সমালোচনা ছিল নির্বাচনের ব্যাপারে। তবুও সেটা এখনও মুখ্য না। এখন মুখ্য হলো, এই সরকারের সঙ্গে যেন তাদের একটা সম্পর্ক থাকে।
গত বছরের মে মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেন। সেখানে বাংলাদেশের অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিতে দেশটির অব্যাহত নজরদারির বিষয়টি উঠে আসে। পরবর্তী সময়ে অব্যাহতভাবে দেশটি নির্বাচন ইস্যুতে বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের চাপ প্রয়োগ করতে দেখা গেছে।
গত ৭ জানুয়ারির ভোটে ২২৩টি আসনে জিতে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের পরদিন ভোট সুষ্ঠু হয়নি বলে বিবৃতিতে দেয় যুক্তরাজ্য। এরপর বেশ কয়েকবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন ইস্যুতে অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি দেশটির। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে চায় দেশটি। একইসঙ্গে দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী দেশটি।
গত ১৭ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে প্রথম সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। সেদিন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের পারস্পরিক স্বার্থকে এগিয়ে নিতে আগামী মাসগুলোতে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করার প্রতীক্ষায় আছি।
সবশেষ, ৪ জানুয়ারি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পিটার হাস। বৈঠক শেষে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জানান, বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। তারপরও বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে কাজ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post