প্রবাসী বাবা নেপাল চন্দ্র কাপাশিয়া কাঁদছেন। পাশেই মায়ের কোলে বসা শিশুপুত্র নির্বাক চোখে তা দেখছে! নেপালের স্ত্রী চোখ বুঝে মাথা নিচু করে কান্না লুকানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার ভেতরটা যে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, তা বুঝতে বাকি থাকল না সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সংবাদকর্মীদের।
আপন ভাইদের কারণে নেপাল চন্দ্র কাপাশিয়ার আজকের এ অবস্থা। নিজের জীবনের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে প্রবাসে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে সব টাকা পাঠিয়েছেন দেশে থাকা আপনার ভাইদের কাছে। তার টাকায় স্বাবলম্বী হয়েছে ভাইয়েরা। কিন্তু সেই নেপাল চন্দ্র যখন দেশে এসে টাকা হিসাব চাইলেন তখনই তাকে সবাইকে মিলে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলো। এখন শিশুপুত্র ও স্ত্রীকে নিয়ে পথে পথে ঘুরছেন তিনি। পুলিশের কাছে গিয়েও কোনো লাভ হয়নি।
১৭ বছর মালয়েশিয়ায় প্রবাসজীবন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে দেশে ফিরে আপন ভাইদের প্রতারণার শিকার ফরিদপুরের আলিয়াবাদ ইউনিয়নের পাটপাশা গ্রামের নেপাল চন্দ্র কাপাশিয়া (৪৬)।
প্রবাসজীবনে উপার্জন করা ৩৬ লাখ টাকা পাঠিয়েছিলেন দেশে তারই আপন বড় ভাই দুলাল কাপাশিয়ার কাছে। দেশে ফিরে সেই টাকার হিসাব চাইলে উল্টো তাকে ও তার স্ত্রীকে মারপিট করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন তারা। থানায় মামলা করলেও প্রতিকার মিলছে না। একমাত্র শিশু সন্তানকে নিয়ে বিচারের আশায় তিনি এখন পথে পথে ঘুরছেন। ফিরতে পারছেন না বসতভিটায়।
রোববার (০৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জীবনের এ তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে এর বিচার দাবি করেন নেপাল। শহরের মুজিব সড়কের পাশে স্থানীয় একটি সংবাদপত্র কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এসময় তার স্ত্রী ইতি লতা মণ্ডল ও ৪ বছরের পুত্র চিত্র কাপাশিয়া উপস্থিত ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে নেপাল চন্দ্র কাপাশিয়া জানান, বাবা মৃত পবন চন্দ্র কাপাশিয়ার চার সন্তান তারা। ভাগ্য ফেরানোর আশায় তিনি ১৯৯৪ সালে মালয়েশিয়া যান। সেখানে টেক্সটাইল মিলে শ্রমিকের কাজ করতেন। তখনও বিয়ে করেননি। বিদেশ থেকে উপার্জনের টাকা তিনি দেশে থাকা বড় ভাই দুলাল কাপাশিয়ার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠাতেন। ২০১৪ সালে তিনি বিয়ে করেন। মাঝখানে ৬ বছর দেশে থেকে আবার বিদেশে যান।
২০১৭ সালে দেশে ফিরেন। এরপর বিদেশ থেকে পাঠানো টাকার হিসাব চাইলে শুরু হয় বিবাদ। এলাকার চেয়ারম্যান ও স্থানীয়রা এ নিয়ে সালিশ মিমাংসাও করে। সেখানে সবশেষ দুলালকে অনুরোধ জানানো হয় কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা ফেরত দিতে। তিনদিন পরে সেই টাকা দেয়ার কথা হলেও সেই টাকাও আর দেননি।
এরপর ওই টাকা চাইতে গেলে ভাই-ভাতিজাদের নিয়ে দুই দফায় দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দুলাল কাপাশিয়া দুই দফায় হামলা করে জখম করে নেপালকে। তার স্ত্রীর ৭৫ হাজার টাকা দামের গহনা ছিনিয়ে নেয়। এনিয়ে নেপাল কাপাশিয়া ও তার চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী বিউটি বিশ্বাস থানায় দুটি মামলা করেন। ওই মামলায় এ পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। অন্যদিকে, প্রবাস জীবনের সব উপার্জন হারিয়ে স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে বাড়িতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
নেপালের স্ত্রী ইতি লতা মণ্ডল বলেন, বিয়ের পরেও দুই বছর বড় ভাইয়ের কাছে টাকা পাঠাতো তার স্বামী। এখন তারা শিশুপুত্রকে নিয়ে যাযাবরের মতো দিন কাটাচ্ছেন। তার আর সংসার গোছানো হলো না। বিদেশ থেকে পাঠানো টাকা দিয়ে বড় ভাই দুলাল কাপাশিয়া কিছু জমি কিনে। তাদেরকে বাবার ভিটের একপাশে ঘর তুলে থাকতে বলেছিল। এখন সেই ভিটাতেও যেতে দিচ্ছে না। তিন ভাই একজোট হয়ে এখন তার স্বামীকে বাড়ি যেতে দিচ্ছে না।
সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, নেপাল কাপাশিয়ার টাকা আত্মসাৎ করে তার ভাই জমিজমা কিনেছেন। বাজারে রড-সিমেস্ট ও শেয়ারের ব্যবসা করছেন।
এব্যাপারে জানতে দুলাল কাপাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে কথা বলেন তার স্ত্রী পূর্ণিমা কাপাশিয়া। পূর্ণিমা বলেন, ‘নেপাল কাপাশিয়া যে কয়বার বিদেশ গেছে আমার স্বামীও তাকে টাকাপয়সা দিয়েছিল। উনি এখন হিসাব দিতে পারছেন না।’
হামলার ব্যাপারে তার দাবি, জমি মাপার সময় উল্টো নেপাল লোকজন নিয়ে হামলা করেছে।
এ বিষয়ে আলিয়াবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ওমর ফারুক বলেন, সালিশের মাধ্যমে নেপাল কাপাসিয়াকে ৫ লাখ টাকা ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবার হওয়ায় তাদের মা টাকা ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে আপত্তি করে। এজন্য ওই টাকা আর ফেরত পাওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে ওই পরিবার ভোগান্তিতে রয়েছেন।
এব্যাপারে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার এস আই এসএম রিয়াদুজ্জামান বলেন, ‘ভাইয়ে ভাইয়ে টাকা পয়সা ও জায়গা জমি নিয়ে মারামারির ঘটনা ঘটেছে৷ এনিয়ে দুই পক্ষ থেকেই পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে। বিষয়টি তদন্তাধীন।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post